Post Mortem R G Kar

মাথায় সেই মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ উত্তরবঙ্গ লবির মাথা?

রাজ্য

খড়্গপুর শহরের ইন্দা কলেজ গেট থেকে সূর্য সেন মূর্তি পর্যন্ত ২২টি ক্লাব সংগঠনের সমম্বয়ে মশাল মিছিল সহ ইন্দা মোড়ে বিক্ষোভ প্রতিবাদ সভা।

 ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কি বিকৃত করা হয়েছে? রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দুর্নীতি চক্রের নিয়ন্ত্রক উত্তরবঙ্গ লবির এক অন্যতম মাথার নির্দেশেই কি তা করা হয়েছিল? 
তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত এবং দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের সুযোগ না রেখেই দ্রুত শেষকৃত্য সেরে ফেলা, ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়া নিয়েও ইতিমধ্যে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। এবার আর জি করে চিকিৎসক-ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার তদন্তে সামনে এল আরও চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বিকৃত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই’র একটি সূত্রের দাবি, ‘‘ইতিমধ্যে আমাদের হাতে যা তথ্য এসেছে, সিএফএসএল’র নমুনার যে রিপোর্ট এসেছে, তাতে এই গুরুতর আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে।’’
আর জি করের নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় তথ্য প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ প্রথম থেকেই উঠতে শুরু করেছিল। ক্রাইম স্পটকে বিকৃত করা, পরিকল্পিতভাবে ক্রাইম স্পট সংলগ্ন ঘরকে সংস্কারের নামে ভাঙা নিয়ে রীতিমতো শোরগোল তৈরি হয়েছিল। এবার খোদ ময়নাতদন্তের রিপোর্ট নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠে যাওয়ায় আর জি করের বর্বরতার তদন্তের অভিমুখ বদলে যেতে পারে বলে দাবি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার। এক জনই অভিযুক্ত— এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই কি মরিয়া হয়ে উঠেছিল পুলিশ প্রশাসন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ?
ধর্ষণ এবং তারপরে খুন। তারপর দেহ পোডিয়ামে রাখা। তরুণী চিকিৎসকের একটি হাত কপালে গুছিয়ে রাখা। তারপর জুতোর পাটি পাশে সাজিয়ে রাখা। তারপরে সেমিনার রুমের টেবিল-চেয়ার থেকে একাধিক সামগ্রীতে, একাধিক জায়গায় ফিঙ্গার প্রিন্ট পরিকল্পিতভাবে মুছে দেওয়া। এরপর সকাল সাড়ে নটায় তা প্রকাশ্যে আনা। তারও পরে পুলিশ পৌঁছায় সকাল দশটা দশে। ঘটনাস্থল পরিকল্পিতভাবে খোলা রাখা হয়েছিল। কর্ডন করা হয়নি। ১১ ঘণ্টা পরে তা ঘেরা হয়। এমনকী এফআইআর’র সময় নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। ময়নাতদন্তের আগে ইউডি (অস্বাভাবিক মৃত্যু) কেস দায়ের করা হয়। তারপর সন্ধ্যা ৬টা ১০-এ ময়নাতদন্ত শুরু হয়। শেষ হয় সন্ধ্যা ৭টা ১০-এ। নিয়ম ভেঙে সূর্যাস্তের পরে ময়নাতদন্ত নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠছে।
আর সব কিছুকে ছাপিয়ে এবার সামনে এসেছে সেই ময়নাতদন্তের রিপোর্ট নিয়েই প্রশ্ন। ময়নাতদন্তে খুনের যে কারণ দেখানো হয়েছে, যে ক্ষতচিহ্নের উল্লেখ রয়েছে, তার সঙ্গে নিউটাউনের সিএফএসএল’র রিপোর্টের গুরুতর ফারাক রয়েছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, ময়নাতদন্তের গোটা প্রক্রিয়ায় একাধিক নিয়ম ভাঙা হয়েছে। দুটো রিপোর্টের কপি সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া হয়েছে, যেখানে ফারাক স্পষ্ট। চালান ছাড়া ময়নাতদন্ত হচ্ছে, এটা গোটা দেশে দেখা যায়নি এর আগে কোথাও। চালান ছাড়া কীভাবে সেই ময়নাতদন্ত করলো ময়নাতদন্তের জন্য বিশেষজ্ঞ সেই চিকিৎসকের দল?
