‘কিংমেকার’ হতে গিয়েছিলেন। এখন নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে রাখতে, দল বাঁচাতে ল্যাজেগোবরে অবস্থা তিপ্রা মথা প্রধান প্রদ্যোৎ কিশোরের। বুধবার ত্রিপুরায় দ্বিতীয়বার শপথ গ্রহণ করেছে বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকার। সেই সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পরেই অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক বসলেন প্রদ্যোৎ কিশোর। জানা গেছে, শপথের আগের দিন মঙ্গলবার রাতেও দীর্ঘক্ষণ আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন তথাকথিত বুবাগ্রা। কোনোরকমভাবে একটা সম্মানজনক রাস্তা খুঁজে বিজেপি সরকারে যোগ দিতে এখন মরিয়া প্রদ্যোৎ কিশোর। বিজেপি’ও সেই কারণে এদিন তিনটি জায়গা ফাঁকা রেখেছে। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা সহ শপথ নিয়েছেন ৯ জন মন্ত্রী।
ভোটের ফল সামনে আসার পর থেকেই বিজেপি’র প্রতি ক্রমাগত বার্তা পাঠিয়েছেন মথা প্রধানের। তিপ্রাল্যান্ড বা গ্রেটার তিপ্রল্যান্ডের দাবি উধাও হয়েছে। এখন শুধু বলছেন সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে ‘সম্মানজনক’ সমাধানের কথা। এডিসির জন্য সরাসরি কেন্দ্র থেকে অর্থ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি বা তিপ্রাসাদের দাবি খতিয়ে দেখতে ইন্টারলোকেটর নিয়োগ করার মতো কোনো একটি দাবি আদায় হলেই ‘সম্মানজনক’ সমাধান হয়েছে বলে সরকারে ঢুকে পড়তে চাইছেন মথা প্রধান। বিজেপিও এই সুযোগে ল্যাজে খেলাচ্ছে প্রদ্যোৎকে, এমনই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। ভোটের ফল প্রকশের পর থেকেই আলোচনা চলছে মথাকে ভাঙানো বিজেপি’র শুধু সময়ের অপেক্ষা। বলা ভালো বিশেষ সময়ের জন্য অপেক্ষা করছে বিজেপি। অনেকের মতে যেভাবে আইপিএফটি-কে আলাদা রাজ্যের দাবি খতিয়ে দেখা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজেদের সঙ্গে টেনে পুরোটাই গিলে ফেলেছে বিজেপি, সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে মথার ক্ষেত্রেও। এই অবস্থায় দল বাঁচাতে মরিয়া প্রদ্যোৎ।
এদিকে নিচুস্তরের মথা কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে মাটিতে বিজেপি’র সন্ত্রাস, আক্রমণ মোকাবিলা করে লড়াই করে যাচ্ছেন। এমনকি বিজেপি’র আক্রমণ থেকে বাঁচতেই বহু উপজাতি মানুষ মথায় গিয়েছেন। ভোট গণনার সময়ে এবং ভোটের ফলপ্রকাশের পরেও বিভিন্ন জায়গায় বিজেপি কর্মীদের সঙ্গে সঙ্ঘাতে জড়িয়েছেন মথা কর্মীরা। বিজেপি সরকারে যেতে হলে তিপ্রাসাদের জন্য একটা কিছু ‘আদায়’ হয়েছে এটা বোঝাতে হবে ‘বুবাগ্রা’কে। সেই অঙ্কই কষা চলছে। এদিনের বৈঠকের পরে প্রদ্যোৎ কিশোর একটি টুইট করে বলেছেন, ত্রিপুরার আদিবাসীদের সাংবিধানিক সমাধানের জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। একজন ইন্টারলোকেটর নিয়োগ করা হবে এই প্রক্রিয়ার জন্য এবং সেটা হয়ে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহকে ভূমিপুত্রদের প্রকৃত সমস্যা বোঝার জন্য ধন্যবাদও জানিয়েছেন তিনি। এই প্রসঙ্গে ব্রু-দের নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে, তাকে তুলে ধরে নিজের দাবিকে মান্যতা দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন।
