নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে অ্যাডিনো ভাইরাস। দীর্ঘস্থায়ী সর্দি কাশি জ্বরে কাবু রাজ্যবাসী। মারাত্মকভাবে আক্রান্ত শিশু থেকে বয়স্ক সকলেই, ঘটছে মৃত্যুও। হাসপাতালের বেড, আইসিইউ, শিশুদের নিকু, পিকু ইউনিটগুলি এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীতে এখন ভর্তি। গত এক সপ্তাহে দু’টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে কলকাতায়। তার মধ্যে রবিবার শহরের হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে এক শিশুর। বৃহস্পতিবার মৃত্যু হয় আরও এক শিশুর। ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণের কারণে শ্বাসযন্ত্র বিকল হয়েই এই দু’টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে কোভিডকালের মতোই সতর্ক থাকতে হবে, হাঁচি কাশি ছড়ানো চলবে না বলে অভিমত চিকিৎসকদের।
রবিবার সকালে কলকাতার বিসি রায় শিশু হাসপাতালে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। সল্টলেকের বাসিন্দা এই শিশুটিকে জ্বর ও সর্দি কাশির উপসর্গ নিয়ে ভর্তি করা হয়েছিল এই হাসপাতালে। ক্রমে তাঁর শ্বাসযন্ত্রেও ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। ভেন্টিলেশনে রেখেও শেষ রক্ষা হয়নি, রবিবার মৃত্যু হয়েছে শিশুটির। তবে মৃত্যুর কারণ অ্যাডিনো ভাইরাসই কিনা তা এখনও জানা সম্ভব হয়নি। এছাড়া পার্ক সার্কাসের শিশু হাসপাতালে বৃহস্পতিবার লেকটাউনের বাসিন্দা আরও এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। তার শরীরে অ্যাডিনো ভাইরাসের উপস্থিতি মিলেছে। গত দুই মাসে এই নিয়ে সর্দি কাশি জ্বরের উপসর্গে রাজ্যে ৫ টি শিশুর মৃত্যু হলো যা নতুন করে উদয় হওয়া অ্যাডিনো ভাইরাস থেকে হতে পারে বলে মনে করছে চিকিৎসক মহল।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ কাজলকৃষ্ণ বণিক এই প্রসঙ্গে বলেছেন, অ্যাডিনো ভাইরাস একটি পুরানো ডিএনএ ভাইরাস, বর্তমানে যার মিউটেশন হয়ে আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে। তার কারণ নিয়ে একটু ধন্ধে রয়েছেন বিজ্ঞানী থেকে গবেষকরা। গত কয়েক মাসে সর্দি কাশি জ্বর বেড়ে গেছে তার ৩২ শতাংশই অ্যাডিনো ভাইরাসের ফলে হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে অন্যান্য আরএসভি জাতীয় ভাইরাসও আছে সংক্রমণ ঘটানোর জন্য। এই অ্যাডিনো ভাইরাস সংক্রমণ থেকে ফুসফুস কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে পারে, শ্বাসনালী আক্রান্ত হয়ে নিউমোনিয়া পর্যন্ত হতে পারে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে তা জটিল আকার নিতে পারে। ফলে ভেন্টিলেশনে রাখার প্রয়োজন হয় রোগীকে। শুধু তাই নয়, শ্বাসনালীর উপরিভাগ আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাশি থাকতে দেখা যাচ্ছে রোগীদের। রোগ বাড়াবাড়ি হলে বা কোমর্বিডিটি থাকলে মৃত্যুও ঘটতে পারে। তবে ভয় না পেয়ে বরং সাবধানতা অবলম্বন করলে অনেকটাই রেহাই মিলবে।
এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পরামর্শ, কোভিকালের মতোই এক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ বর্তমানের এই আবহাওয়া, একবার গরম একবার ঠান্ডা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের পক্ষে খুবই সহায়ক। রাস্তাঘাটে মাস্ক ব্যবহার করলে ভালো, হাঁচি বা কাশি এলে মুখে কাপড় চাপা দিতে হবে। নাহলে দ্রুত ছড়িয়ে যাবে ভাইরাস। বেশি করে জল খাওয়া, একটু উষ্ণ জল পান করলে ভালো, এছাড়া গার্গেল করা, মধু, ভিটামিন সি খাওয়া রোগ প্রতিরোধে কাজে দেবে। এদিকে জানা গেছে, বিশেষ করে এ রাজ্যে মিউটেশন হয়ে অ্যাডিনো ভাইরাসের চারিত্রিক পরিবর্তন বা জিনোম সিকোয়েন্স পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে নাইসেড, স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনে। গবেষণা চলছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে অন্য কোনও ধরনের ভাইরাসের উপস্থিতি ঘটেছে কিনা তা জানার জন্য।
গত কয়েক দিনে রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের যে চিত্র উঠে এসেছে তা বেশ উদ্বেগজনক। শহরের বিভিন্ন হাসপাতালগুলিতে তিলধারণের জায়গা নেই। শিশু হাসপাতালগুলিতে সাধারণ বেড তো বটেই, ভিড়ে উপচে পড়ছে আইসিইউ, নিকু, পিকু ইউনিট। বেশিরভাগই সর্দি কাশি জ্বর ও বুকে সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি। গ্রামীণ হাসপাতালে বহু মানুষ আসছেন দীর্ঘ সময়ে ধরে থাকা কাশি-জ্বরের উপসর্গ নিয়ে। ডবল অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগেও অনেক সময়ে তেমন সুরাহা হচ্ছে না বলে বক্তব্য রোগীদের। রোগ সহজে সারতে চাইছে না, কাশি- জ্বর জ্বর ভাব কমতে দেরি হচ্ছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এই রোগ করোনা ভাইরাসের কোনও নতুন ভ্যারিয়েন্ট কিনা, না অ্যাডিনো ভাইরাস থেকে হচ্ছে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তা নির্ধারণ করতে পারে জিনোম সিকোয়েন্স টেস্ট।
অ্যাডিনো ভাইরাসের এই প্রকোপ বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য ভবনও। প্রতিবছরই এই সময়ে এই ধরনের অসুখবিসুখ বেশি হতে দেখা যায়, কিন্তু এবার পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য ভবনে বৈঠক হয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিকর্তা থেকে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক থেকে মেডিক্যাল কলেজের আধিকারিকদের মধ্যে। শিশু হাসপাতাল সহ বিভিন্ন হাসপাতালে ফিভার ক্লিনিক খোলার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া রোগের মোকাবিলায় পর্যাপ্ত অক্সিজেন এবং ফুসফুসের সংক্রমণজনিত চিকিৎসার প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রতিটি হাসপাতালে যথাযথভাবে রাখার নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য ভবনের তরফে।
Comments :0