কিন্তু প্রস্তাবের সঙ্গে বরাদ্দের এই বিপুল ফারাক কেন, স্বাভাবিক ভাবেই তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালের বা জাতীয় পরিবেশ ট্রাইবুনালের পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চ ২০২২’র মে’তে আদিগঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণের কাজ দ্রুত করতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। এর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ সরকার, রাজ্য পরিবেশ দপ্তর, পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ, ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা এবং কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে ৬ মাসের মধ্যে নিজেদের বক্তব্য হলফনামার মাধ্যমে জমা দিতে বলে।
একইসঙ্গে একাধিকবার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও আদিগঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ না নেওয়ায় সংস্থাগুলিকে তিরস্কারও করে গ্রিন ট্রাইবুনাল।
গ্রিন ট্রাইবুনালে তিরস্কৃত হয়ে আসরে নামে কলকাতা কর্পোরেশন। আদিগঙ্গা সংস্কারের জন্য বিশদ প্রকল্প রিপোর্ট বা ‘ডিপিআর’ তৈরি করে কর্পোরেশন। কর্পোরেশনের তরফে আদিগঙ্গা সংষ্কারের জন্য ৯৩৪ কোটি টাকার প্রকল্পের রূপরেখা পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রকের কাছে। এই রিপোর্ট পাঠানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেন মমতা ব্যানার্জি স্বয়ং। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রাধীন ‘নমামী গঙ্গে’ প্রকল্পের মধ্যেই আদিগঙ্গা সংস্কারকে রাখা হয়।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের তরফে ‘ডিপিআর’ খতিয়ে দেখার জন্য পাঠানো হয় আইআইটি রুরকি’র বিশেষজ্ঞদের কাছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে বড়সড় কাটছাঁট করেন রুরকির বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের প্রস্তাব অনুযায়ী, কলকাতা কর্পোরেশনের প্রস্তাবিক প্রকল্পের খরচ কখনোই ৬৫৪ কোটির বেশি হওয়া উচিত নয়। সেই প্রস্তাব মেনে নিয়ে কেন্দ্রের তরফে একই পরিমাণ টাকা বরাদ্দ হয় প্রকল্পের জন্য। ২৩ ডিসেম্বর ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে এই প্রকল্পের শিলান্যাস করেন নরেন্দ্র মোদী।
বর্তমানে এই বিপুল বরাদ্দ হেরফের নিয়ে কলকাতা কর্পোরেশনের অভ্যন্তরেই শুরু হয়েছে বিস্তর হইচই। কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারদের বক্তব্য, বরাদ্দের সঙ্গে প্রকল্পের বাস্তব খরচের হেরফের সাধারণত ১-২ শতাংশেই সীমাবদ্ধ থাকে। কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারদের দাবি, খুব সম্ভবত প্রকল্পের নকশা, ড্রয়িং ইত্যাদি কারিগরি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেননি রুরকির বিশেষজ্ঞরা। এই ধরণের ক্ষেত্রে সাধারণত তাই হয়ে থাকে। ইঞ্জিনিয়াররা বলছেন, বরাদ্দ হেরফের মূল কারণ হতে পারে কারিগরি বিষয়গুলির বাইরের কাজে আর্থিক সংস্থান। রুরকির বিশেষজ্ঞরা সেখানেই কলম চালিয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরে কলকাতা কর্পোরেশনে কর্মরত অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়াররা জানাচ্ছেন, তৃণমূল পরিচালিত কর্পোরেশনের সময়কালে কারিগরি বিষয় বহির্ভূত ক্ষেত্রের জন্য একটা বড় অংশের টাকা বরাদ্দ থাকে। মূল প্রকল্পে কিন্তু এর কোনও প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই ‘বাফার’টিকে ব্যবহার করেই ‘কাটমানি’ চালাচালি হয়ে থাকে কর্পোরেশন এবং এক শ্রেণির ঠিকাদারের মধ্যে। আদিগঙ্গা সংস্কারের ক্ষেত্রেও একই কায়দায় চলার চেষ্টা করেছিল কর্পোরেশন। কিন্তু আইআইটি রুরকির বিশেষজ্ঞদের আতস কাঁচের তলায় সবটাই ধরা পড়ে গিয়েছে।
যদিও কলকাতা কর্পোরেশনের দাবি, কেন্দ্রের তরফে বিমাতৃসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। এর ফলে আদিগঙ্গার সংস্কারের কাজই থমকে যেতে পারে।
২৩ ডিসেম্বর শিলান্যাস হওয়া প্রকল্পটিতে ব্রিজি রোড, বাঁশদ্রোণী এবং গল্ফ গার্ডেনে ৩টি সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরির কথা রয়েছে। এছাড়াও ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন বসানো, বিভিন্ন ক্ষমতা সম্পন্ন ১২টি নতুন পাম্পিং স্টেশন তৈরি, ১১টি পাম্পিং স্টেশনের আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ, ৬টি স্বয়ংক্রিয় পেনস্টক গেট তৈরি ও ৬৮টি পুরোনো পেনস্টক গেটের সংস্কার, ৪টি নতুন ট্রেসেল ব্রিজ নির্মাণের কথা রয়েছে।
প্রকল্পটির জন্য ৩০ মাসের সময়সীমা ধার্য করা হয়েছে। কেন্দ্রের দাবি, এই প্রকল্পের ফলে সরাসরি উপকৃত হবেন কলকাতা কর্পোরেশনের ২৮টি ওয়ার্ড এবং রাজপুর সোনারপুর পৌরসভার ৩টি ওয়ার্ডের মোট ৬ লক্ষ মানুষ। এর পাশাপাশি রাজ্য সরকারের উদ্যোগে আদিগঙ্গার পলি নিষ্কাশন চলছে, যা আগামী অর্থবর্ষের মধ্যেই শেষ হবে। এছাড়াও ৮০টি ঘাটের সংষ্কার এবং জঞ্জাল ফেলা ঠেকাতে ৩০টি ক্রস ব্রিজের উপর জাল লাগানোর কাজের বরাত দেওয়ার কাজও শুরু করেছে রাজ্য সরকার।
Comments :0