স্বর্ণেন্দু দত্ত: বাধারঘাট
ছেলের কথা উঠতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন শিউলি পাল। আগরতলার গায়েই বাধারঘাটের ক্যাম্পের বাজারের দোতলা বাড়িটা থেকে এখন শুধুই কান্নার রোল। বছর পঁচিশের ছেলে চয়ন মাদকের নেশায় মাস দু’য়েক ধরে নিখোঁজ। এমনকি বামফ্রন্ট প্রার্থী প্রচারে এলে তাঁর হাত দু’টো ধরে অসহায় মা একটাই আর্তি জানিয়েছেন, ‘আপনারা আইস্যা রাজ্যটারে নেশমুক্ত করেন। আমার ছেলের মতো আর যেন কারো সর্বনাশ না হয়।’
চয়নের বাবা চন্দ্রশেখর পাল বললেন, ‘বিজেপি আইসা নেশার আগরতলা বানাইসে।’ জানালেন, তাদের এলাকায় মাদকের নেশা ছড়ানোর মূলে গৌতম সরকারের গ্যাঙ। বিজেপি’র বাইক বাহিনীর নেতা। স্থানীয় মণ্ডল আর পুলিশের সঙ্গে সরাসরি যোগসাজশ আছে। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে ছেলের ছবি বের করে কান্না ধরা গলায় বললেন, নেশায় সব শেষ। কাপড়ের দোকান আমাদের। দোকানের, ঘরের যেখানে যা টাকাপয়সা, বাইক বিক্রি করে ছেলে সব নেশায় ঢেলেছে। এমনকি কলকাতায় যাদের থেকে কাপড় আনি তাদের থেকে, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সকলের থেকেই নানা মিথ্যা বলে টাকা নিয়েছে নেশা করার। মানসম্মান কিছুই আর নেই আমাদের। চোখ মুছে বললেন, ‘এই ড্রাগ কারবারিরা ডরাইতো বামফ্রন্ট সরকারকে। এরা তো ঘরে ঘরে ছড়াইয়া দিসে।’
এলাকার মানুষ জানালেন, গুঞ্জরিয়া, গদারিয়া, লক্ষ্মীপুর ছেয়ে গেছে মাদকের কারবারে। কারবারীরা এতটাই বেপরোয়া যে ওইসব এলাকায় গেলেই কৌটো করে ‘অফার’ করে মাদক। শৌচালয়গুলি হয়েছে মাদক সরবরাহের জায়গা। এমবি টিলা থেকে আগরতলার বটতলা রুটের অটোচালক রতন দেবনাথ বললেন, ফ্লাইওভারের তলায় প্রকাশ্যে মাদকের কারবার চলছে। সক্কলে জানে, পুলিশ জানে না? অটোর এক সওয়ারির সংযোজন, জিবি হাসপাতাল, ক্যানসার হাসপাতালের মধ্যেই চলছে কারবার। যেখানে যাবেন, সেখানে নেশা এখন রাজ্যে। শেষের জায়গাগুলি সবই মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহার বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যেই। চয়নদের বাড়ি থেকে সোজা গেলেই গজারিয়া সীমান্ত। বাংলাদেশ থেকে আসে মাদক। পুলিশ-বিএসএফ-র সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া এটা সম্ভব না।
শিউলি পাল সুনির্দিষ্ট করে অভিযোগ করলেন, বর্মণ টিলা, তিনমুড়া এলাকায় ঘরে ঘরে ড্রাগের ব্যবসা করা হচ্ছে। মহিলারা এইসব কাজের সঙ্গে যুক্ত। এমনই একজন একাদশী বর্মণের বাড়ি থেকে একবার মাদকাসক্ত ছেলেকে নিয়ে এসেছেন তিনি। এ ডি নগর থানায় গেছি মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে, তারা বলেছে এটা আমতলি থানার ঘটনা সেখানে যান। এইভাবে ঘোরাঘুরির পরে আমি মহিলা থানাতেও গেছি। কোনও সমাধান পাইনি।
শনিবার রাজ্যে ভোট প্রচারে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। উত্তরের আমবাসা আর দক্ষিণের উদয়পুরে দুই জনসভা। শিউলি পালের কথোপকথনের মাঝেই হেলিকপ্টারের আওয়াজে ফুঁসে উঠলেন মা, ‘প্রধানমন্ত্রী তো অনেক বড় বড় কথা কইতাসেন। একটা ছেলেরও ভালো করলে তাইলে বুঝুম। আমার ছেলে তো গেসে। এই যোজনা সেই যোজনা কইতাসেন। এর থিকা বেকার ছেলেদের কাজ দিত, তাইলে না বুঝতাম প্রধানমন্ত্রী কামের কাম করতাসেন। পোলাপান তো সব শেষ। পোলাপানের ভবিষ্যৎ শেষ।’ কাঁদতেই থাকলেন লাপতা ছেলের মা। মায়ের বুকফাটা কান্নায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মোদীর কপ্টারের আওয়াজও।
