চলতি বছরে বিশ্ব জুড়ে নামছে মন্দা, জানালো ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ্দের সমীক্ষা রিপোর্ট। ভারতে সেই মন্দা নামছে জুন মাসে বলে জানাচ্ছেন কেন্দ্রীয় ক্ষুদ্র ছোট মাঝারি শিল্প দপ্তরের মন্ত্রী নারায়ণ রানে। মন্ত্রী রাণে মন্দার ঘোষণার ফাঁকে অবশ্য আশ্বাস দিলেন মন্দা রোধে ব্যবস্থা নেবে মোদী সরকার। এদিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মন্দার পূর্বাভাসে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সীতারামন মন্দার আন্দাজ পেয়েও কেন এখনও নীরব সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা।
সোমবারই দাভোসে সোমবার শুরু হয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের বার্ষিক সাধারণ সভা। বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ও শিল্প ও বাণিজ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা সেই সভায় অংশ নিয়েছেন। সেখানেই মন্দা সম্পর্কিত রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে।
মহামারী পরবর্তী সময়ে সর্বত্র কলকারখানা, ব্যবসা, বাণিজ্য সব চালু হয়ে গেলেও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ধকল সামলে উঠতে পারেনি বিশ্ব। ফোরামের সমীক্ষা রিপোর্টে চলতি বছরে ভেঙে চুরে পড়া অবস্থার মধ্যে যে মন্দা নামছে তা স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে। ফোরামে বিভিন্ন দেশের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মুখ্য অর্থনীতিবিদদের মতামত নিয়ে সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। সেই রিপোর্টে দুই-তৃতীয়াংশ অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন, বিশ্বের আর্থিক পরিস্থিতি যেদিকে চলেছে তাতে চলতি বছরে মন্দা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রির বাজার থাকবে না। মূলত মানুষের আয় কমে যাওয়ার জন্য মন্দা নেমে আসছে বলে সমীক্ষায় জানিয়েছেন বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ। তাদের সামান্য একটি অংশ অবশ্য বাজার খারাপ হলেও মন্দা রোধ করা যাবে বলে আশা করেছেন।
এদিকে ফোরাম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেপ্টেম্বরে সমীক্ষা চালিয়ে ২০২৩ সালে মন্দার সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছে। তাতে পরিষ্কার জানানো হয়েছে, আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলিতে চরম মন্দা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা। মন্দার সঙ্গে চড়া মূল্যবৃদ্ধি ও কলে কারখানায় ছাঁটাইয়ের ঘটনা বাড়বে। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে চীনে যদিও মূল্যবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে বাঁধা থাকবে তবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মূল্যবৃদ্ধির ৫৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। মূলত পেট্রোপণ্য ও খাদ্যপণ্যের চড়া হারে দাম বাড়ার কারণে মূল্যবৃদ্ধির হার চড়া থাকবে বলে জানানো হয়েছে। এদিকে এই সময়ে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মোট উৎপাদন বৃদ্ধির হার(জিডিপি) কমবে। আমেরিকা ইউরোপের সঙ্গে চীনেও জিডিপি বৃদ্ধি হার কমবে বলে জানানো হয়েছে রিপোর্টে।
ফোরামের সমীক্ষায় অর্থনীতিবিদরা জানাচ্ছেন,বিভিন্ন দেশের মন্দার ফলে আর্থিক পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে এক কথায় বলায় সারা বিশ্ব আজ এক অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বিশ্বের সব দেশেই অর্থনীতি সামাল দিতে দিশাহারা অবস্থা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্বে বিভিন্ন দেশে দেখা দিচ্ছে চড়া মূল্যবৃদ্ধি, বিপুল ঋণের বোঝা, আর্থিক বৃদ্ধি হার চলে গেছে তলানিতে। এতে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর কোনও পরিকল্পনা নিতে পারছে না বিভিন্ন দেশের সরকার। মন্দায় বাজার না মেলায় কলকারখানা বন্ধ হতে শুরু করেছে। ফোরামের অধিকর্তা সাদিয়া জাহিদি বলেন, বিশ্বে যে পরিস্থিতি আসছে তাতে বিভিন্ন দেশের সরকারের উচিত হলো কোনও সময় নষ্ট না করে অবিলম্বে মানুষের কাজের ব্যবস্থা করা। তাদের কর্মসংস্থান বাড়ানো। শ্রমজীবী মানুষের দক্ষতা ও উন্নত শিক্ষার ব্যস্থা করা। এই বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাই হলো মন্দা মোকাবিলার একমাত্র রাস্তা। দ্বিতীয় হলো, সাধারণ মানুষকে কম দামে খাদ্য এবং জ্বালানির ব্যবস্থা করা। তিনি বলেন, আমাদের কাছে বেশি সময় নেই। বিশ্বকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে মুক্তি দিতে সব দেশকে এই জরুরি কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে।
