ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে সরকারের তরফে আলু কেনার দাবি নিয়ে মার্চ মাসে রাজ্যজুড়ে জাতীয় সড়ক ও রাজ্য সড়ক অবরুদ্ধ করার কর্মসূচি ঘোষণা করল পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষকসভা।
রবিবার কৃষকসভার রাজ্য কাউন্সিল সভা থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কৃষকসভার এদিনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সারা ভারত কৃষকসভার সর্বভারতীয় সহ সভাপতি হান্নান মোল্লা। তিনি বলেছেন,‘‘ যে বিষয়গুলি আমাদের সর্বোচ্চ আঘাত করছে তা নিয়ে আমাদের ইস্যুভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কোনও ছুৎমার্গ না রেখে যারাই লড়াইয়ে আসতে চায় তাদের সঙ্গে নিতে হবে। তিন কৃষি বিল প্রত্যাহার নিয়ে মোদী সরকারকে বাধ্য করাতে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলন আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে।’’
এরাজ্যের আলুচাষিদের সঙ্কট সেই ইস্যুকেই সামনে এনেছে। লাভজনক দরের সুযোগ ক্রমশ কমছে। যে হারে দাম কমছে চাষের খরচ ওঠার সম্ভাবনাও থাকছে না। পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে কার্যত সর্বনাশের প্রহর গুনছে বাংলার আলুর খেত। রাজ্যে এই মুহূর্তে আলুর দাম কেজি প্রতি ৫ টাকারও নিচে। দক্ষিণবঙ্গের থেকেও আরও দাম কমেছে উত্তরবঙ্গে। কোচবিহারে কৃষকের মাঠের আলুর দাম নেমেছে কেজি প্রতি আড়াই টাকায়।
এখনই যে আলু উঠছে তা হিমঘরে যাবে না খোলাবাজারে বিক্রি হয়ে যাবে। কিন্তু মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে দক্ষিণবঙ্গের আলু চাষের এলাকা থেকে ব্যাপক হারে উঠতে শুরু করবে আলু। তখন দাম আরও তলানিতে নামবে বলে আশঙ্কা কৃষকদের।
রাজ্যের আলুচাষিদের রক্ষা করতে সরকারের কাছে কুইন্টাল পিছু ৯০০ টাকা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দাবি করেছিল সারা ভারত কৃষকসভার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি। বিপদের হাত থেকে আলুচাষিদের বাঁচাতে দু’সপ্তাহ আগে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কৃষক সংগঠন। কিন্তু রাজ্য সরকার কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে আলুচাষিদের স্বার্থে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবি নিয়ে মার্চ মাসের শুরুতে রাজ্যজুড়ে পথ অবরোধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সারা ভারত কৃষকসভার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি। সারা ভারত কৃষকসভার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক অমল হালদার জানিয়েছেন,‘‘ আলুচাষিরা ভয়ানক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। সরকার এখনও পর্যন্ত কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ জানাতে পারেনি। আলুচাষিদের স্বার্থে তাই রাজ্যজুড়ে জাতীয় সড়ক ও রাজ্য সড়ক অবরুদ্ধ করে সরকারকে আলুর ন্যূনতম দাম ঘোষণা করে আলু কিনতে বাধ্য করা হবে।’’
২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে মাধ্যমিক পরীক্ষা। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। দুই পরীক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে রাজ্যে রাস্তা অবরোধের দিনক্ষণ ঘোষণা করবে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষকসভা।
তার আগে আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি হুগলীর আলুচাষি নিবিড় এলাকা ও ব্যবসাকেন্দ্র চাঁপাডাঙাতে দক্ষিণবঙ্গের আলুচাষিদের নিয়ে কনভেনশন আয়োজিত হবে। হাওড়া, হুগলী, পূর্ব বর্ধমান ও বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আলুচাষিরা কনভেনশনে উপস্থিত থাকবেন। একইসঙ্গে ২৬ ফেব্রুয়ারি উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিকে নিয়ে ফালাকাটায় আয়োজিত হবে রাজ্য আলুচাষি কনভেনশন।
আলু নিয়ে রাজ্যের পরিস্থিতি যে আগামীদিনে উত্তপ্ত হতে চলেছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে এদিনই। মাঠ থেকে আলুর দাম না মেলায় এদিন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় চন্দ্রকোণায় রাজ্য সড়ক প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন কৃষকরা। রাস্তায় আলু ফেলে এদিন চন্দ্রকোণা ঘাটাল রাজ্য সড়কে অবরোধ করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবি করেন কৃষকসভার কর্মীরা।
এদিন কৃষকসভার রাজ্য কাউন্সিল বৈঠকেও জেলা থেকে আসা নেতৃত্বরাও আলু সহ সবজি চাষ করে কীভাবে কৃষকদের অভাবী বিক্রি করতে হচ্ছে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। কোচবিহারের কৃষকসভার নেতা বলছিলেন,‘‘ কোচবিহারে আলুর কেজি আড়াই টাকায় নেমে গেছে। আলুর দাম নেই। তামাক চাষ করেও দাম পাচ্ছে না কৃষকরা। গত বছর যে তামাক পাতা ৪ হাজার টাকা মন বিক্রি হয়েছে,এবার সেই দাম ঠেকেছে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায়।’’
আলুর দাম নিয়ে শঙ্কার কথা উঠে এসেছে পূর্ব বর্ধমানের কৃষকসভার নেতাদের আলোচনাতেও। তাঁদের অভিজ্ঞতা, ‘‘এবার মাঠ থেকে আলু কেনার লোক নেই। কারণ, হিমঘর মালিক ও ব্যবসায়ীরা আলু কিনে নেয়। গত বছর তারা যে লোকসানের মুখে পড়েছে তাতে তারা আলু কিনতে চাইছে না।’’ একসময় এরাজ্য থেকে ওডিশা, বিহার, ঝাড়খণ্ড এমনকি অন্ধ্র প্রদেশের মতো রাজ্যেও আলু যেত। সেই আলুর বাজার এখন সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। কারণ, অতীতে মমতা ব্যানার্জির সরকার এরাজ্য থেকে আলু ভিনরাজ্যে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল। সরকারের এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়েছে আলুর বাজারে। রাজ্যের আলু আর ভিনরাজ্য যায় না।
অথচ চলতি বছরে কৃষি বিপণন দপ্তরের প্রাথমিক হিসাব প্রায় ১২০ লক্ষ টন আলু উৎপাদন হতে পারে। এরাজ্যে হিমঘরে আলু সংরক্ষণ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ৬৪লক্ষ টন। ফলে স্বাভাবিক হিসাবে উৎপাদিত আলুর প্রায় অর্ধেক খোলা বাজারে বিক্রি করা ছাড়া উপায় থাকবে না। কৃষকদের আশঙ্কা এখানেই। মার্চের শুরু থেকে দক্ষিণবঙ্গের আলু উৎপাদনের জেলাগুলি থেকে ব্যাপক হারে আলু ওঠার সময়ই দাম নিচে নামবে। কৃষকদের স্বার্থে তাই রাজ্যে আগামীদিনে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে চলেছে কৃষকসভা।
Comments :0