জয়ন্ত সাহা : কোচবিহার
সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে ঘর থেকে। ভোরের আলো ফোটার আগেই পৌছে যেতে হবে আলিপুরদুয়ার স্টেশনে। আগামী শুক্রবার ভোর পাঁচটার প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে যেতে হবে শিলিগুড়ি। আত্মীয়তার সুরেই চা-বাগানের যুব শ্রমিকরা এমন আবেদন নিয়ে ঘুরছেন শ্রমিকদের বসতিগুলিতে।
চৈত্রের পড়ন্ত বিকেলে রহিমাবাদ বাগানের মাগরিতা সোরেন, চুনিয়াঝোড়া চা বাগানের সুশীল মুণ্ডা ,শ্রীনাথপুর চা বাগানের অমিত মঙ্গরের মতো চা বাগানের যুব শ্রমিকরা বাগানের শ্রমিক লাইনের ঘরে ঘরে যুবক-যুবতীদের কাছে ২৮ মার্চ ‘উত্তরকন্যা চলো’র আবেদন নিয়ে যাচ্ছেন। অনেক স্লোগানের সঙ্গে থাকবে তাঁদেরও কথা— ‘জান দেওব, লেকিন বাগানকের জমিন হি নি ছোড়ব’। হকের দাবি, কাজের দাবিতে উত্তরকন্যা অভিযান। শাসক যখন বধির, তখন সোচ্চারে আর গগণভেদী স্লোগানেই তুলে ধরতে হবে অধিকার রক্ষার দাবি।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিজিবিএস’র মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি চা বাগানের জমি ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘‘জমির পরিমাণ বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে।’’ অর্থাৎ রাজ্য সরকার চা বাগানের বিপুল পরিমাণ জমি হোটেল ব্যবসা সহ নানা কারবারের জন্য কর্পোরেট জমি হাঙরদের হাতে তুলে দিতে চলেছে। মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণা প্রকাশ্যে আসার পর দার্জিলিঙ পাহাড়, তরাই এবং ডুয়ার্সে চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাঁদের স্পষ্ট অবস্থান, কোনওভাবেই চা বাগানের ৩০ শতাংশ জমি পর্যটন শিল্পের নামে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। মুখ্যমন্ত্রীকে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে জনসমক্ষেই। ‘বাগানের জমিন ছাড়ব না’— এই জেদের সুরও মিশবে ২৮ মার্চ বেকারি-বিরোধী দিবসে উত্তরকন্যা অভিযানে।
বসে নেই আলিপুরদুয়ারের ৪৪ বনবস্তির যুবরাও। ভোরের আলো ফূটতেই পানবাড়ি বনবস্তির উইলিয়াম রাভা দু’জন সঙ্গীকে নিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে বলছেন, ‘‘জমিন জঙ্গলের অধিকার নি ছোড়ব।’’ কালকূট বনবস্তির মনোরঞ্জন মিঞ্জও নাওয়া-খাওয়া ভুলে ঘুরছেন ঘরে ঘরে। ক্ষোভে ফুটছেন রহিমাবাদ বাগানের মাগরিতা সোরেন। তাঁর কথায়, ‘‘দু-দুটো লং মার্চ করলাম, শিলিগুড়ির উত্তরকন্যায় মিছিল করে শ্রমিকের ন্যুনতম মজুরি চাইলাম, আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিল, তবুও মজুরি বাড়ল না।’’
এদিকে ৬২টি চা বাগান আর ৪৪টি বনবস্তির যুবদের কাউকেই চেনেন না কোচবিহারের জামালদহের কৃষক পরিবারের আতাবুল ইসলাম কিংবা দিনহাটার সীমান্ত এলাকা গীতালদহের সুবীর রায় কিংবা ফলিমারির বাদশা রহমান। ওঁদের গলায় চা বাগান কিংবা বনবস্তির স্লোগান নয়, উঠে আসছে ফসলের দামের স্লোগান।
