বেকারত্ব, দারিদ্র এবং বৈষম্য বেড়ে চলার সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর ক্রমাগত আক্রমণের বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ২২-২৮ তারিখ দেশজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে সিপিআই(এম)। এরই পাশাপাশি আগামী আর্থিক বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে যে বিষয়গুলি জোর দেওয়া উচিত বলে করেছে সিপিআই(এম), তাও তুলে ধরা হবে প্রতিবাদ আন্দোলনে।
কলকাতায় ২৮-২৯ জানুয়ারি সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শেষে সোমবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ওই প্রতিবাদ কর্মসূচির কথা বিশদে জানানো হয়েছে। ৫ এপ্রিল মজদুর-কিষানদের সংসদ অভিযানকে পূর্ণ সমর্থনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এরই সঙ্গে বিবৃতিতে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ওঠা গুরুতর অভিযোগের সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দাবি, দেশের অর্থনীতির বেহাল দশা, তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব, রাজ্যপালের ভূমিকা এবং ত্রিপুরা নির্বাচনে বিজেপি-কে পরাস্ত করতে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সহযোগিতা চাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ:
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ সংস্থা আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের সুপ্রিম কোর্টের প্রতিদিনের তত্ত্বাবধানে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত জরুরি। দেশবাসীর স্বার্থেই সত্য উদ্ঘাটিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে যতদিন পর্যন্ত তদন্ত চলবে ততদিন যেন দেশের মানুষের সঞ্চিত অর্থ সুরক্ষিত থাকে। আদানির বিভিন্ন সংস্থায় প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা লগ্নি করেছে জীবন বিমা নিগম। আবার স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ৪০ শতাংশ ঋণ নিয়েছে ওই গোষ্ঠী। জীবন বিমা এবং স্টেট ব্যাঙ্কে ভবিষ্যৎ সুরক্ষার কথা ভেবে অর্থ সঞ্চিত রাখেন কোটি কোটি ভারতীয়। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দাম পড়ে গিয়ে ৫ লক্ষ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এর দায়ে কখনোই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলিতে মানুষের জীবনভর সঞ্চয়কে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে না। সংসদের আগামী বাজেট অধিবেশনে আদানিকাণ্ড তোলার ক্ষেত্রে অন্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সঙ্গে সমন্বয় বজায় রেখে চলবে সিপিআই(এম)।
ভারতীয় অর্থনীতি:
মন্দা পরিস্থিতি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতীয় অর্থনীতি ক্রমশ নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কিংবা বিনিয়োগ বাড়ছে—এমন যাবতীয় সরকারি দাবি, ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও শিল্পে উৎপাদন ক্ষমতা মোটেই বৃদ্ধি পায়নি। এর অর্থ যদি ধরে নেওয়া যায় যে কর্মসংস্থান কমেনি, তাহলেও স্থবির হয়ে রয়েছে। যার ফলে দারিদ্র এবং দুর্দশা—দুইও বেড়ে চলেছে।
বৈষম্যের অশ্লীল প্রসার: অক্সফাম রিপোর্টেই স্পষ্ট, দেশের ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদ জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশের কবজায়। ২০২২ সালে দেশের প্রথম সারির ১০ ধনীর মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২৭.৫২ লক্ষ কোটি টাকা। যা ২০২১ সালের তুলনায় ৩২.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের জনসংখ্যার নিচের সারির ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ সম্পদ। ভারতে কোটি কোটিপতির সংখ্যা ২০২০ সালে যেখানে ১২০ জন ছিলেন সেখানে ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৬৬ জন। উলটোদিকে ২৩ কোটির বেশি ভারতবাসী রয়েছেন চরম দারিদ্র, যা বিশ্বে সর্বাধিক।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ভারতের পশ্চাৎমুখী কর কাঠামোর ফলে নিচের সারির ৫০ শতাংশ মানুষ ৬ গুণ বেশি অপ্রত্যক্ষ কর দেন উপার্জনের নিরিখে উপরের সারির ১০ শতাংশের তুলনায়। দেশের নিচের সারির ৫০ শতাংশের কাছ থেকে খাদ্য এবং খাদ্য বহিভূর্ত পণ্যে আরোপিত মোট করের ৬৪.৩ শতাংশ আদায় হয়।
