নিয়োগ দুর্নীতির কারণে আদালতের নির্দেশে গ্রুপ-সি পদের যে ৮৪২জন শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়েছে তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই তৃণমূল নেতার পরিবারের লোকজন। শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশের পর রাজ্যের জেলায় জেলায় বিভিন্ন স্কুলে এই ভুয়ো শিক্ষাকর্মীদের হদিশ পাওয়া গিয়েছে। শনিবার প্রকাশ্যে চলে এসেছে এই নিয়োগ দুর্নীতিতে কীভাবে যুক্ত তৃণমূল নেতা-নেত্রীদের ঘরের লোকজনেরা। বাদ নেই বিধায়ক, নেতারা।
মিনাখার তৃণমূল বিধায়ক উষারানি মণ্ডলের মেয়ে বিনতা মণ্ডলের চাকরি বাতিল হয়েছে। বেলঘরিয়া নন্দননগর আদর্শ উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের গ্রুপ সি-র শিক্ষাকর্মী ছিলেন বিনতা। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রূপালি দে শনিবার বলেন, “এই সপ্তাহে মঙ্গল-বুধবার দোলের ছুটি ছিল। বৃহস্পতিবার পারিবারিক অনুষ্ঠানের জন্য ছুটি নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শুক্রবার এসেছিলেন। ডিএ’র দাবিতে যৌথ মঞ্চের ধর্মঘট নিয়ে রাজ্য সরকার নির্দেশিকা জারি করেছিল সবাইকে আসতে হবে। ধর্মঘট বিরোধিতা করে বিনতা গতকাল এসেছিলেন। আজ শনিবার আসেননি।
২০১৮ সালের এপ্রিলে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন বিনতা। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বলেন, ‘যেদিন বিনতার জয়েনিং ছিল সেদিন তাঁর মা তথা বিধায়ক ঊষারানি মণ্ডল মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে এসেছিলেন। বিনতা বিয়ের পর বারুইপুরে থাকেন। সেখান থেকেই স্কুলে যাতায়াত করতেন। গোটা ঘটনা নিয়ে মুখে কার্যত কুলুপ এঁটেছেন বিধায়ক উষারানি মণ্ডল। ফোন ধরছেন না। দলের কেউ কেউ বলছেন তিনি বিধানসভা অধিবেশনের জন্য কলকাতায় রয়েছেন।’’
বালুরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত দুই শিক্ষাকর্মীর নাম ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ভুয়ো করনিকের তালিকায় থাকায় চাঞ্চল্য ছড়ায়। কয়েক মাসের ব্যবধানে বালুরঘাটে প্রাচ্যভারতী বিদ্যানিকেতনে ভুয়ো শিক্ষিকা, বালুরঘাট বালিকা বিদ্যালয়ে গ্রুপ ডি এবং সম্প্রতি গ্রুপ সি’র পদে বালুরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের করনিক পদে কর্মরতদের ভুয়ো তালিকায় নাম রয়েছে বলেই জানা গিয়েছে। অপরদিকে খাদিমপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে তিন বছর চাকরি করার পর বর্তমানে দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুর নারায়ণপুর বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে করনিক পদে কর্মরত ভুয়ো শিক্ষাকর্মীর নাম রয়েছে।
আর্থিক লেনদেনের পরিপ্রেক্ষিতে ভুয়ো নিয়োগ নিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার রাজনীতি এখন সরগরম। রাজ্য জুড়ে শাসক তৃণমূলের নেতা মন্ত্রীদের আত্মীয়স্বজনের অবৈধ চাকরি খারিজের খবরে যখন তুমুল চর্চা, ঠিক সেই সময় এবার চাকরি হারালেন বাগদার বিজেপি নেতা দুলাল বরের মেয়ে বৈশাখী বর। বারাকপুরের নগেন্দ্রনাথ স্মৃতি শিক্ষা নিকেতন ফর গার্লসে চাকরি করতেন বৈশাখী। তাঁর বাবা দুলাল বরের মাধ্যমে বাগদার চন্দন মণ্ডলের হাত ধরে টাকার বিনিময়ে চাকরি পেয়েছেন বলে স্থানীয় তৃণমূল নেতা সঞ্জিত সরদার দাবি করেছেন।
