এ রাজ্যের পঞ্চায়ত সারা দেশে নজির ছিল। সেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংস করে ছেড়েছে তৃণমূল সরকার। সেই ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনতে ফের মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগ স্থাপন করতে হবে। একইসঙ্গে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। মঙ্গলবার এক সভাতে এমনটাই জানালেন বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম এবং সূর্য মিশ্র।
মঙ্গলবার জ্যোতি বসুর ১৪তম প্রয়াণ দিবসে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল জ্যোতি বসু সেন্টার ফর সোশ্যাল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ। ‘‘পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা- জ্যোতি বসুর ভাবনা, আজকের দূরবস্থা ও ভবিষ্যতের রূপরেখা’’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম)’র পলিটব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্র এবং পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তাঁদের বক্তব্যের নির্যাস, ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার চালানোর দায়িত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের পথে হাঁটে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। তারফলে ১৯৭৭ সালে রাজ্যের দায়িত্বে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই ১৯৭৮ সালে রাজ্যে তৃস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন সংগঠিত হয়। গণতান্ত্রিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়াও আদিবাসী, তপশিলী,আদিবাসী এবং মহিলাদেরও প্রভূত উন্নয়ন হয়েছিল। এই ব্যবস্থার হাত ধরেই ১৮ বছর বয়সে ভোটাধিকারের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে যা পরবর্তীকালে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
এদিনের সভা পরিচালনা করেন বিমান বসু। তিনি নিজের বক্তব্যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গ্রাম সংসদের গুরুত্ব তুলে ধরেন। নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়ে বিমান বসু বলেন, সভায় আসার আগে জ্যোতি বসু নগর সংলগ্ন গ্রামে কিছুক্ষণ গিয়েছিলাম। সেখানকার স্থানীয় মানুষের কথায়, গ্রামে পাকা রাস্তা তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল গ্রাম সংসদের সভায়। সেই সিদ্ধান্ত পাঠানো হয় তৎকালীন জেলা পরিষদের সভাধিপতি অপর্ণা গুপ্তের কাছে। বিমান বসু বলেন, পরবর্তীকালে অপর্ণা গুপ্ত আমায় বলেছিলেন, এই রাস্তা তৈরিতে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। রাস্তা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। আমি কেবলমাত্র সেই সিদ্ধান্তে সরকারি শিলমোহর বসিয়েছিলাম। বর্তমান পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় এই ঘটনা কল্পনাও করা যায়না।
সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে সূর্য মিশ্র বলেন, জ্যোতি বসুর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল, রাজ্যের সরকার চালানোর মধ্য দিয়ে যতটুকু কাজের সুযোগ আছে, সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ আছে, তাকেই কাজে লাগাতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই প্রথমে করা হয় ভূমি সংস্কার। জমির বিকেন্দ্রীকরণ পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পথ প্রশস্ত করে। সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়েই আদিবাসী, তপশিলী, মহিলা, সংখ্যালঘু সহ সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষের ‘বন্ধু’ হয়ে ওঠে বামফ্রন্ট সরকার। এরাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই মহিলা, আদিবাসী এবং তপশিলী অংশের মানুষের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হয়। ১৮ বছরে ভোটাধিকার কিংবা গ্রাম এবং শহরে পৌরসভা এবং পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় সরকারের ভিত্তি মজবুত করা- সমস্তটাই হয়েছে জ্যোতি বসুর দেখানো পথে। জ্যোতি বসুর মস্ত বড় গুণ ছিল তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষমতা। তারফলেই বহু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অযথা কালবিলম্ব হয়নি, যার সুফল পয়েছেন বাংলার কয়েক কোটি মানুষ।
নিজের বক্তব্যে মহম্মদ সেলিম বলেন, বর্তমান কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করে ফেলেছে। এটাই দক্ষিণপন্থার চরিত্র। অপরদিকে বামপন্থীরা প্রথম থেকেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করেছেন। টাকার জোরে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কিনে নেওয়া হয়েছে। এবং সেই টাকার জোগান দিয়েছে চিটফান্ডগুলো। চিটফান্ডের টাকায় জেতা লোকজন এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে বসে রয়েছে বলে বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে কোনও চর্চা হয় না। অষ্টমীর সাজ নিয়ে টিভিতে আলোচনা হলেও শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি নিয়ে কিছুদিন আগেও কোনও কথা হত না। কিন্তু রাস্তার আন্দোলনের জোর বাড়তেই এই বিষয়গুলি টেলিভিশনের নিউজ রুমেও উঠে আসছে। এই লড়াই আরও তীব্র করে নতুন বাংলা গড়তে হবে।
ছবি: দিলীপ সেন
Comments :0