গাজার আল-আহলি হাসপাতালে ইজরায়েলের বোমাবর্ষণের ঘটনায় বিশ্ব জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। মঙ্গলবার ভারতীয় সময় অনেক রাতে এই বোমাবর্ষণে বুধবার ভারতীয় সময় সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪৭১ জন নিহত হয়েছেন। গাজায় সাম্প্রতিক ইজরায়েলী হানায় একটি আক্রমণে এত জনের মৃত্যু হয়নি। জখম হয়েছেন ৩১৪ জন, তাঁদের ২৮ জনের অবস্থা সঙ্কটজনক। হতাহতদের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীনরা যেমন আছেন, তেমনই হাসপাতালের প্রাঙ্গণে আশ্রয় নেওয়া মানুষও রয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা সকলেই জানিয়েছেন, এত শক্তিশালী বোমা পড়তে আগে কেউ দেখেননি। পশ্চিম এশিয়ার সংঘর্ষ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কোনো কোনো মহলের ধারণা, ইজরায়েল আমেরিকায় তৈরি এম-৮৪ বোমা ব্যবহার করেছে। এই বোমার ধ্বংসের ক্ষমতা বিপুল, এক্ষেত্রে অন্তত ৯৫০ কিলোগ্রাম ওজনের বোমা ফেলা হয়েছে। সেই কারণেই বিরাট গর্ত তৈরি হয়ে গেছে, হাসপাতাল প্রাঙ্গণে থাকা শত শত মানুষ মুহূর্তে নিহত হয়েছেন এবং হাসপাতালের একাংশ জ্বলে গেছে।
এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরপরই পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ধিক্কৃত হয়ে ইজরায়েল ভুয়ো তথ্য প্রচার শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন, এই আক্রমণ গাজার সন্ত্রাসবাদীরাই করেছে। ইজরায়েলের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র সাংবাদিক সম্মেলনে ভিডিও নিয়ে হাজির হয়ে বলেন, গোয়েন্দা সূত্র থেকে আমরা যে খবর পেয়েছি তা থেকে মনে হয় ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠীর একটি ক্ষেপণাস্ত্র ভুল পথে গিয়ে হাসপাতালে আঘাত করেছে। ইজরায়েল এই ঘটনার জন্য দায়ী নয়। ওই সময়ে ওই হাসপাতালের কাছাকাছি অঞ্চল থেকে সন্ত্রাসবাদীরা ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ছিল। মুখপাত্রটি অবশ্য স্বীকার করেন ওই অঞ্চলে ইজরায়েলের ‘অপারেশন’ চলছিল। ইজরায়েলের ব্যাখ্যাকেই নির্লজ্জের মতো প্রতিধ্বনিত করে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন বলেছেন, ‘আমি যা বুঝেছি এই ঘটনা ইজরায়েলের তরফে হয়নি, অপর টিমের পক্ষ থেকে হয়েছে’। তেল আভিভে গিয়ে ইজরায়েলের পাশেই দাঁড়িয়েছেন বাইডেন।
শুধু তেল আভিভেই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদেও ‘মানবিক কারণে যুদ্ধ সাময়িক ভাবে থামানোর’ প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে দিয়েছে। জরুরি পরিস্থিতিতে ব্রাজিল এই প্রস্তাব এনেছিল। প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতির কথা ছিল না, সাময়িক ভাবে যুদ্ধ বন্ধ করার সীমায়িত প্রস্তাব ছিল। এমনকি হামাসের আক্রমণের নিন্দাও করা হয়েছিল। কিন্তু চীন সহ ১২টি দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও একা আমেরিকা তার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। ব্রিটেন এবং রাশিয়া ভোটদানে বিরত ছিল। রাশিয়া গতকালই একটি প্রস্তাব এনেছিল যেখানে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ছিল। কিন্তু তা অধিকাংশ দেশের সমর্থন পায়নি। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে আমেরিকা জানিয়ে দিয়েছে, ইজরায়েলের আগ্রাসন থামানোর কোনো ইচ্ছাই তাদের নেই। বস্তুত মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিন্কেন তেল আভিভে ‘ইজরায়েলের ওয়ার রুমে’ বসে আছেন বলে প্যালেস্তিনীয় নেতারা অভিযোগ করছেন। তবে, বাইডেনের ‘নির্দেশ মেনে’ মিশর সীমান্ত দিয়ে মানবিক সাহায্য গাজায় পাঠাতে রাজি হয়েছে ইজরায়েল। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি খাদ্য জল, ওষুধ পাঠাতে পারবে বলে ইজরায়েল আজ জানিয়েছে। তবে কবে থেকে তা কার্যকর হবে, তা জানানো হয়নি। নির্মম অবরোধ নিয়ে বিশ্ব জনমত ইজরায়েলের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, আন্দাজ করেই এই সিদ্ধান্ত হলেও তা রূপায়ণ নিয়ে সংশয় থেকেই গেছে।
হাসপাতালে গণহত্যার দায় এড়িয়ে ইজরায়েলের প্রচার যে আপাদমস্তক অসত্য, তার অজস্র প্রমাণ রয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘে প্যালেস্তাইনের রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসৌর বলেছেন, নেতানিয়াহু একজন মিথ্যাবাদী। তাঁর ডিজিটাল মুখপাত্র টুইট করে বলেছিলেন ওই হাসপাতালে হামাসের ঘাঁটি ছিল, সেখানেই আক্রমণ করা হয়েছে। পরে তিনি সেই টুইট মুছে ফেলেন।