তার আরও দাবি চন্দনের মাধ্যমে চাকরি দেওয়ার নাম করে দুলাল মিডলম্যানের কাজ করতেন এবং তিনিও প্রচুর পরিমাণে টাকা তুলেছেন। তৃণমূল সুর চড়ালেও স্বস্তিতে নেই বনগাঁ এলাকার তৃণমূল। চাকরি বাতিলের তালিকায় রয়েছেন বয়রা গ্রাম পঞ্চায়েতের দু’বারের বিজয়ী তৃণমূল সদস্য ক্ষিতিশ দাসের ছেলে সন্তু দাসের নাম। এসএসসি’র ও এমআর শিট অনুযায়ী মাত্র দু’টি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তিনি সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি ছেড়ে বাগদারই চরমণ্ডল ফুলমোহন বিদ্যাপীঠের ক্লার্ক হিসাবে যোগদান করেন। তৃণমূল ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী চন্দনকে টাকা দিয়েই সন্তুর চাকরি হয়েছিল।
বনগাঁ মহকুমার রামশঙ্করপুর হাই স্কুলের আজাহারউদ্দিন মোল্লা, ঢাকুরিয়া বালিকা বিদ্যালয়ের বানী বিশ্বাস, হেলেঞ্চা হাই স্কুলের মনোজ মল্লিক, রানিহাটি হাই স্কুলের তনুশ্রী মণ্ডল, চাঁপাবেড়িয়া হাই স্কুলের তাপস বিশ্বাস, কেউটিয়াপাড়া জে এন রায় হাই স্কুলের টিঙ্কু পোদ্দারেরও নাম আছে চাকরি বাতিলের তালিকায়। স্বস্তিতে নেই বনগাঁ এলাকার তৃণমূল। চাকরি বাতিলের তালিকায় রয়েছেন বয়রা গ্রাম পঞ্চায়েতের দুবারের বিজয়ী তৃণমূল সদস্য ক্ষিতিশ দাসের ছেলে সন্তু দাসের নাম। এসএসসি’র ও এম আর শিট অনুযায়ী মাত্র দু’টি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তিনি সিভিক ভলিন্টিয়ারের চাকরি ছেড়ে বাগদারই চরমণ্ডল ফুলমোহন বিদ্যাপীঠের ক্লার্ক হিসাবে যোগদান করেন। তৃণমূল ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী চন্দনকে টাকা দিয়েই সন্তুর চাকরী হয়েছে স্বীকার করেন সন্তুর মা।
বনগাঁ লাগোয়া গোবরডাঙা কলেজিয়েট হাই স্কুলের অভিনন্দন সাহা, রাজবল্লভপুর হাই স্কুলের স্বর্ণালী মণ্ডল, লক্ষ্মীপুর স্বামীজী সেবা সংঘের রাজীব চৌধুরির মতো অসংখ্য নাম রয়েছে বাতিলের তালিকায়। রাজারহাটের সিপিআই(এম) নেতা শুভজিৎ দাশগুপ্ত জ্যাংড়া আদর্শ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককের কাছে দেখা করে জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মী ইসরাফিল মণ্ডলের নাম ভুয়ো তালিকায় সিরিয়াল নং ২৫০ রয়েছে।
জেলায় বিভিন্ন স্কুলে এখন পর্যন্ত ভুয়ো তালিকায় যে নামগুলি রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, বারাসত ২৯ নং ওয়ার্ডের তৃণমূলের প্রাক্তন কাউন্সিলর বিবেকানন্দ আদর্শ বিদ্যাপিঠের দোলন বিশ্বাস (২১৮), মধ্যমগ্রাম আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের মিষ্টি ঘোষ (৩৫৬), বামনগাছি ভোলানাথ হাই স্কুলের আবদুল ওদুত মণ্ডল (৪), গুমা রবীন্দ্র বিদ্যাপিঠের অমিত কুমার ঘোষ (২৭), নীলগঞ্জ শিক্ষায়াতন হাইস্কুলের বিলাশ বিশ্বাস (১৩৬), বরানগর