ত্রিপুরায় বিজেপি জোট সরকারের দ্বিতীয়বারের শপথ অনুষ্ঠান ছাপিয়ে প্রদ্যোতের প্রসঙ্গই মুখ্য হয়ে উঠেছে এদিন। তার অন্যতম কারণ হলো, দ্বিতীয়বার জয়ী হয়ে আসার পরেও শপথ সমারোহে কার্যত কোনো উচ্ছ্বাস, আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছিল না। এদিন স্বামী বিবেকানন্দ ময়দানে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী সহ ৯ জন ক্যাবিনেট মন্ত্রী শপথ গ্রহণ করেন। পাঁচ বছর আগের শপথ সমারোহের সঙ্গে আকাশ-পাতাল তফাৎ চোখে পড়েছে মানুষের। বিজেপি কর্মীদের আশা ছিল প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালের মত এবার জোশের সঙ্গে কিছু বলবেন। কিন্তু তাদের হতাশ করে শপথ শেষ হতেই মঞ্চ ছাড়েন প্রধানমন্ত্রী।
তখনও মানুষ বুঝতে পারছিলেন না তাঁরা বসবেন না উঠে যাবেন। এদিন বেলা ১১ টা ৯ মিনিটে বিবেকানন্দ ময়দানের মঞ্চে এলেন প্রধানমন্ত্রী। আর ১১ টা ৩০ বাজার আগেই চলে গেলেন। রাজ্যে বিভিন্ন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান ৩০-৩৫ বছর ধরে দেখছেন এমন অনেক সাংবাদিক এদিনও হাজির ছিলেন। কিন্তু পুরানো স্মৃতির সঙ্গে মেলাতে পারছিলেন না স্থানীয় থেকে জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিকরা। বিজেপি জোট সরকারের দ্বিতীয় মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দেখা মেলেনি লেখক সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সহ সমাজের প্রতিষ্ঠিত নাগরিকদের। এমনকি সংবাদপত্রের সম্পাদকদের জন্য পাতা চেয়ারগুলিও ছিল খালি। বিজেপি ছাড়া অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা সহ প্রতিনিধিও এলেন না বিবেকানন্দ ময়দানের শপথে। রাজ্যজুড়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের কারণে শপথ অনুষ্ঠান বয়কটের কথা আগেই জানিয়ে দিয়েছিল বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের আমন্ত্রণ থাকলেও তিনিও যাবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন একই কারণে।
কুড়ি মিনিটেই শেষ হয় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ মানিক সাহা ছাড়াও মন্ত্রীসভার আরও ৮ জন সদস্য রতনলাল নাথ, প্রণজিৎ সিংহ রায়, সান্ত্বনা চাকমা, সুশান্ত চৌধুরি, টিঙ্কু রায়, বিকাশ দেববর্মা, সুধাংশু দাস ও শুক্লাচরণ নোয়াতিয়া শপথ গ্রহণ করেন। তাঁদের শপথ বাক্য পাঠ করান রাজ্যপাল সত্যদেও নারাইন আর্য। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মুখ্যসচিব জে কে সিনহা।
দ্বিতীয় বিজেপি-আইপিএফটি মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের গেরুয়া ও সবুজে সাজানো মঞ্চে অতিথি হয়ে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপি’র জাতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং, অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী প্রেমা খাণ্ডু, সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী প্রেমসিং তামাং সহ শাসক দলের নেতা ও রাজ্যের সাংসদরা। প্রথমেই শপথ গ্রহণ করেন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ মানিক সাহা। তিনি বাংলায় শপথ নেন। রতনলাল নাথ, প্রণজিৎ সিংহ রায়, সান্ত্বনা চাকমা, টিঙ্কু রায়, বিকাশ দেববর্মা, সুধাংশু দাসও বাংলায় শপথ গ্রহণ করেন। সুশান্ত চৌধুরি শপথ নেন হিন্দিতে ও আইপিএফটি’র শুক্লাচরণ নোয়াতিয়া ককবরকে শপথ গ্রহণ করেন। নতুন মন্ত্রীসভায় স্থান পেলেন না আবারও বিধায়ক হয়ে জিতে আসা রামপদ জমাতিয়া, রামপ্রসাদ পাল, মনোজ দেব এবং ভগবান চন্দ্র দাস। এরা আগে মন্ত্রী ছিলেন। নতুন করে এবার প্রথম মন্ত্রী হলেন টিঙ্কু রায়, বিকাশ দেববর্মা, সুধাংশু দাস এবং শুক্লাচরণ নোয়াতিয়া।
Comments :0