Israel

মার্কিন মধ্যস্থতায় সংঘর্ষ বিরতিতে সম্মতি ইজরায়েলের

আন্তর্জাতিক

হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষ বিরতির সমঝোতায় সম্মতি জানিয়েছে ইজরায়েল। বৃহস্পতিবার হামাসের আটক করা পণবন্দীদের পরিবারকে এমনই জানিয়েছেন এদেশের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানেয়াহু। গত কয়েকদিন ধরে আমেরিকার মধ্যস্থতায় ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের মধ্যে সংঘর্ষ বিরতি নিয়ে আলোচনা চলছে। মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের বিশেষ প্রতিনিধি স্টিভ হুইটকফ ইতিমধ্যে দুই পক্ষের সামনেই সংঘর্ষ বিরতির একটি প্রস্তাব রেখেছেন। 

হুইটকফের প্রস্তাব অনুযায়ী, সবার আগে হামাস ১৮ জন নিহত ইজরায়েলী পণবন্দীর মৃতদেহ ফেরত দেবে। তাঁরা সবাই গাজায় আটক অবস্থায় ইজরায়েলেরই বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হানায় নিহত হন। একই সঙ্গে আরও ১০ জন জীবিত পণবন্দীকে মুক্তি দেওয়া হবে। তারপরেও হামাসের কাছে ৩০ জন ইজরায়েলী পণবন্দী থাকবেন। এরপর দুই পক্ষই ৬০ দিনের এক সংঘর্ষ বিরতি পালন করবে। এই ৬০ দিনের পর্ব মিটলে হামাসের বিরুদ্ধে ইজরায়েল আবার যুদ্ধে ফিরতে পারে, অথবা হামাসের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সমঝোতার ভিত্তিতে সংঘর্ষ বিরতি বজায় রাখতে পারে। নির্ধারিত ৬০ দিনের পরেও যদি সংঘর্ষ বিরতি না ভাঙে, মার্চের পর গাজায় দখল করা যাবতীয় অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে ইজরায়েল। পাশাপাশি শহরে ত্রাণ সরবরাহের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘকে অনুমতি দেওয়া হবে। 

হুইটকফের এই প্রস্তাব আগাগোড়া ইজরায়েলের আশানুরূপ, কটাক্ষ করেছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের বড় অংশ। একদিকে প্রথম শর্ত হিসেবে পণবন্দীদের মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ইজরায়েলী পণবন্দীদের বিনিময়ে প্যালেস্তিনীয় রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার কোন আশ্বাস এখনও পর্যন্ত মেলেনি। তার উপর ৬০ দিন পর পুনরায় যুদ্ধ শুরু হওয়া বা না হওয়া পুরোপুরি ইজরায়েলের ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে। যদিও এর আগেই হুইটকফের সঙ্গে আলোচনায় সংঘর্ষ বিরতির একটি সার্বিক কাঠামোর প্রতি সম্মতি জানায় হামাস। 

বর্তমানে গাজায় পুরোপুরি একতরফা সংঘর্ষ চলছে। হামাসের তরফে প্রায় কোন প্রত্যাঘাতী হামলা করা হচ্ছে না। উলটোদিকে ইজরায়েল বেছে বেছে জনবহুল এলাকা, বম্ব শেল্টার বা ত্রাণ শিবিরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। ইজরায়েলের দিকে হতাহত হওয়া বা কোন রকম ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। স্থল অভিযানেরও আর এই পর্যায় তেমন প্রয়োজন পড়ছে না। ফলে নির্দ্বিধায় ঠান্ডা ঘরে বসে নিরীহ প্যালেস্তিনীয়দের উপর একের পর এক রিমোট চালিত ক্ষেপণাস্ত্র দেগে যাচ্ছে ইজরায়েল। ইজরায়েলের সরকারের উদ্দেশ্য এখন সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযান নয়, হামাসকে ‘খতম’ করাও নয়, বরং সাধারণ প্যালেস্তিনীয়দের আক্ষরিক অর্থে ‘সাফ’ করা। তার পদ্ধতি হিসেবে সাধারণ শহরবাসীদের দেদার হত্যা এবং সন্ত্রস্ত করার পন্থাই তারা অবলম্বন করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে গাজায় যা চলছে, তাকে আর সংঘর্ষ বা যুদ্ধ বলা যায় না। এটা স্পষ্টত গণহত্যা। হুইটকফের এই প্রস্তাব ইজরায়েলের উদ্দেশ্যের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাবে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বড় অংশ। 