মায়াপিঠ নারী শিক্ষা আর্শমের গোপাদত্ত বর্মণ (২২৯), কামারহাটি চিত্তরঞ্জন হাই স্কুলের হাসনাতারা খাতুন (২৪৬), হালিশহর মল্লিকবাগ হাই স্কুলের মনোতোষ সাউ (৩৪০), সোদপুর সুশীলকৃষ্ণ বালিকা বিদ্যালয়ের মালা চক্রবর্তী (৩২০), লেকটাউন গভঃ স্পনসর গার্লস হাইস্কুলের মালবিকা চক্রবর্তী (৩২৫), গোপালনগর হাইস্কুলের মৌমিতা জানা ( ৩৭৮), দমদম সর্বদয় বিদ্যাপিঠের প্রবীর নস্কর (৪৪৮), সোদপুর চন্দ্রচুর বিদ্যাপিঠের রঘুনাথ সরকার (৪৮৭), বিনীতা মণ্ডল (১৪১) বেলঘরিয়ার নন্দননগর আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়, ঘোলা উচ্চবিদ্যালয়ের সায়ন্তনী দাশগুপ্ত (৫৯৭)।
ভুয়ো নিয়োগের ব্যাপারে এবিটিএ’র কোচবিহার জেলা সম্পাদক সুজিত দাস এদিন বলেন, প্রাথমিকভাবে যতদূর খবর মিলছে তাতে জেলার ২২টি স্কুলের মোট ২৩ জন চাকরি চুরি করেছে। পুরো তালিকা এলে সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। অবশ্য জেলা শিক্ষা দপ্তর সোমবার স্পষ্ট করে বলতেই রাজি হয়নি।
কোচবিহার জেলার ২২টি স্কুলের ২৩ জন শিক্ষাকর্মীর নাম। তবুও কেন জেলা শিক্ষা দপ্তর জেলায় কাদের চাকরি চলে গেল সেটা নিয়ে মুখ খুলে কিছু বলতেই রাজি নন।
যাদের চাকরি চলে গেছে তাদের মধ্যে রয়েছেন কোচবিহার জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষের বোনের নাম, একইভাবে রয়েছে জেলার শীতলকুচি ব্লকের গোলেনাওহাটি গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামী, মাথাভাঙা ২নং ব্লকের তৃণমূল নেতা সহ শাসক দল ঘনিষ্ঠ এবং শাসক দলের নেতাদের আত্মীয় পরিজনের নামও। কোচবিহার ঘোকসাডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরিরতা কোচবিহার জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ অশোক রায়ের বোন যুথিকা রায়।
কোচবিহার কাটামারি হাইস্কুলে শিক্ষা কর্মী হিসেবে যোগদান করা কোচবিহার জেলার শীতলকুচি ব্লকের গোলেনাওহাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের স্বামী রবীন্দ্রনাথ বর্মণ।
মাথাভাঙা ২নং ব্লকের প্রথম সারির তৃণমূল নেতা অনুকুল রায়ের নামও জ্বলজ্বল করছে এই বাতিলের তালিকায়। এছাড়াও এই চাকরি বাতিলের তালিকায় রয়েছে মাথাভাঙা বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দিরের শিক্ষাকর্মী শীতলকুচি ব্লকের গোসাইরহাটের বাসিন্দা রূপালি বর্মণ, মাথাভাঙা পাখিহাগা হাইস্কুলের শিক্ষাকর্মী শীতলকুচি কার্যীর দিঘি এলাকার বাসিন্দা অনিমেষ বর্মণ, কোচবিহার মোয়ামারি তত্ত্বনাথ হাইস্কুলের শিক্ষাকর্মী মাথাভাঙ্গা শিঙ্গিজানি এলাকার বাসিন্দা মকসেদুল আলি খান, শীতলকুচি হাইস্কুলের শিক্ষাকর্মী অনুভা প্রামাণিকের মতো আরও বেশ কিছু নাম।
এঁরা সকলেই রাজ্যের শাসক দলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলেই খবর। এই ভুয়ো নিয়োগের ব্যাপারে সিপিআই(এম) কোচবিহার জেলা কমিটির সম্পাদক
অনন্ত রায় এদিন বলেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তার ভাইপো যেমন লুট চালাচ্ছে তেমনি জেলায় জেলায় তৃণমুলের নেতারা কোটি কোটি লুট করেছে।
Comments :0