জেলায় যত পরিবারের বাস, তার থেকে বেশি স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আছে!
জানাচ্ছে রাজ্য সরকারের নথি। এমন কাণ্ড শুধু ‘সততার’, ‘স্বচ্ছতার’ প্রতিকের সরকারই করতে পারে। স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প থেকেও তৃণমূল টাকা লুট করেছে — এই ভুয়ো কার্ডের সূত্রেই সেই অভিযোগও উঠছে এবার। অর্থাৎ মানুষকে বঞ্চিত করে চিকিৎসার থেকেও লুট হয়েছে রাজ্যে।
প্রমাণ বেশ কয়েকটি জেলা। যেমন আলিপুরদুয়ার।
গত বছর প্রকাশিত হয়েছে আলিপুরদুয়ারের ‘জেলা সার্ভে রিপোর্ট।’ সেই ৫১৬ পাতার রিপোর্টের ৪০-৪১ পাতায় জেলার জনসংখ্যা লেখা হয়েছে। আছে ব্লক ভিত্তিক তথ্যও। জেলা প্রশাসনের সেই রিপোর্ট জানাচ্ছে, আলিপুরদুয়ারে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩,১৯,৬৯৭। জনসংখ্যা ১৪,২৬,০১৮জন। আর গত জানুয়ারিতে রাজ্য সরকার স্বাস্থ্যবিমার পরিচালনা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার প্রকল্প নথি প্রকাশ করেছে। ৯৭ পাতার সেই নথির ১৩নং পাতা জানাচ্ছে ২০২২-র ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত আলিপুরদুয়ার জেলায় ৪,০৩,২০৬টি পরিবার স্বাস্থ্যবিমার আওতায় এসেছে।
বাড়তি দেখানো হয়েছে প্রায় ৮৩ হাজার পরিবার। কেন? প্রশ্ন এখানেই। তাহলে কী এই বাড়তি থাকা কার্ড দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলীরা ব্যবহার করছে? বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোমগুলিকে কিছু টাকা দিয়ে ওই ভুয়ো কার্ডগুলিকে ব্যবহার করে সরকারের থেকে টাকা তুলছে? আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না আলিপুরদুয়ারের জেলা প্রশাসনের আধিকারিকরা। তবে কেউ নাম বলতে চাননি।
এমনই বিস্ময়কর তথ্য পশ্চিম বর্ধমানেও। সেখানে মোট জনসংখ্যাই ৩১লক্ষের আশপাশে। আর রাজ্য সরকার দাবি করছে, সেই জেলায় ২৩লক্ষ ৩৩হাজার ৩২৫টি পরিবারকে স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় আনা হয়েছে। একেকটি পরিবার সর্বনিম্ন ২জন হলেও, জেলার জনসংখ্যা প্রায় ৪৭লক্ষ হয়। অথচ জনসংখ্যা তার অনেক কম। তাহলে এত কার্ড কার হাতে? বলাবাহুল্য, প্রশাসনের একাংশের সহযোগিতায় তৃণমূলীরাই এই কার্ডগুলি হস্তগত করেছে আশঙ্কা।
তবে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের আওতায় আসা পরিবার নিয়ে অসঙ্গতি আরও জেলাতে আছে বলেই আশঙ্কা। দলের চুরির হাত এখানেও পড়েছে বুঝতে পেরেই সম্প্রতি মমতা ব্যানার্জি এই প্রকল্পের দায়িত্ব বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন সম্প্রতি।
অসঙ্গতি আরও।
যেমন, দার্জিলিঙে প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১৫লক্ষ পরিবার। আর দক্ষিণ ২৪ পরগনায়? ৪লক্ষ ৫১ হাজার!