ব্যাপটিস্ট মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত এই হাসপাতাল খালি করে চলে যাবার জন্য ইজরায়েলীরা বার্তা পাঠিয়েছিল। লাশের স্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে হাসপাতালের অধিকর্তা ও চিকিৎসকরা বলেছেন, আমাদের হুমকি দিয়ে বলা হয়েছিল সরে না গেলে বোমা ফেলা হবে। কিন্তু সরে যাওয়া অসম্ভব ছিল। জেরুজালেমে অন্যান্য যাজকদের সঙ্গে নিয়ে আর্চবিশপ হোসাম নাউম বলেছেন, শনিবার, রবিবার, সোমবার আল-আহলি হাসপাতালকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল টেলিফোনে। জেরুজালেমের চার্চই গাজার সবচেয়ে পুরনো ওই হাসপাতাল চালায়। ইজরায়েলের সেনা মুখপাত্র মঙ্গলবার স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ন’টায় জানিয়েছিলেন ওই হাসপাতাল খালি করতে বলা হয়েছিল।
কারা আক্রমণ করেছে তা স্পষ্ট করে না বললেও রাষ্ট্রসঙ্ঘ জানিয়েছে, গত ১১ দিনে ইজরায়েল ৫৮টি হাসপাতাল, চিকিৎসা কেন্দ্রে আক্রমণ চালিয়েছে। বস্তুত আল-আহলিতে বোমাবর্ষণের ঠিক আগেই কাছাকাছি রাষ্ট্রসঙ্ঘের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও স্কুলে ইজরায়েল আক্রমণ চালায়। আল-আহলি হাসপাতালেও শনিবার একপ্রস্থ আক্রমণ হয়েছিল। তখন পরিকাঠামোর ক্ষতি হয়।
পর্যবেক্ষকরা জানাচ্ছেন, প্যালেস্তিনীয়দের ঘাড়েই দায় চাপানোর তত্ত্ব ধোপে টেকে না। প্যালেস্তাইনের কোনো গোষ্ঠীর হাতেই এত শক্তিশালী বোমা নেই। ইজরায়লের সেনা মুখপাত্র যে ভিডিওটি সাংবাদিক সম্মেলনে দেখিয়েছিলেন পরে তা ডিজিটাল মাধ্যম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। কেননা ভালো করে দেখলে ওই ভিডিওতেও ইজরায়েলী আক্রমণ স্পষ্ট হচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে হাজার হাজার মানুষ তা দেখাতে শুরু করলে বিপদ বুঝে তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আল-আহলিতে আক্রমণের পরেও ইজরায়েলী বোমাবর্ষণ চলতে থাকে। মঙ্গলবার রাতেই গাজার ইউরোপীয়ান হাসপাতালেও ইজরায়েল আক্রমণ চালিয়েছে।
আল-আহলির প্রত্যক্ষদর্শী মহম্মদ আল-হায়েক সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, হাসপাতাল নিরাপদ স্থান ভেবে অনেকের মতোই তিনি ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু এসেছিলেন। সিঁড়িতে বসেছিলেন। বন্ধুদের জন্য কফি আনতে গিয়েছিলেন মহম্মদ। তিনি বেঁচে যান। কিন্তু বিস্ফোরণের পরে ফিরে এসে দেখেন তাঁর বন্ধুরা মাংসপিন্ডে পরিণত হয়েছে। তাঁর ভাষায়, এখানে কেউই আর কাউকে চিনতে পারবে না। টুকরো টুকরো হয়ে গেছে দেহ।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি অবশ্য বিশ্বের প্রতিক্রিয়ায় কান দেননি। তেল আভিভে নেতানিয়াহুর সঙ্গে দেখা করে বাইডেন ‘অপর টিম’ করেছে বলে মন্তব্য করেন। ইজরায়েলে হামাসের আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতির বিশদ বর্ণনা করে বাইডেন বলেন, আমরা ইজরায়েলের সঙ্গে আছি। ইজরায়েলের যে সাহায্য লাগবে আমরা তা দেব।
অন্যদিকে, হাসপাতালে বোমাবর্ষণের ঘটনায় ক্ষুব্ধ আরব দুনিয়া বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকার করায় মার্কিন রাষ্ট্রপতির জর্ডান সফর বাতিল হয়ে গেছে। আম্মানে জর্ডান, মিশর ও প্যালেস্তাইন কর্তৃপক্ষের প্রধান মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে তাঁর বুধবারই বৈঠক নির্ধারিত ছিল। আব্বাস গতরাতেই বলে দেন, তিনি বাইডেনের সঙ্গে বসবেন না। জর্ডান ও মিশরও বাইডেনের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকার করায় বিব্রত হতে হয়েছে মার্কিন প্রশাসনকে। মঙ্গলবার রাত থেকেই দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের রামাল্লায় রাতেই রাস্তায় নেমে আসেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁরা আব্বাসের ভূমিকাতেও ক্ষুব্ধ। আম্মানে ইজরায়েলী দূতাবাসের মধ্যে ঢুকে পড়ে বিক্ষোভকারীরা।
ইজরায়েলের আক্রমণ থামেনি। বাইডেন মাটিতে আক্রমণের সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন বলেই অনুমান করা হচ্ছে। ইজরায়েলের স্থলবাহিনী গাজা সীমান্তের একেবারে কাছে এসে গেছে। যে কোনও সময় এই আক্রমণ শুরু হতে পারে।
Gaza hospital attack
হাসপাতালে বোমাবর্ষণেও ইজরায়েলের পাশে আমেরিকা
×
Comments :0