এখনই সময় হয়েছে ধনীদের যে কর ছাড়ের ব্যবস্থা করেছে মোদী সরকার তা বদলে ফেলতে হবে। এরই সঙ্গে সম্পদ কর ও উত্তরাধিকার কর চালুর পাশাপাশি সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে জিএসটি প্রত্যাহার করতে হবে।
তীক্ষ্ণ সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ:
নানাভাবে তীক্ষ্ণ সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের উদ্যোগ আরও ত্বরান্বিত করা চেষ্টা চলছে। সমস্ত বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকার নিজ নিজ রাজ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার কথা ঘোষণা করেছে। এরই সঙ্গে ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’ তুলে দেওয়া নিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সমস্ত বিজেপি শাসিত রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলিমদের আরও বেশি কোনঠাসা করার লক্ষ্যে ‘লাভ জিহাদ’ কিংবা ‘গো সুরক্ষা’র মতো আইন চালু করেছে। স্বেচ্ছা ধর্মান্তরকরণ এবং ভিন্ন ধর্ম বা অসবর্ণ বিয়ের ওপর কার্যত নিষেধাজ্ঞা চাপানোর পক্ষান্তরে কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এরই সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে মুসলিম পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিদ্বেষের মাত্রা।
মুসলিম সংখ্যালঘুদের জন্য সংবিধান বর্ণিত অধিকারকে উপেক্ষা করে অত্যন্ত আক্রমণাত্মকভাবে হিংসাত্মক সাম্প্রদায়িক প্রচার চালাচ্ছে উত্তর প্রদেশ সরকার। রাজ্যের বেরিলি জেলার এক স্কুলে একটি জনপ্রিয় ঊর্দু প্রার্থনা সঙ্গীত গাওয়ার জন্য পড়ুয়াদের সাসপেন্ড করা হয়েছে।
ছত্তিশগড়ের উত্তর বস্তার জেলায় ব্যাপক হারে আক্রমণ হচ্ছে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর। জোর করে ধর্মান্তরকরণ করা হচ্ছে প্রচার চালিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে অথচ বাস্তবে এমন ঘটনা ঘটছেই না। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণের লক্ষ্যেই এই কাজকে মদত জোগানো হচ্ছে। একই সঙ্গে আরএসএস-বিজেপি’র মদতে বজরঙ দলের ‘ঘর ওয়াপসি’ কর্মসূচি জোর করে মেনে নেওয়ার জন্যও মদত জোগানো চলছে। হিংসাত্মক অপরাধের ঘটনা ঘটছে বিশেষত মহিলা এবং শিশুদের বিরুদ্ধে।
এক বিজেপি সাংসদ তথা কুস্তি সংস্থার সভাপতির আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পদক পাওয়া এক মহিলা কুস্তিগীর গুরুতর অভিযোগ করেছেন। সেই কর্তার বিরুদ্ধে সরকার কিংবা বিজেপি কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি।
বিলকিস বানো মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের নিঃশর্ত মুক্তির পর পুনের মহসিন শেখ হত্যা ও দাঙ্গায় অভিযুক্ত ২১ অপরাধীকে শুধু মুক্তিই দেওয়া হয়নি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে তাদের বিপুলভাবে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়। এখনও পর্যন্ত পুলিশ কিংবা প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করা আগ্রহ দেখায়নি।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব:
‘পোষ্য’ বিচার বিভাগ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকার সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগে হস্তক্ষেপ করছে। ইচ্ছাকৃতভাবে বিচারপতি নিয়োগে কলেজিয়ামের সুপারিশ হয় প্রত্যাখ্যান, নয়তো টালবাহানা করছে। আসলে বিচার বিভাগ থেকে প্রশাসন তাদের অধস্তন হয়ে থাকুক, এটাই চায় মোদী সরকার। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষয়কে সাংবিধানিক দিক থেকে আধিপত্যবাদেরই সম্পূর্ণ দখলদারি বলা হয়ে থাকে।
