প্রসূন ভট্টাচার্য: কলকাতা
বৈষম্য ও বেকারি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার অর্থনৈতিক অপরাধ ঘটছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সিপিআই(এম)’র কলকাতা জেলা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা। সম্মেলনে তাঁরা অভিযোগ করেছেন, কোনও শিল্প ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি না হওয়ায় কলকাতায় বেকারি বাড়ছে। মেধাবীরা রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, অন্যরা অসংগঠিত ক্ষেত্রে নামমাত্র মজুরিতে আধা-বেকারের মতো জীবনযাপন করছেন। বেআইনি নির্মাণ থেকে বেআইনি পার্কিং, শাসক দলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতারা দুষ্কৃতীযোগে বিপুল টাকা তুলছেন এবং সেই টাকায় বেকার ও আধা-বেকারদের একাংশকে লুম্পেনবাহিনীর মতো ব্যবহার করছেন।
সিপিআই(এম)’র কলকাতা জেলা ২৬তম সম্মেলন চলছে প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে, সোমবার শেষ হবে। বিদায়ী জেলা সম্পাদক কল্লোল মজুমদারের উত্থাপন করা খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনের ওপরে আলোচনায় প্রতিনিধিরা কলকাতার মানুষের সমস্যাগুলি তুলে ধরছেন এবং দুর্নীতি ও দুষ্কৃতীতন্ত্রের অবসান ঘটাতে কলকাতার গরিব মানুষকে সংগঠিত করার ওপরে জোর দিচ্ছেন। মেট্রোপলিটন শহর কলকাতায় প্রায় আধ কোটি মানুষের বাস। বহু ভাষা, ধর্ম, জাতির শহরে তৃণমূল এবং বিজেপি’র কার্যকলাপে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবক্ষয়ে রীতিমতো চিন্তিত সিপিআই(এম)’র প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলছেন, শহরের গরিব মানুষের মধ্যে পার্টির ভিত্তিকে প্রসারিত করে তীব্র আন্দোলন গড়ে না তুলতে পারলে এই বিপদকে ঠেকানো যাবে না। এই গরিব অংশই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। কিন্তু সন্ত্রাস এবং সরকারি প্রকল্পের সুযোগ দেওয়ার নামে তৃণমূল একদিকে তাদের কবজা করে রাখছে, অন্যদিকে, সাম্প্রদায়িক উসকানি ছড়াচ্ছে বিজেপি। তাঁদের শ্রেণি সচেতনতায় ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে হবে সিপিআই(এম)-কেই।
সম্মেলনে প্রতিনিধিরা কলকাতার বেহাল গণপরিবহণ থেকে শুরু করে নাগরিক পরিষেবার উল্লেখ করলেও সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায়। তাঁরা বলেছেন, গত ১৩ বছরে নতুন করে শিল্প তো হয়েইনি, বরং পুরানো শিল্প-কারখানাগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বন্ধ কারখানা ও রুগ্ণ কারখানার জমি, এমনকি চালু সরকারি সংস্থার জমিও বেআইনি প্রোমোটিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। কলকাতা কর্পোরেশন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শূন্যপদ রয়ে গিয়েছে, স্থায়ী নিয়োগের বদলে ঠিকা নিয়োগ করা হচ্ছে। এসবের ফলে কাজের সুযোগ কমছে এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরতদের মজুরির হারও বাড়ার বদলে কমছে। নামতে নামতে তা ১২ হাজার টাকার কাছাকাছি হয়ে গিয়েছে। উপার্জনের জন্য কেউ দিনে একটা কাজ করে রাতে আরেকটা কাজ করছেন। সামান্য উপার্জনের জন্যও ঠিকা নিয়োগ পেতে, পার্কিং লটের টাকা তুলতে, অটো-টোটো চালানোর সুযোগ পেতে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের কথায় ওঠাবসা করতে হচ্ছে। এসবে কাজ না হলে রয়েছে সন্ত্রাস। বন্দর থেকে বেলেঘাটা কোথাও যদি লাল ঝান্ডা হাতে গরিব মানুষ সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলেই হামলা নামিয়ে আনছে তৃণমূলের বাহিনী।
প্রতিনিধিরা বলেছেন, এমনকি গরিব বস্তি এলাকাতে গিয়েও আমরা গণসংগ্রহে ভালো সাড়া পেয়েছি। মানুষ আমাদের সাহায্য করতে রাজি, কিন্তু বিন্দুমাত্র জায়গা ছাড়তেও রাজি নয় তৃণমূল। স্থানীয় ইস্যুতে আমাদের প্রতিবাদ কর্মসূচিকে বিনা বাধায় করতে দেওয়া তো দূরের কথা, এমনকি গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করতে গেলেও আক্রান্ত হতে হচ্ছে।
কলকাতার গরিবদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বাস্তবিক চ্যালেঞ্জকে এভাবেই তুলে ধরেছেন প্রতিনিধিরা। কলকাতার অর্থনীতির অপরাধকরণ সরাসরি প্রভাব ফেলছে কলকাতার পরিবেশ এবং মহিলাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও। অপরিকল্পিত নির্মাণে জলস্তর নেমে যাচ্ছে, পুকুর মাঠ লোপাট হয়ে যাচ্ছে, গাছ কাটা পড়ছে, দূষণ বাড়তে বাড়তে কলকাতা দেশের দ্বিতীয় দূষিত শহরে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, দুষ্কৃতী দাপটে মহিলারা আক্রান্ত হচ্ছেন। থ্রেট কালচার সর্বত্র বিরাজ করছে। তবে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও রেহাই পাচ্ছেন না দলের অন্তর্দ্বন্দ্বের ছোবল থেকে।
আর জি কর আন্দোলনে মানুষের ব্যাপক সাড়ার উল্লেখ করে প্রতিনিধিরা বলেছেন, যেভাবে মানুষ সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন, বিশেষত মহিলারা, তাতে মানুষের মধ্যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ স্পষ্ট। কিন্তু নৃশংস বর্বর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার চাইতে অরাজনৈতিকভাবে রাস্তায় নেমে আসা মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করে ন্যায় বিচার ছিনিয়ে আনার ক্ষেত্রে এখনও আমাদের অনেক দুর্বলতা রয়ে গিয়েছে। নাগরিক আন্দোলনে শামিল মানুষকে সচেতন ও পরিণত করে তুলে রাজনৈতিক আন্দোলনে শামিল করার জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে।
Comments :0