মুনীব আহমদ খান : পহেলগাম
পহেলগাম থেকে মিনিট পঞ্চাশেকের রাস্তা, অনন্তনাগ জেলার হাপাতনার গ্রামে বুধবার এক শোকের পরিবেশ। বাড়ির এক প্রান্তে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন ৫৫ বছর বয়সি বেবি জান। ‘‘আমার ছেলেটাকে কে ফিরিয়ে দেবে? ওর তো জীবনের এতগুলো বছর বাকি ছিল! ওকে ছাড়া আমরা বাঁচবো কী করে? আমাদের সবকিছু যে তছনছ হয়ে গেল!’’ তাঁকে ঘিরে ধরে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছেন আরও কয়েকজন। মঙ্গলবার পহেলগামের ‘মিনি সুইৎজারল্যান্ডে’ ঘটে যাওয়া নৃশংস হামলায় মারা গেছেন বেবি জানের বড় ছেলে সৈয়দ আদিল হুসেন। প্রতিদিনের মতো এদিনও টাট্টু ঘোড়ায় পর্যটকদের ঘুরিয়ে দু চার পয়সা রোজগারের আসায় আদিল সেখানে যান। দুপুর তিনটে নাগাদ একে-৪৭ হাতে একদল সন্ত্রাসবাদী যখন সেখানে চড়াও হয়ে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে, প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ছুটে গিয়ে তাঁদের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন আদিল। নিমেষের মধ্যে সন্ত্রাসবাদীরা তাঁর দেহ গুলি দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেয়। আদিলের শাহাদত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাশ্মীরিদের প্রতিরোধের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে, শোকের মধ্যেও গর্ব করে বলছে হাপাতনারের বাসিন্দারা।
পহেলগাম মোটর স্ট্যান্ড থেকে মূল রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে ঘন হয়ে ওঠে উইলো-পপলারের জঙ্গল। লিডার নদী এগিয়ে আসে আরো কাছে। তার ধার দিয়েই বন-জঙ্গল ধরে পাহাড়ি রাস্তা উঠে যায় বৈসরনের দিকে। সেখানে গাড়ি যায় না। পায়ে হেঁটে আর টাট্টু ঘোড়ায় যাওয়া ছাড়া অন্যপথ নেই। ঝরনা, ঝোরা, জঙ্গল, পাহাড় পেরিয়ে বৈসরন উপত্যকা ‘মিনি সুইজ্যারল্যান্ড’ নামে পরিচিত। সন্ত্রাসবাদী হামলা হওয়ার পরে ছয় কিলোমটারের বেশি এই পাহাড়ি পথ ধরে জখম পর্যটকদের ঘাড়ে, কাঁধে চাপিয়ে ছুটে এসেছেন আদিলের মত পহেলগামের আরও অনেকই। যাঁরা গাইড বা ঘোড়াওয়ালা হিসেবে নিয়ে গেছিলেন পর্যটকদের। স্থানীয় হাসপাতালে তাঁরাই পৌঁছেছেন। জখমদের রক্তও দিয়েছেন। এমনকি অনন্তনাগ বা শ্রীনগরের হাসপাতালেও অ্যাম্বুল্যান্সে করে ছুটেছেন তাঁরাই। যাঁরা পরিজন হারিয়েছেন, বা ঘটনার আকস্মিকতায় ভেঙে পড়েছেন তাঁদের খাবার, জল দিয়েছেন। আশ্বস্ত করেছেন।
আদিলের পরিবারে চরম দারিদ্র্য। অপুষ্টি সহ আরও নানা রোগে দিনকয়েক আগেই তাঁর একরত্তি মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। স্থায়ী কাজই নেই জমমু-কাশ্মীরে। স্থানীয় এক টাট্টু ঘোড়ার মালিকের অধীনে দিহাড়ি কাজ নেন আঠাশ বছরের আদিল। পহেলগামের বৈসরন সহ দক্ষিণ কাশ্মীরের আরও বিভিন্ন জায়গায় পর্যটকদের টাট্টু চড়িয়ে দিনের শেষে মালিকের থেকে যে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা মজুরি পেতেন, তাতেই তাঁদের সংসার চলতো। শীতের সময় পর্যটকদের ভিড় একটু কমলে, গ্রামের আরও কয়েকজনের সঙ্গে আদিল জম্মুতে দিনমজুরি করতে যেতেন। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে আদিল কাশ্মীরে আসা ‘মেহমান’-দের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় একবারও ভাবেননি, তাঁর জীবন গেলে ভেসে যাবে গোটা পরিবারটাই। সন্ত্রাসবাদী হত্যাকাণ্ডকে যারা ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখছেন, সেই ধর্ম-ব্যবসায়ীরা কী বুঝবে আদিলের জীবনের মূল্য!
