মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে বড় পরিবর্তন ঘটালো চিন। দীর্ঘ বৈরিতার পর ফের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা করল ইরান এবং সৌদি আরব। চিনের মধ্যস্থতায় এই কূটনৈতিক সম্পর্ক ফের গড়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪ দিন ধরে চিনের রাজধানী বেজিংয়ে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক চলে চিন, ইরান এবং সৌদি আরবের প্রতিনিধিদের মধ্যে। সেই বৈঠক থেকেই রফাসূত্র মিলেছে। বৈঠকে ঠিক হয়, ২ মাসের মধ্যে দুই দেশে চালু হবে দুই তরফের দূতাবাস। সেই সূত্র ধরে ১০ মার্চ চিনের কূটনীতিক এবং সেদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য ওয়াং ই’র উপস্থিতিতে নতুন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা ঘোষণা করে ইরান এবং সৌদি। ইরানের তরফে এই বৈঠকে অংশ নেন সেদেশের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সেক্রেটারি আলি শামখানি, এবং সৌদি আরবের তরফে অংশ নেন সেদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাদ বিন মহম্মদ আল আইবান।
মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মহল জানাচ্ছে, চিনের এই ভূমিকার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির আমূল বদল ঘটতে চলেছে। কেন? ইরানের মূলত শিয়া প্রাধান্য, অপরদিকে সৌদি আরবের শাসনে সুন্নি মুসলিম প্রাধান্য রয়েছে।
১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লব ঘটায় কট্টারপন্থী শিয়া ধর্মগুরুরা। ইরানের তৎকালীন মার্কিন পন্থী ‘শাহ’ বা সম্রাট রেজা পেহলভিকে দেশছাড়া করা হয়। ইরান বিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায় সেদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অপরদিকে প্রতি বিপ্লব দমনের নামে দেশজুড়ে কমিউনিস্ট নিধন চালায় ইরানের নতুন শাসকরা। তারফলে সোভিয়েত রাশিয়ার তরফেও কূটনৈতিক সৌহার্দ্য দেখানো হয়নি ইরানের প্রতি।
শীতল যুদ্ধের অবসানের পরেও ইরানকে বাগে আনতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের উপর একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমী দুনিয়া। এর পালটা গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে মার্কিন জোটের শরিক, যেমন সৌদি আরব, ইজরায়েল প্রভৃতি দেশের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ শুরু করে ইরান।
২০২২ সাল থেকে পূর্ব ইউরোপের ইউক্রেনকে ঘিরে সংঘাতে জড়িয়েছে রাশিয়া এবং পশ্চিমী জোট। রাশিয়ার বিরুদ্ধেও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে হাতিয়ারের মতো ব্যবহারের চেষ্টা করেছিল আমেরিকা। কিন্তু সেই অস্ত্র বিফলে যায়। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই নিজেদের শর্তে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। এই আবহে এশিয়া এবং আফ্রিকা জুড়ে মার্কিন বলয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলিও নতুন করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে শুরু করেছে।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সৌদি আরব বুঝতে পেরেছে, বদলে যাওয়া আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছাতার তলায় থেকে বিশেষ লাভ নেই। তাই তাঁরা রাশিয়া এবং চিনের মতো দেশগুলির সঙ্গেও সম্পর্ক মজবুত করতে চাইছে। অপরদিকে প্রায় ৪০ বছর ধরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বয়ে চলা ইরানও নতুন জোটসঙ্গী খুঁজছে। সেই শুন্যস্থান পূরণ করতেই ঝাঁপিয়েছে চিন। ইরান এবং সৌদি, দুই তরফই বুঝেছে, ঠান্ডা যুদ্ধের সমীকরণ বজায় রেখে নিজেদের মধ্যে সংঘাত জিইয়ে রাখলে লাভ অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের অপর প্রান্তের একটি দেশের। এই বিভেদের ফলে মধ্যপ্রাচ্যেও শান্তি ফিরবে না। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি না ফিরলে ক্ষতি আখেরে সৌদি এবং ইরানেরই।
ইরান এবং সৌদির মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করায় অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে চলেছে ইজরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যের সমীকরণ অনুযায়ী, ইরানকে নিজেদের পয়লা নম্বর শত্রু মনে করে জায়নবাদী ইজরায়েল রাষ্ট্র। ইরানকে দুর্বল করতে বহুবার সৌদি-ইরান ফাটলকেও কাজে লাগিয়েছে তেল-আভিভ। এখন সেই ক্ষত মেরামত হলে মধ্যপ্রাচ্যে কার্যত একঘরে হবে ইজরায়েল। কারণ, তথাকথিত মার্কিন বলয়ে থাকলেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা একপ্রকার অগ্রাহ্য করেই রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি। চিনের সঙ্গেও তাঁদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। এই আবহে সৌদি-ইরান চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যবাদকে কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
Comments :0