ফোরামের মন্দা নিয়ে সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশের পরেই ভারতেই মন্দার পূর্বাভাস জানিয়েছেন মন্ত্রী রানে। তিনি পুনেতে সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন উন্নত দেশে মন্দার খবর শোনা যাচ্ছে। আমাদের দেশেও এই মন্দা এলে তা আসবে জুন মাসের পরে। তবে কেন্দ্র এই মন্দা এড়াতে যাবতীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস্য হওয়ায় দেশের অর্থনীতির হাল নিয়ে আগাম খবর থাকে। প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং অর্থমন্ত্রী সীতারামনের থেকে যা শুনেছি তা হলো বিশ্বের বড় বড় দেশে মন্দা শুরু হয়ে গেছে। এটাই আজকের দিনের বাস্তবতা। বিশ্বজোড়া মন্দা যাতে দেশে কোনও প্রভাব না ফেলতে তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। তবে ভারতে যদি মন্দা আসে তা আসবে জুন মাসের পরেই।
মন্ত্রী রানের দেশে মন্দার পূর্বাভাস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধী দল। বিরোধী কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ এপ্রসঙ্গে বলেন, মোদী সরকারের মন্ত্রী দেশে মন্দার পূর্বাভাস দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোদী ও অর্থমন্ত্রী সীতারামন নীরব কেন? কেন মন্দার পূর্বাভাস গোপন করছেন? অর্থমন্ত্রী সীতারামন তো সব বাজেটের আগেই দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি করেছেন। এখন তিনি নীরব কেন? কেন গোপন করছেন মন্দা পরিস্থিতি?
এদিকে ভারতের অর্থনীতির মন্দার মুখোমুখি হয়েছে মহামারীর আগেই। নোট বাতিল ও পণ্য পরিষেবা কর চালু করায় ছোট ক্ষুদ্র শিল্প প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এতে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় দেশে চরম মন্দা দেখা দেয়। তা সামাল দিতে না দিতে শুরু হয় মহামারী। দুই বছর বন্ধ হয়ে যায় কলকারখানা ব্যবসা বাণিজ্য। এই সময়ে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। বহু শিল্প পাকাপাকি বন্ধ হয়ে গেছে। দুই বছর কেটে গিয়ে শিল্প ব্যবসা বাণিজ্য সব স্বাভাবিক হলেও ভারতের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, চলতি আর্থিক বছরে ফের ধুঁকছে অর্থনীতি।
কমেছে শিল্প উৎপাদনের হার, কমেছে আয়, বাড়ছে বেকারি। সম্প্রতি কেন্দ্রের পরিসংখ্যান দপ্তরের প্রকাশিত তথ্য এই বেহাল চিত্র ধরা পড়েছে। দপ্তর প্রকাশিত প্রেস বিবৃতিতে জাতীয় আয় ও বৃদ্ধি নিয়ে আনুমানিক পূর্বাভাসে জানাচ্ছে, ২০২২-২৩সালে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি (জিডিপি)’র হার দাঁড়াবে ৭শতাংশ। ২০২১-২২সালে যেখানে জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৭শতাংশ। এক বছরে কমছে ১.৭ শতাংশ। বর্তমান আর্থিক বছরে মূলত শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির হার তলানিতে চলে যাওয়াতে জিডিপি বৃদ্ধির হার দ্রুত কমে চলেছে। এদিকে আর্থিক উন্নত দেশ সহ বিশ্বের এক- তৃতীয়াংশ দেশে চলছে তীব্র মন্দা। তার প্রভাব পড়ছে ভারতের অর্থনীতিতে। এর ফলে দেশের রপ্তানির কমে যাওয়ায় বহু রপ্তানি নির্ভর শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। মহামারীর দুই বছরে স্তব্ধ হয়ে যায় দেশের অর্থনীতি। তা কাটিয়ে সবে শিল্পে উৎপাদনে গতি পেয়েছিল। কিন্ত সেই গতি ধরে রাখা যায়নি। উৎপাদনের বৃদ্ধি হার ফের নিম্নমুখী।
এদিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে বিভিন্ন আর্থিক সংস্থা চলতি আর্থিক বছরের পূর্বাভাসে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি হারে অধোগতির কথা জানিয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কে তার পূর্বাভাসে জিডিপি বৃদ্ধি হার জানিয়েছে ৬.৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ) তার পূর্বাভাসে বৃদ্ধি হার ৭.৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬.৮ শতাংশ করেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক তা কমিয়ে ৬.৯ শতাংশ করেছে। এডিবি পূর্বাভাসের হার হলো ৭শতাংশ। স্টেট ব্যাঙ্কের পূর্বাভাসের হার হলো ৬.৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে বছর জুড়ে চড়া মূল্যবৃদ্ধি, শিল্পে উৎপাদন হ্রাস তার পাশাপাশি দেদার ছাঁটাইয়ে চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় আর্থিক বৃদ্ধির হার কমেছে।
Comments :0