আদিলের পিসি কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, আজ শুধু ইনসানের মৃত্যু হয়নি। শুধু মানুষ মরেনি। কাশ্মীরিয়তেরও মৃত্যু হয়ে গেছে। আদিলের জন্যেই শুধু চোখের জল নয় তাঁর। বলেছেন, ওখানে যে হিন্দুস্তানি ভাইরা মরে গেলেন আমরা তাঁদের জন্যেও কাঁদছি। যে বোনের হাতের মেহন্দির রঙ ওঠেনি, তাঁর জীবনটা শেষ করে দিল। নিরস্ত্র মানুষের উপরে গুলি চালানো উচিৎ হয়নি। সবার জন্যেই কাঁদতে থাকা আদিলের পিসির বিলাপ, আদিলের মৃত্যুর খবরটা হিন্দুস্তানের কোনো নিউজ চ্যানেল করলো না। ওর জীবনের মূল্য কেউ দিলো না। এটাই আমাদের গভীর দুঃখ।
পহেলগামের আরেক জন টাট্টু চালক এবং আদিলের সহকর্মী গোলাম নবী বুধবার জানান,‘‘গোটা ঘটনাটা আমার চোখের সামনেই হয়েছে। ওরা বন্দুক উঁচিয়ে ধরতেই আদিল একবারও না ভেবে ওদের একজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। যাঁদের বাঁচাতে ও নির্দ্বিধায় নিজের প্রাণটা দিল, তাঁদের সঙ্গে ওঁর মোটে কয়েক মুহূর্ত আগেই পরিচয় হয়েছে।’’ নিহত বাকি ২৫ জনের মতোই আদিলের সাহসিকতার প্রশংসায় এবং শাহাদতে শোকপ্রকাশ করেছে গোটা দেশ। ধর্মীয় ও আঞ্চলিক পরিচিতি নির্বিশেষে, বিদ্বেষ ও সন্ত্রাবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির এক অন্যতম ‘আইকন’ হয়ে থাকবেন কাশ্মীরের এই দিনমজুর, মন্তব্য অসাম্প্রদায়িক নেটিজেনদের।
আদিলের মেজো ভাই নওশাদ অনন্তনাগ থেকে পহেলগামের রাস্তায় পর্যটকদের নিয়ে গাড়ি চালান। মাঝে মাঝে তিনি বাড়ি ফিরতে পারেন না। তবে আদিলে রোজ বিকেলের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতেন। মঙ্গলবার বিকেলে তাঁদের বাবা সৈয়দ হায়দর হুসেনকে নওশাদ ফোন করে দাদা ফিরেছে কিনা জিজ্ঞেস করেন। ‘‘আমি তখনই বুঝতে পারি, কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। অনেকক্ষণ ধরেই ওকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। তার কিছুক্ষণ বাদেই পহেলগাম থেকে আমার এক বন্ধু ফোন করে আদিল আহত হয়েছে বলে জানায়। তারপর রাত ১০টা নাগাদ আমরা জানতে পারি ও আর নেই।’’ বুধবার কাঁপা গলায় জানালেন আদিলের বাবা হায়দর। ‘‘আমার ছেলেকে যারা মারলো, আমি তাদের শেষ দেখতে চাই। এই মৃত্যু যেন বৃথা না হয়।’’ বলেছেন হায়দার।
বুধবারে আদিলের জানাজায় তাঁকে শেষ বিদায় জানাতে উপস্থিত হয় গোটা গ্রাম, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন থেকে নানা বিশিষ্টজন। তবে তাঁদের এই শোকপ্রকাশ কেবল আদিলের জন্যে সীমিত নেই। ‘‘আমরা কেবল আদিলের মৃত্যুতে শোকাহত নই। কালকের এই নৃশংস হামলায় যে সমস্ত পর্যটকদের মেরে ফেলা হলো, এই জানাজায় আমরা তাঁদের জন্যেও চোখের জল ফেলছি। গোটা কাশ্মীর তাঁদের জন্য কাঁদছে। যারা এই জঘন্য অপরাধ করেছে, তারা যতক্ষণ না শাস্তি পাচ্ছেন সরকারের ততক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া উচিত নয়।’’ সংবাদমাধ্যমকে এমনই জানিয়েছেন আদিলের পিসি খালিদা পারভিন। একথা বলে খালিদা আদিলের স্ত্রীকে দেখিয়ে বললেন,‘‘এটুকু মেয়ে, এই তো সেদিন বরের সঙ্গে এ বাড়িতে এলো। এখন স্বামীর লাশের জন্য অপেক্ষা করছে।’’
আদিলের কাকা শাহীদ বাগ সিং বলেন,‘‘ও এই পরিবারের বড় ছেলে। ওর স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এখন কোথায় যাবে। ওরই তো এই পরিবারের মেরুদন্ড হওয়ার কথা ছিল। এখন আমাদের সবকিছু হারিয়ে গেছে। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, ওদের এই অপূরণীয় ক্ষতির যথার্থ ক্ষতিপুরণ দেওয়া হোক।’’ আদিলের গ্রামের বাসিন্দা এবং তাঁদের আত্মীয় মহিদ্দিন শাহ বলেন,‘‘আমরা সবাই এই এলাকাতেই থাকি। আদিলকে (আদিল) আমরা ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি। ও আামদের সবার ঘরেরই ছেলে। মনে হচ্ছে যেন আমার ঘরের ছেলেটাকে খুন করা হয়েছে। এই হামলা আমাদের ‘কাশ্মীরিয়তের’ উপর হামলা। ওর এই শাহাদত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাশ্মীরিদের প্রতিরোধের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে। ও জীবন দিয়ে জিন্দা রাখলো কাশ্মীরিয়তকে। এইটুকুই স্বস্তি’’। আদিলের জানাজায় বুধবার জম্মু কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা উপস্থিত ছিলেন। সমাজ মাধ্যম ‘এক্স’-এ তিনি এই প্রসঙ্গে লেখেন,‘‘আদিলকে শেষ বিদায় জানাতে আজ পহেলগামে পৌঁছেছিলাম। ওঁর সাহসিকতা আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’’
Syed Adil Hussain
বেঁচে আছে কাশ্মীরিয়ত, জীবন দিয়ে দেখালেন আদিল

×
Comments :0