প্রতীম দে
রাষ্ট্রের কি কোনও ধর্ম হয়, জাত হয়?
না।
শাসক নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্রের গায়ে ধর্মের একটা প্রলেপ লাগিয়ে দিতে চায়। তা সে হিন্দু রাষ্ট্র হোক বা ইসলামিক রাষ্ট্র। সে কাজে গোড়াতেই লক্ষ্য বানানো হয় শিক্ষাকে।
কী পড়ানো হবে। কোন ভাষায় পড়ালো হবে সব কিছু ঠিক হয় তখন ধর্মের ভিত্তিতে। সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে তখনকার পাকিস্তান সরকারের নীতির ছায়া দেখা যাচ্ছে আজকের ভারতে।
পূর্ব পাকিস্তান, মানে এখনকার বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হলেও দেশ ভাগে যন্ত্রণা আজও বয়ে বেড়াতে হয়। আজকের বাংলাদেশ, সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে বাঙলাভাষীর সংখ্যা বেশি থাকলেও পাকিস্তান সরকার ১৯৪৮ সালে চেয়েছিল উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করতে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল ওই ভাষাতেই পড়ানো হবে। এমনটাই নিদান দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার।
বাংলা ভাষার দাবিতে ১৯৪৭-৫৬ পর্যন্ত টানা ভাষা আন্দোলন চলেছিল বাংলাদেশে। ২১ ফেব্রুয়ারি, শুধু একদিন, বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন রাস্তায় নেমেছিল তা কিন্তু নয়। মানুষের আন্দোলনের তীব্রতা এমন মাত্রায় পৌঁছায় যে পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করা হয় মিটিং মিছিল। জারি হয় সামরিক শাসন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। রাস্তায় নামলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা। একটাই দাবি উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রীব ভাষা করা যাবে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। এই দাবিকে সমানে রেখে পড়ুয়াদের বিশাল মিছিল ১৪৪ ধারাকে অমান্য করেই এগিয়ে যেতে থাকে।
সেই মিছিল যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে আসে তখন তার ওপর আক্রমণ চালায় পুলিশ। চলে গুলি। রক্তাক্ত হয় ঢাকার রাজপথ। শহীদ হন বাদামতলি কর্মাশিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক। শহীদ হন সালাম, বরকত, আব্দুল, জব্বাররা। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই আলতাফ মেহমুদ লেখেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’।
১৯৫২ সালে ইসলামিক রাষ্ট্র তৈরি করার লক্ষ্যে শাসক যেমন উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। সত্তর বছর বাদে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি করতে নয়া শিক্ষা নীতির মাধ্যমে হিন্দি বা সংস্কৃত ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের ওপর।
২০২০ সালে সংসদে কোনও আলোচনা ছাড়াই নয়া শিক্ষা নীতি পাশ করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। জাতীয় শিক্ষানীতির ১৩ নম্বর পাতার ৪.১১ পয়েন্টে বলা হয়েছে, পঞ্চম শ্রেণি বা খুব বেশি হলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একজন পড়ুয়া নিজের মাতৃভাষা বা স্থানীয় ভাষায় নির্দেশনার মাধ্যমে পড়তে পারবেন। তারপর?
না। মাতৃ ভাষা বা স্থানীয় ভাষায় নির্দেশনার মাধ্যমে পড়ার কোনও সুযোগ থাকবে না। অষ্টম শ্রেণির পর মাতৃ ভাষা শুধুমাত্র একটি ‘ভাষা’ হিসাবে সে পড়তে পারবে, তাও যদি তা সম্ভব হয় তবেই।
উল্লেখ্য রাজ্যে বাংলা নির্দেশনায় যেই স্কুল গুলিতে পড়ানো হয় সেই স্কুলগুলির ভবিষ্যৎ কি হবে? স্কুল গুলি কি বন্ধ করে দেওয়া হবে?
আপাতবিচারে মনে হবে জাতীয় শিক্ষা নীতিতে সব ভাষাকে সমান মর্যাদা দেোয়া হয়েছে। আসল খেলা রয়েছে তিন ভাষা সূত্র (‘Three Language Formula’)’ তে লুকিয়ে। কী বলছে এই ফর্মুলা?
বলা হয়েছে একজন পড়ুয়া তৃতীয় ভাষা হিসাবে ভারতের যে কোনও ভাষাকে বেছে নিতে পারে, এমনকি সে বিদেশি ভাষাও বাছতে পারে। মানে ধরা যাক, বাংলা, ইংরেজি যদি যথাক্রমে প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাষা হয় তবে তৃতীয় ভাষা হিসাবে সে তামিল নিতে পারে বা বিদেশি কিছু নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সে নিতে পারবে না।
কেন?
কারণ সব শ্রেণিতে সংস্কৃত বাধ্যতামূলকও করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতে যে ভাষায় প্রান্তিক, অন্ত্যেজীবী অংশের কোনও অধিকার দেয়নি বর্ণ বিভাজন। বিজেপি আরএসএস’র কাছে জনিশক্ষার প্রসারের থেকে অনেক জরুরি ‘দেবভাষার’ প্রসার।
ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে এই জাল তৈরি করেছে বিজেপি। শিক্ষা নীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ষষ্ঠ এবং অষ্টম শ্রেণিতে ‘এক ভারত, শ্রেষ্ট ভারত’ নামে একটি প্রোজেক্ট করতে হবে পড়ুয়াদের। এই প্রজেক্টে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার সাথে সংস্কৃত এবং অন্যান্য ধ্রুপদি ভাষার সঙ্গে যোগসূত্রের উল্লেখ করতে হবে।
শিক্ষানীতির ৪.১৮ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে, সব শ্রেণির জন্য সংস্কৃত বাধ্যতামূলক। ‘Three Language Formula’ র মাধ্যমে সংস্কৃতকে বাধ্যতামূলক করা হবে। তাহলে তামিল পড়তে ইচ্ছা হলে কেউ পড়তে পারবে না। বিদেশি কোনও ভাষা শিখতে চাইলে কেউ পড়তে পারবে না। বাকি যেই ভাষাগুলি পড়ার কথা বলা হচ্ছে সেগুলি কুমিড় ছানা দেখানোর মতো।
মোদী সরকারের মাধ্যমে আরএসএস’র লক্ষ্য ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ তৈরি করা। যে রাষ্ট্র ধর্মের ভিত্তিতে খেটে খাওয়াকে ভাগাভাগি করবে। কিন্তু বড় মাপের কর্পোরেট মালিকদের নিশ্চিন্ত ছায়া জোগাবে। জোট বেঁধে প্রতিবাদ করা যেখানে অন্যায়। সেই লক্ষ্যে শিশুমনে সম্মতি তৈরির প্রাথমিক ধাপ হলো ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০’।
আজও বারবার তাই রাস্তায় নামতে দেখা যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের।
Comments :0