রাজ্যপালের ভূমিকা:
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর ক্রমাগত হামলার অঙ্গ হিসাবে অ-বিজেপি রাজ্য কিংবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রাজ্যপাল এবং লেফটেন্যান্ট গভর্নররা সাংবিধানিক পদকে লঙ্ঘন করে শাসক দলের রাজনৈতিক লক্ষপূরণে কাজ করে চলেছেন। কেরালা, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, তামিলনাডুর রাজ্যপাল এবং কেন্দ্রশাসিত দিল্লি, লাক্ষাদ্বীপ, আন্দামান এবং পুদুচেরির লেফটেন্যান্ট গভর্নর সাংবিধানিক পদকে ব্যাপকভাবে অপব্যবহার করছেন। রাজ্যপালের দপ্তরকে রাজ্য সরকারের সাংবিধানিক কাজকে খর্ব করার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিরোধী প্রবণতা এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ঝোঁক স্পষ্ট হচ্ছে।
ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচন:
আইনের ধারা এবং গণতন্ত্র খর্ব করে যেভাবে হিংসা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি চালাচ্ছে বিজেপি সরকার, তাকে হটাতে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তির সহযোগিতা চেয়েছে সিপিআই(এম)। যেভাবে হিংসা ছড়ানো হচ্ছে তাতে স্পষ্ট যে এমন একটা সন্ত্রাস ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয় যাতে সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচনের ওপর প্রভাব পড়ে। এক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ এবং অতি সক্রিয় হস্তক্ষেপ সুনিশ্চিত করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক অধিকার অবশ্যই ফিরে আসা জরুরি ত্রিপুরায় যদি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব হয়।
কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান:
১. ত্রিপুরায় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠাই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রাক-শর্ত হওয়া প্রয়োজন। এই লক্ষ্যেই রাজ্যবাসী এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির প্রতি সংহতি জানানো হয়েছে।
এই সংহতি জানানোর লক্ষ্যে সারা দেশেই কর্মসূচি চালাবে সিপিআই(এম)।
২. দেশজুড়ে ফেব্রুয়ারির ২২-২৮ প্রতিবাদ কর্মসূচি চলবে জনগণের জীবন-জীবিকার ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে।
এরই সঙ্গে ২০২৩-২৪ সালের বাজেটে আরও কিছু বিষয় তুলে ধরা হবে।
ক) কর্মসংস্থানমুখী পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি
খ) ৫ কেজি বিনামূল্যের সঙ্গে ৫ কেজি ভরতুকিযুক্ত খাদ্যসশ্য সরবরাহ চালু করা।
গ) মজুরি বাড়িয়ে আরও ব্যাপকভাবে রেগা চালু করা।
ঘ) সম্পদ ও উত্তরাধিকার কর আরোপ।
ঙ) ধনীদের কর ছাড় প্রত্যাহার এবং অতি ধনীদের ওপর কর আরোপ।
চ) ওষুধ সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থেকে জিএসটি প্রত্যাহার।
৩. ৫ এপ্রিল মজদুর-কিষানদের সংসদ অভিযানকে পূর্ণ সমর্থন।
মার্চ মাসে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি নিয়ে দেশব্যাপী রাজনৈতিক প্রচার চালাবে সিপিআই(এম)
ক) যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠমোর ওপর আঘাত ও ধ্বংসের চেষ্টা এবং অ-বিজেপি রাজ্য সরকারকে উৎখাতের বিরুদ্ধে প্রচার চলবে।
খ) বিজেপি সরকারের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্বের চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হবে। এই প্রশ্নে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেওবা হবে।
গ) সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সুনিশ্চিত করতে নির্বাচনী সংস্কার জরুরি। সিপিআই(এম)’র ২৩তম কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে নির্বাচনী সংস্কারের যেসমস্ত কথা উল্লেখ করা আছে তা অবিলম্বে চালু করতে হবে।
Comments :0