নেতানেয়াহু সরকার স্পষ্টত জানিয়েছে, সমস্ত পণবন্দীদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত তিনি এই একতরফা হত্যা বন্ধ করবেন না। তারই সঙ্গে হামাসকে নিরস্ত্র করতে হবে এবং তাদের পরিচালিত গাজার প্রশাসনকে  নির্বাসনে পাঠাতে হবে। নেতানেয়াহু জানিয়েছেন, গাজাকে ইজরায়েল স্থায়ী ভাবে দখলে রাখবে এবং সেখানকার বাসিন্দাদের অন্য কোথাও ‘স্বেচ্ছা অভিবাসনে’ সাহায্য করবেন। সহজে বললে, তিনি গাজাকে দখলে রেখে শহরবাসীদের জবরদস্তি উচ্ছেদ করতে চান। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়াশিংটনে বসে, নেতানেয়াহুকে সামনে রেখে, এমনই এক পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন ট্রাম্প। ইজরায়েল যে সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতেই কাজ করছে তা স্পষ্ট। ইজরায়েল ও আমেরিকার এই ঘোষিত পরিকল্পনায় তীব্র বিরোধিতা জানিয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ সহ আন্তর্জাতিক মহল। এই পরিকল্পনা প্যালেস্তিনীয়দের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সমান বলে তারা জানিয়েছেন। এমনটা করা হলে আন্তর্জাতিক আইন গুরুতর ভাবে লঙ্ঘন করা হবে।

উলটোদিকে হামাস স্পষ্ট জানিয়েছে, ইজরায়েলের বন্দী শিবিরে আটক ১১০০ জন প্যালেস্তিনীয় রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তির বিনিময়েই অবশিষ্ট সমস্ত ইজরায়েলী পণবন্দীদের ছাড়া হতে পাড়ে। একই সঙ্গে ইজরায়েলকে গাজা থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করতে হবে এবং একটি স্থায়ী সংঘর্ষ বিরতি বজায় রাখতে হবে। গাজার প্রশাসনের দায়ভার রাজনৈতিক ভাবে নিরপেক্ষ প্যালেস্তিনীয়দের দিয়ে তৈরি এক কমিটির কাছে ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে হামাস। ইজরায়েল অবধারিত ভাবে তা মানবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। তার ফলস্বরূপ হুইটকফের সংঘর্ষ বিরতি প্রস্তাব অনুযায়ী যদি এগনো হয়, তবে ৬০ দিনের মাথায় গণহত্যার নৃশংস অভিযান পুনরায় শুরু করবে ইজরায়েল।  

এদিকে বৃহস্পতিবারেই অধিকৃত প্যালেস্তাইনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইহুদি দখলদারদের আরও ২২টি নতুন জনপদ তৈরি করা হবে বলে জানিয়েছে নেতানেয়াহু সরকার। এক বিবৃতিতে এদিন ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ জানিয়েছেন, ‘‘এই অঞ্চল ঐতিহাসিক ভাবে ইজরায়েলের। প্যালেস্তিনীয় সন্ত্রাসবাদের থেকে আমরা এই অঞ্চল পুনরুদ্ধার করি। প্যালেস্তিনীয়রা যাতে এই অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি না করতে পারে, তার জন্য উপযুক্ত অস্ত্র হিসেবে এই সমস্ত ইহুদি জনপদ তৈরি করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ১৯৬৭-র যুদ্ধে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক দখল করে ইজরায়েল। তারপর থেকে এই অঞ্চলে বসবাসকারী ৩০ লক্ষ প্যালেস্তিনীয় জনগণের উপর কার্যত যথেচ্ছাচার করছে ইজরায়েল। ১৯৯৩-র চুক্তির ভিত্তিতে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজা মিলিয়ে স্বাধীন প্যালেস্তিনীয় রাষ্ট্র তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। ইজরায়েল এই চুক্তিতে প্রথমে রাজি হলেও তারপর থেকে যেন তেন প্রকরণে স্বাধীন প্যালেস্তাইন গঠনে নানা রকম সামরিক, অসামরিক এবং কূটনৈতিক বাঁধা তৈরি করে যাচ্ছে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে আরব বসতিগুলিকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়েছে। তার উপর আমেরিকা ও ইউরোপের নানা দেশ থেকে ইহুদিদের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ডেকে এনে, প্যালেস্তিনীয়দের ঘরবাড়ি দখল করে সেখানে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে প্রায় ৫ লক্ষ ইহুদি দখলদার রয়েছেন। তাদের জন্য প্রায় ১০০টি জনপদ তৈরি করেছে ইজরায়েল। একই সঙ্গে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে প্যালেস্তিনীয়দের আরও জমি দখল করার অভিযান চলছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইজরায়েলের এই আচরণকে ঔপনিবেশবাদ ও মানবতা বিরোধী আচরণ বলে কটাক্ষ করেছে।             

Comments :0

Login to leave a comment