যুব আন্দোলনের স্থানীয় নেতা রাজেশ শুর বললেন, চাকরি, কাজ কিছু নেই রাজ্যে। গতবার ভোটের সময় থেকে এইরকম অনেক ছেলেকে বিজেপি সঙ্গে নিয়েছিল প্রলোভন দিয়ে। তারপর তাদের মদ-মাদকের নেশায় শেষ করেছে। বাইক বাহিনীর সবাই তো দুষ্কৃতী না, ভদ্রঘরের ছেলেপিলে। তাদের নেশায় বুঁদ করে পাঠিয়েছে হামলা করতে, পার্টি অফিসে আগুন দিতে, ভোট লুট করতে।
দাস পাড়ার বাসিন্দা আরেক প্রৌঢ়েরও একই অবস্থা। সোজাসুজি বললেন, গতবার ভোট দিয়েছিলাম বিজেপি’কে। এখন ছেলে রাতে ঘরে থাকে না। সিরিঞ্জে ইঞ্জেকশন নেয়। প্রায় ঘরে এক অবস্থা। তাঁর সরাসরি অভিযোগ, বিশ্বজিৎ ভৌমিক ত্রিপুরার সবথেকে বড় মাদক কারবারী। তার দিদির জন্য পুলিশ তার কিছু করে না। এই টাকা বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের ওপরতলা পর্যন্ত যায়।
মোদীর মন্ত্রী প্রতিমা ভৌমিকের ভাই বিশ্বজিৎ ভৌমিক। বাধারঘাট ছাড়াও আগরতলা, সোনামুড়ার-যে কোনও জায়গায় মুখে মুখে তার নাম মাদক কারবারি হিসেবে শোনা যায়। বিজেপি সরকার আসার এক-দেড় বছরের মধ্যেই বিশালগড়ের এক মাদক কারবারিকে ধরে আদালতে তোলার সময়ে সে মিডিয়ার সামনে সরাসরি অভিযোগ করেছিল বিশ্বজিৎ ভৌমিকের নামে। তখন যদিও প্রতিমা ভৌমিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন না। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ভাই বলেই পুলিশ-বিএসএফ-র সঙ্গে যোগসাজশে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অবাধে মাদকের কারবার চলছে, এমনই অভিযোগ মানুষের। এমনকি বাংলাদেশ থেকে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে যেসব পণ্য আসছে, তার একটা অংশের দাম মেটানো হচ্ছে নাকি মাদকে! এমন গুরুতর অভিযোগ আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের পক্ষ থেকে গত অক্টোবর মাসে ঢাকায় জানানো হয়েছে বলে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলিতে খবর হয়। তার পরিপ্রক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রকও খতিয়ে দেখছে।
অভিযোগ প্রমাণ হবে কী করে? প্রশাসন তো সবটাই তাদের সাথে। বললেন, বাধারঘাটের বেলাবর পঞ্চায়েতের বাসিন্দা মিঠুন দাস। মোবাইলের দোকানি বললেন, মুখ্যমন্ত্রীই তো স্বীকার করেছেন, ত্রিপুরা ড্রাগের করিডর হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা বলেছেন, মায়ানমার থেকে মাদক ত্রিপুরা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিধানসভাতেও সরকার তথ্য দিয়ে জানিয়েছে, সিরিঞ্জ দিয়ে মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০১৮-১৯ সালে রাজ্যে ছিল ৭১৯ জন। গত বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেই সংখ্যা ৪৪৮৮ জন। রাজ্যে এইডস রোগীর সংখ্যাও ওইসময়ে ৩৩ থেকে পৌঁছেছে ৩৫৭। মনে করা হচ্ছে, একই সিরিঞ্জে অসুরক্ষিতভাবে মাদক গ্রহণ এই বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
ভোটের মুখেও বিএসএফ মাদক উদ্ধারের কথা জানিয়েছে। যদিও আগরতলার এক পরিচিত সাংবাদিকের অভিমত, এটা পুরোটাই লোকদেখানো। নেশামুক্ত ত্রিপুরার স্লোগান দিয়েছিল বিজেপি। উলটে নেশাযুক্ত ত্রিপুরা তৈরি করেছে। এখন ভোটের সময় লোক দেখাতে মাদক উদ্ধারের গল্প চলছে। যে পরিমাণ উদ্ধার বলে দেখানো হচ্ছে, তা একশো ভাগের একভাগ মাত্র।
Comments :0