আয়তনে দার্জিলিঙের থেকে অনেক বড় দক্ষিণ ২৪ পরগনা। জনসংখ্যাও অনেক বেশি। তাহলে স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় আসা পরিবারের সংখ্যায় এত তফাৎ কেন? রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরের কোনও আধিকারিক এই বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি।
শুধু দক্ষিণ ২৪ পরগনা নয়। স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের আওতায় আসা পরিবারের যে তথ্য রাজ্য সরকার প্রকাশ করেছে, তাতে আরও বেশ কিছু অসঙ্গতি।
রাজ্যের আর একটি বড় জেলা উত্তর ২৪ পরগনা। জেলায় শুধু রেগার জবকার্ড আছে ১০লক্ষ ৭হাজার। রেগার জবকার্ডধারীরা গ্রামবাসী। সব গ্রামবাসী পরিবারের জবকার্ড নেই। ফলে গ্রামবাসী পরিবারের সংখ্যা জবকার্ডধারীদের থেকে কিছুটা বেশিই। তাছাড়া জেলায় আছে অনেকগুলি পৌরসভা। রাজ্যে সবচেয়ে বেশি পৌরসভা এই জেলাতেই। আছে বিস্তীর্ণ শিল্পাঞ্চল। অনেক শ্রমিকের বসবাস। আছেন শহরাঞ্চলের বস্তিবাসীরাও। তবু সেই জেলায় স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের আওতায় আছে মাত্র ৭লক্ষ ৫৭ হাজার ৮০৬টি পরিবার।
অর্থাৎ উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা বেশিরভাগ পরিবার রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আসেননি।
আদিবাসী প্রধান জেলা ঝাড়গ্রাম। আদিবাসীরা ছাড়াও আছেন আরও অনেকে। জেলার বেশিরভাগ মানুষ গরিব, শ্রমজীবী। রাজ্য সরকারেরই হিসাবে রেগার জবকার্ড আছে ২লক্ষ ৬৫ হাজার ১৩৪টি পরিবারের। জেলাটিতে আছে শহরও। তবু সেই জেলায় স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের আওতায় এসেছে মাত্র ৫৫,২১৪টি পরিবার। জলপাইগুড়িতে স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় এসেছেন ৩লক্ষ ৪৬ হাজার ৮৫৯টি পরিবার। অথচ এই জেলায় জবকার্ডধারী পরিবারই ৪লক্ষ ৪৪হাজার ১৪২টি। তার উপর এই জেলাতেও আছে শহরাঞ্চল। অর্থাৎ বিপুল মানুষ বাদ এই জেলারও স্বাস্থ্যবিমা থেকে। একই হাল পশ্চিম মেদিনীপুরে। রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর জানাচ্ছে স্বাস্থ্যবিমার কার্ড হয়েছে ৬লক্ষ ৬৫ হাজার ৬২৮টি পরিবারের। অথচ এই জেলাতেও রেগার জবকার্ড আছে ৯লক্ষ ৩৭ হাজার ২৪৬টি পরিবারের। অর্থাৎ গ্রামবাসীদেরই সবার স্বাস্থ্যসাথী কার্ড হয়নি। তার উপর আছে মেদিনীপুর, ঘাটাল, ক্ষীরপাইয়ের মতো অনেকগুলি শহর।
কলকাতাতেও ভয়ঙ্কর ছবি। কলকাতার জনসংখ্যা প্রায় ১কোটি ৫০লক্ষ। পরিবার প্রায় ৩৩লক্ষ। সেখানে স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় আছে ৬লক্ষ ৮২হাজার ৩১৫টি পরিবার। অর্থাৎ বিপুল অংশের মানুষ এই প্রকল্পের বাইরে। কলকাতার বাসিন্দা বড় অংশের মানুষ বস্তিবাসী। এছাড়াও আছেন অসংগঠিত শ্রমজীবীরা। সেই মহানগরে স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় অনেক গরিব পরিবারই বাদ গেছেন।
অর্থাৎ কোনও কোনও জেলায় মোট পরিবারের থেকে অনেক বেশি কার্ড। আবার কোনও কোনও জেলায় মোট পরিবারের সামান্য অংশই স্বাস্থ্যসাথীর আওতায় এসেছেন। পরিষেবা পেয়েছেন মোট আওতায় আসা পরিবারগুলির ০.১৭%।
প্রশ্ন উঠেছে সেখানেও চুরি হয়েছে। মানুষ হয়রান হয়েছেন। আর কার্ড দখলে রেখে তৃণমূলের নেতা, কর্মীরা টাকা তুলেছে বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোমকে ‘ম্যানেজ’ করে।
Comments :0