সেই চিকিৎসক দলে ছিলেন সন্দীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ আর জি করের ফরেন‍‌সিকের রেসিডেন্ট চিকিৎসক দেবাশিস সোম। ইতিমধ্যে সিবিআই জেরার মুখেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। আপাতত তিনি শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রের দাবি, উত্তরবঙ্গ লবির তিন চিকিৎসককে ময়নাতদন্তের জন্য গঠিত দলে রাখা পরিকল্পনারই অংশ। ইতোমধ্যে আর জি করে আর্থিক দুর্নীতি, মরদেহ লোপাটের মামলায় মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ অত্যন্ত প্রভাবশালী এক চিকিৎসকের ভূমিকা গোয়েন্দা সংস্থার নজরে। ওই প্রভাবশালী চিকিৎসককে ‘উত্তরবঙ্গ লবি’র আসল মাথা বলেই মনে করছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা আধিকারিকরা। তিনি মুখ্যমন্ত্রীর এতটাই ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী যে, তাঁর সম্পর্কে রাজ্য স্বাস্থ্য প্রশাসনও প্রকাশ্যে কথা বলতে অস্বীকার করছে। সেই মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী চিকিৎসকের দুটো সংস্থাও রয়েছে, যারা চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করে, আর জি করেও করতো দীর্ঘ দিন ধরে। সেই চিকিৎসকের নির্দেশেই যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে ময়নাতদন্তের। গত ৯ আগস্ট সকাল থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত সেই চিকিৎসকের সঙ্গে নানা উপায়ে, একাধিক মোবাইল ব্যবহার করে যোগাযোগ রেখেছিল আর জি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ।
ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতেও সেই ময়নাতদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সিবিআই’র তরফে সুপ্রিম কোর্টে রীতিমতো ইঙ্গিত দিয়েই সিএফএসএল ও ময়নাতদন্তের রিপোর্টের ফারাককে সামনে আনা হয়েছে। সলিসিটর জেনারেল সুপ্রিম কোর্টে শুনানিতে বলেছিলেন, মৃতার জিন্সের প্যান্ট ও অন্তর্বাস খোলা অবস্থায় ছিল। দেহের পাশে পড়েছিল। অর্ধনগ্ন অবস্থায় দেহ দেখা গিয়েছিল। একাধিক ইনজুরি ছিল শরীরে। মুখ, নাক চেপে খুন করা হয়েছিল। এরপরেই সিএফএসএল’র রিপোর্ট প্রধান বিচারপতির কাছে জমা দিয়ে তিনি জানান, এবার এই রিপোর্ট দেখুন!  দুটো রিপোর্টের ফারাকের ইঙ্গিত দেওয়া হয়। আবার একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, উদ্ধারের সময়ে মৃতার পা ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ছিল, যা কোমরের পিছনের অংশের হাড় না ভাঙলে সম্ভব নয়। অথচ ময়নাতদন্তের রিপোর্টের সঙ্গে এক্স-রে রিপোর্ট ছিল না। আদৌ এক্স-রে করা হয়েছিল? এমনকী উদ্ধার হওয়া ‘সাদা ঘন চ্যাটচ্যাটে তরল’ নিয়ম অনুযায়ী ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে রাখার কথা, কিন্তু তা রাখা হয়নি। ফলে নমুনার মিশ্রণ ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। 
অন্যদিকে, ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে স্বাস্থ্য ভবনের নির্দেশিকা অনুযায়ী বিকাল চারটের পরে ময়নাতদন্ত করা যায় না। একমাত্র এমন কোনও ঘটনা, যাতে গুরুতরভাবে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে, সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। অথচ সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত এই ঘটনায় সেরকম কোনও উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি হয়নি। পুলিশ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তথ্য প্রমাণ লোপাটে ব্যস্ত সেই সময়ে। একমাত্র ময়নাতদন্তের পরে মা-বাবাকে থানায় বসিয়ে রেখে পুলিশ যখন দ্রুত দেহকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছিল, সেই সময়ে বামপন্থী ছাত্র-যুবরা হাসপাতালের সামনে পুলিশের গাড়ি আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। শুধু তা নয়, এবার টালা থানার এক আধিকারিকের ময়নাতদন্তের চিঠি সামনে আসতেই আরও বিপাকে সরকার, প্রশাসন। বছর তিনেক আগে স্বাস্থ্য ভবনের নির্দেশিকায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে বিকাল চারটের পরে ময়নাতদন্ত করতে হলে এসপি পদমর্যাদার কোনও পুলিশ আধিকারিককে হাসপাতালের সুপার বা অধ্যক্ষকে চিঠি দিতে হবে। এক্ষেত্রে সেই নিয়মও মানা হয়নি। দেখা যাচ্ছে, টালা থানার এক আধিকারিক আর জি করের ফরেনসিক বিভাগকে সন্ধ্যায় দ্রুত ময়নাতদন্তের জন্য চিঠি দেন। সেই এসআই’র চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ফরেনসিক বিভাগও ময়নাতদন্ত শুরু করে দিল! কার নির্দেশে? সন্দীপ ঘোষ এক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গ লবির মাথা যিনি, সেই প্রবল প্রতাপশালী চিকিৎসকের সঙ্গেও এই বিষয়ে যোগাযোগ করেছিলেন। কার্যত গোটা ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়া নিয়েই এবার গুরুতর প্রশ্ন উঠে গেল।

 

Comments :0

Login to leave a comment