সৌরভ গোস্বামী
মাতৃভাষা দিবস বলতে আমরা হয়তো কেবলই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথাই বুঝি। কিন্তু মাতৃভাষার দাবীতে আন্দোলন শুধুই বাংলাদেশেই হয়নি। আসাম, ত্রিপুরাতেও হয়েছে। হয়েছে মানভূমেও।
আসামের বরাক উপত্যকায় এই আন্দোলন ছিল অসমীয়া ভাষাকে সরকারি কাজকর্মে আনুষ্ঠানিক ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। ওই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই ছিলেন বাংলাভাষী। এই আন্দোলন করতে গিয়ে ১১ জন শহীদ হন।
১৯৬০ সালে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নেয় গোটা রাজ্যে কেবল অসমিয়া ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হবে। প্রতিবেশী পূর্ব পাকিস্তানে মাতৃভাষার দাবিতে এবং উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে চেতনায় সমৃদ্ধ বরাকের বাঙালিরাও প্রতিবাদে শামিল হন। শুরু হয় ভাষার দাবিতে আন্দোলন। বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে গোটা বরাকজুড়ে শুরু হয় আন্দোলন।
এই আন্দোলনকে গুরুত্ব না দিয়ে কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বিমল প্রসাদ চালিহা ১০ অক্টোবর বিধানসভায় বিল আনেন। তার উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র অসমিয়া ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া।
অন্যদিকে অসমিয়াদের মধ্যে তীব্র বাঙালি বিদ্বেষ শুরু হয়। বাড়তে থাকে বাঙালি বিদ্বেষ। তার পিছনে রাজনৈতিক ইন্ধনই কাজ করেছিল। আক্রমণ নেমে আসে বাংলা ভাষীদের ওপর। বাড়তে থাকে অসম সরকারের দমন-পীড়নও। পুলিশ, আধা-সেনা নামিয়ে আন্দোলন দমানোর সব রকম চেষ্টা শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয় – এই অজুহাতে জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারও এই বিষয়ে নীরব থাকে।
১৯৬১’র ৫ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় কাছাড় গণসংগ্রাম কমিটি। বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন পায় নতুন গতি। ১৪ এপ্রিল বরাকের কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে পালিত হয় সংকল্প দিবস। ১৩ এপ্রিল গণসংগ্রাম কমিটির নেতা রবীন্দ্রনাথ সেন ১৯ মে ১২ ঘণ্টার হরতালের ডাক দেন। ১৯ মে’র আগে থেকেই নিরাপত্তা বাহিনীতে ছেয়ে যায় বরাক উপত্যকা।
১২ মে থেকেই সেনা কমান্ডে আসাম রাইফেলস জওয়ানেরা ফ্ল্যাগ মার্চ শুরু করে। ১৮ মে গ্রেপ্তার হন রবীন্দ্রনাথ সেন, নলিনীকান্ত দাশ, বিধুভূষণ চৌধুরীসহ ভাষা আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারা। ১৯ মে শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে শুরু হয় পিকেটিং। অহিংস এই হরতালে পুলিশ লেলিয়ে নির্মমভাবে দমন করা হয় এই আন্দোলন। বিনা প্ররোচনায় নিরাপত্তারক্ষীরা ১৭ রাউন্ড গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন ৯ ভাষা আন্দোলনকারী। পরে হাসপাতালে আরও দু’জনের মৃত্যু হয়। জখম হন আরও একজন।
বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে যে ১১ জন শহীদ হন তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমলা ভট্টাচার্য। একই সাথে কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকমল পুরকায়স্থ শহীদ হন।
এই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আরও ২৪ বছর বেঁচে ছিলেন কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস। এই আন্দোলনের পর বাংলা ভাষা বরাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।
Comments :0