মণিরুল হকঃ আমতা
রবিবার আনিসের খুন হওয়ার এক বছর পূর্ণ হলো।
এদিন শহীদ আনিস খানের রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়ার মাহফিল হবে। উল্লেখ্যযোগ্যভাবে, এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সভায় আনিস খানের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও সঠিক বিচারের দাবি জানানো হয়। এদিন বিকালে প্রথমে আনিস খানের কবর জিয়ারত করেন তার বাবা সালেম খান, দাদা সাবির খান, পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ও গ্রামবাসীরা।
সিপিআই(এম)’র এক প্রতিনিধিদল কবরে গিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। প্রতিনিধিদলে ছিলেন সিপিআই(এম) নেতা পরেশ পাল, সন্তোষ অধিকারী, শেখ জসিমউদ্দিন, আইনজীবী সব্যসাচী চ্যাটার্জি। এরপর ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন হাওড়া জেলা কমিটির এক প্রতিনিধিদল আনিসের পরিবারের সাথে কথা বলতে তার বাড়িতে যান। প্রতিনিধিদলে ছিলেন যুবনেতা সুভাষ দে, সুজয় চক্রবর্তী, সোমনাথ গৌতম, লাল্টু পণ্ডিত। তারা সেখানে গেলে যুবনেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি আনিস খানের বাবা সালেম খানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এরপর শুরু হয় শহীদ আনিস খানের রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়ার মাহফিল। সেই দোয়ার মাহফিলে প্রায় গোটা গ্রাম ভেঙে পড়ে। গ্রামের প্রায় সব বাড়ি থেকেই মানুষ উপস্থিত হন। বিভিন্ন বক্তারা আনিস খানের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও সঠিক বিচারের দাবি জানান।
আনিসের বাবা বলেন, আমার ছেলে আনিসের মৃত্যুর আজ এক বছর পূর্ণ হলো। মমতা ব্যানার্জি বলেছিল, আমি সিট গঠন করেছি। ১৪ দিনের মাথায় আনিস খুনের বিচার পাবে। প্রথম থেকেই আমি সিটের উপর ভরসা রাখতে পারিনি। আমি সিটকে মানি না। আমি মহামান্য হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। আমি কোর্ট নজরদারিতে সিবিআই’র দাবি করেছিলাম। সেই সিবিআই’র দাবিতে আমি এখনও অনড়। আমার আইনজীবীরা সেই মতো লড়াই করছেন। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, এই সিট কীভাবে তদন্ত করবে? যে পুলিশ আমার চোখের সামনে আমাকে বন্দুক ঠেকিয়ে আমার ছেলে আনিসকে ছাদ থেকে ফেলে খুন করলো, তারপর তারাই প্রথমে বলল পুলিশ যায়নি, তাদের তৈরি সিট কীভাবে সঠিক তদন্ত করবে? কী তদন্ত করেছে সেটা রিপোর্টেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। রিপোর্টে যাদের নাম আছে, যারা গ্রেপ্তার হলো তারা তো এখন বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চাকরি করছে।
এক বছর পরে আনিস হত্যার রাজ্য পুলিশের চার্জশিটে অভিযুক্তরা এখন কোথায়? আমতা থানার তৎকালীন ওসি দেবব্রত চক্রবর্তী। ঘটনার পরে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে সরকার তাঁকে ‘ছুটি’তে পাঠায়। তবে ১৬৪ ধারায় গোপন জবানবন্দি না নিয়েই। ‘ছুটি’র পর্ব শেষ হয়েছে। চার্জশিটে অন্যতম অভিযুক্ত তিনি। এখন দেবব্রত চক্রবর্তী বাগনান থানায় এসআই হিসাবে কর্তব্যরত। হোমগার্ড কাশীনাথ বেরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, এখন জামিনে আছেন। এএসআই নির্মল দাস এখনও গ্রেপ্তারই হননি।
দু’জন সিভিক ভলান্টিয়ারের নাম ছিল চার্জশিটে। প্রথম জন সৌরভ কাঁড়ার। আমতা থানার তাজপুরের বাসিন্দা। পরিচিত তৃণমূল কর্মী। তাজপুরেই স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক সুকান্ত পালের বাড়ি। সারদা গ্রামের দক্ষিণ খানপাড়ায় খুন হওয়া ছাত্রনেতা আনিস খানের বাড়ি। এটি কুশবেড়িয়া পঞ্চায়েত এলাকার মধ্যে পড়ে। সেই বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে তাজপুর গ্রাম। এটি তাজপুর পঞ্চায়েতের মধ্যেই পড়ে। বিধায়কের সঙ্গে ছবিও রয়েছে। এখনও পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি। অথচ তাঁকে প্রকাশ্যেই দেখা যাচ্ছে।
দ্বিতীয়জন প্রীতম ভট্টাচার্য। আমতা থানার সিরাজবাটির মিল্কিচকে তাঁর বাড়ি। আমতা থানা থেকে কয়েক মিনিট দূরত্বে বাড়ি। মিল্কিচক নতুন পল্লির বাসিন্দাদের কথায়, ঐ যুবককে যত না সিভিক পুলিশ হিসাবে তাঁরা চিনতেন, তার থেকে বেশি তৃণমূলকর্মী হিসাবেই জানেন। আমতার তৃণমূলী বিধায়কের সঙ্গে একাধিক অনুষ্ঠানে দেখা গেছে তাঁকে, গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, জামিনও পেয়ে গেছেন। সিভিক ভলান্টিয়ার হিসাবেই কাজ করছেন।
এদিন আনিসের খুনের ইনসাফ চেয়ে জেলা জুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যুবরা। এদিন জেলার বাগনান ওরফুলি ইউনিটের ৭ জন যুবতী সহ ৪০ জন রক্তদান করে। আমতা শেহাগোড়ী মোড়ে ও শ্যামপুরে আনিস খানের খুনিদের শাস্তির দাবিতে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ হাওড়া লোকাল কমিটির উদ্যোগে ধারসা মিহির লাল খান স্কুলের সামনে থেকে মশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও হাওড়া জেলা জুড়ে প্রতি লোকাল কমিটির ইউনিট এলাকায় আনিস খানের স্মরণে মাল্য দান ও প্রতিক্রিতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
‘ইয়ে অন্ধা কানুন হ্যায়।’ একদিকে আনিস খান খুনের ইনসাফ চাই পোস্টার, আর অন্যদিকে কিশোরের কুমারের গাওয়া অমিতাভ বচ্চন অভিনিত জনপ্রিয় হিন্দি গান ‘ইয়ে অন্ধা কানুন হ্যায়’ ব্যাক গ্রাউন্ডে দিয়ে রবিবার সারাদিন ফেসবুকের ওয়াল ভরেছিল রাজ্যের প্রতিবাদী কণ্ঠের। গত ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখের ভোর রাতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অপরাধে বাবাকে বন্দুক ঠেকিয়ে পুলিশ ছাদ থেকে ফেলে খুন করছিল প্রতিবাদী নেতা আনিস খানকে। এই ঘটনা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে জল গড়িয়েছে অনেক দূর। বাম ছাত্র-যুবরা আনিস খুনের শাস্তির দাবিতে পথে নেমে বারে বারে আক্রান্ত হয়েছে পুলিশের হাতে। তারা জেল খেটেছেও অনেকদিন। কিন্তু প্রতিবাদ থেমে থাকেনি।
Comments :0