জামালদহের আতাবুল ইসলাম ছোট কৃষক পরিবারের ছেলে। এবারে আলু চাষ হয়েছে। দাম নেই। গতবার এই সময়ে এক লরি (২০০ বস্তা) আলুর দাম ছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। এবারে দাম নেমে হয়েছে মাত্র ৮০ হাজার টাকা। আতাবুলের গলায় হতাশার সুর। হবে না-ই বা কেন? শুধু কোচবিহারে নয়, গোটা উত্তরবঙ্গের যে ৬ জেলায় আলু চাষ হয়, সেখানে এখন ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে লোকসানের ছায়া। আতাবুল কাগজ-কলম ধরে হিসেব কষে বোঝালেন, এক লরি আলু উৎপাদন করতে অন্তত আড়াই বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে হয়। বিঘা প্রতি খরচ অন্তত ২৫ হাজার টাকা। তার মানে সব মিলিয়ে এক লরি আলু চাষ করতে খরচ নিদেন পক্ষে ৬২-৬৩ হাজার টাকা। সেই আলু ৮০ হাজারে বিক্রি করে কী হবে? অন্তত পরিবারের ৪ জন তিন মাস জমিতে কাজ করেছেন। তিন মাসে চার জনের মজুরি দাঁড়াচ্ছে বড় জোর মাত্র ১৭ হাজার টাকা! আতাবুলের কথায়, অনেক দাবি আছে। কিন্তু আলু, ধান,পাটের দাম তো চাইতেই হবে। সরকার আলুর সহায়ক মূল্য বেঁধে দিয়েছে কেজি প্রতি মাত্র ৯ টাকা! আতাবুল, বাদশা রহমানদের প্রশ্ন, সরকার কী করে সহায়ক মূল্য ৯ টাকায় বেঁধে দিল? তারপরেও সহায়ক মূল্যই বা মিলছে কোথায়? কোচবিহার জেলায় আলুচাষী ৭ টাকা থেকে সাড়ে ৭ টাকা কেজি দরে আলু বেচতে বাধ্য হচ্ছেন।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা নাজিরহাট, শালমারা গ্রামেও উত্তরকন্যা অভিযানকে ঘিরে যুবদের মধ্যে বাড়ছে উৎসাহ। সীমান্তের এসব এলাকার বাসিন্দাদের জীবনযাপন অন্য এলাকার মতো নয়। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যে ৭টা পর্যন্ত যাতায়াতের অধিকার আছে সাধারণ মানুষের। তারপর রাস্তায় বেরনোর জন্য নিতে হয় বিএসএফ’র অনুমতি। নাজিরহাটের রফিকুল ইসলাম বলছিলেন, ‘‘ ২৮ তারিখে আমাদের এলাকা থেকে যে ২৫-৩০ জন যাবে, তারা আগের দিন বিকালেই দিনহাটা গিয়ে পরিচিতদের বাড়িতে থাকবে। ঘরে ফিরতে হবে পরের দিন। কাঁটাতারের ওপারে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রত্যেকের চাষের জমি আছে। সেই জমি তিন ফসলী হলেও একটির বেশি ফসলের চাষ করা যায় না। কারণ, বিএসএফ’র লিখিত বিধিনিষেধ ছাড়াও আছে অলিখিত হাজারো বিধিনিষেধ। তাঁদের কথায়, ‘‘আমরাও তো স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমরা চাইছি উত্তরকন্যায় গিয়ে নেতৃত্ব আমাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করুক। প্রশাসনকে জিজ্ঞেস করুক, সীমান্তে কেন আমরা পাট, ভুট্টা চাষ করতে পারব না? কেন আমাদের পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে গিয়ে সন্ধ্যের পর নিজের বাড়িতে ফিরতে বিএসএফ’র বাধার মুখে পড়বে?’’
উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি জুড়ে প্রচারে ডিওয়াইএফআই রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখার্জি বলছেন, রাজ্য ও কেন্দ্র দুই শাসকই উত্তরবঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে প্রকাশ্যে প্রশ্রয় দিয়ে আসলে যৌবনের রুটিরুজির লড়াইকে দুর্বল করতে চাইছে। বিভাজনের রাজনীতি খিদে মেটাবে না। যুবরা কাজ চাইছে। সরকার উপহার দিচ্ছে দুর্নীতি।
Comments :0