নিয়োগ দুর্নীতিতে এবার প্রকাশ্যেই এল মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির ক্যামাক স্ট্রিটের অফিস। রাজ্যে সরকারি ক্ষমতার প্রায় সমান্তরাল ভরকেন্দ্রে পরিণত হওয়া এই ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসের সামনেই বঞ্চিত মেধাবী চাকরিপ্রার্থীরা বিক্ষোভ করছিল, পরিণামে জুটেছিল পুলিশের লাঠির বাড়ি।
সেই ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসেই বসেন সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র। নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে এই ব্যক্তিই হলো সেই ‘কালীঘাটের কাকু’। গত ২৩ জানুয়ারি গণশক্তি পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল সেই খবর।
মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সামনেই নিয়োগকাণ্ডে ধৃত তাপস মণ্ডল জানান, ‘কুন্তল ঘোষই বারেবারে কালীঘাটের কাকুর কথা বলতো। কালীঘাটের কাকুকে টাকা দিতে হবে, বলতো সে। সুজয় ভদ্রই সেই কালীঘাটের কাকু’। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই-র কাছেও তিনি তা জানিয়েছেন। জানা গেছে, লাগাতার জেরার মুখে নিয়োগকাণ্ডে ধৃত যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষও ইতিমধ্যে সিবিআই-র কাছে ‘কালীঘাটের কাকু’ সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন।
‘কালীঘাটের কাকু’ এখন নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছেন। সাংসদ ও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বলেই সুজয় ভদ্রকে চেনেন শাসক তৃণমূলের লোকজনও। সেই সুজয় কৃষ্ণ ভদ্রকে কেন নিয়োগ দুর্নীতির কোটি কোটি টাকা দিতে হত, তাই জানতে চাইছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই।
অভিষেক ব্যানার্জির অফিসে বসা এই ব্যক্তিকে, একসময়ের অভিষেক ব্যানার্জির ব্যবসায়ের, সংস্থার পার্টনার সুজয় ভদ্রকে কেন বছরের পর বছর প্রাইমারি থেকে এসএসসি-র নিয়োগ দুর্নীতি থেকে তোলা কোটি কোটি টাকা দিতে হত? সুজয় ভদ্রই সেই টাকা নিতেন নাকি কারো হয়ে সেই টাকা তিনি সংগ্রহ করতেন, তদন্তের গতিপথে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা আধিকারিকরা।
মঙ্গলবার নিজাম প্যালেস থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এসএসকেএম হাসপাতলে নিয়ে যাওয়া এবং ফেরত আসার পথে সাংবাদিকদের সামনে প্রকাশ্যেই কালীঘাটের কাকুর সম্পর্কে জানিয়েছেন শিক্ষা ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডল। ‘কুন্তলকে জিজ্ঞাসা করলেই তো জানা যাবে। ওই তো বলতো কালীঘাটের কাকুর কথা। কালীঘাটের কাকুকে টাকা দিতে, কালীঘাটের কাকুর কাছে যেতে হবে। আমি চিনি। নাম শুনেছিলাম সুজয় ভদ্র, বাকি কিছু জানি না। আপনারাই খোঁজ নিন’।
তদন্তের গতিপথে এবার প্রকাশ্যেই এল অভিষেক-যোগ। কয়লা পাচারকাণ্ডের তদন্তের পরে এবার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ দুর্নীতিতে।
বলাগড়ের বাসিন্দা যুব তৃণমূল রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষ যে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলেছিল তার একটা বড় অংশ পৌঁছাতো এই ‘কালীঘাটের কাকু’র কাছে। তবে এটাই চূড়ান্ত গন্তব্য ছিল না। ওই ব্যক্তি মূলত মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ছিলেন, তাঁর হাত ঘুরেই টাকা পৌঁছাতে একেবারে শীর্ষ প্রভাবশালীর কাছে। এমনটাই মনে করছেন তদন্তকারী আধিকারিকরাও।
সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’ পথ চলার সময় বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সের মেম্বার ছিলেন। একসময় অভিষেক ব্যানার্জি এই সংস্থার কর্ণধার ছিলেন। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে বোর্ড অফ ডিরেক্টর্স থেকে পদত্যাগ করেন। ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’ –এর অর্থ ‘অত্যন্ত দ্রুত গতিতে উত্থান’! এই সংস্থার উত্থানও নামের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। বর্তমানে অভিষেক ব্যানার্জিও যেমন খাতায় কলমে নেই তেমনি সুজয় কৃষ্ণ ভদ্রও সংস্থার ডিরেক্টর পদে নেই। ২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল ভাইপো সাংসদ অভিষেকের সঙ্গেই এই সংস্থার অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। এখন ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’র বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সে রয়েছেন দু’জন- অমিত ব্যানার্জি ও লতা ব্যানার্জি।
ফলে সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র অভিষেক ব্যানার্জির কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন তা স্পষ্ট। হাজার হাজার নিয়োগ প্রার্থীদের প্রতারিত করে তোলা কোটি কোটি টাকা যদি কুন্তল ঘোষকে পাঠাতে হতো সুজয় কৃষ্ণ ভদ্রকে তাহলে সেই টাকার আসল গন্তব্য কী? এবার সেটাই স্পষ্ট করে জানতে চাইছে তদন্তকারী সংস্থা।
২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে আগে যখন নারদ স্টিং অপারেশনের ভিডিও ফুটেজ সামনে এসেছিল তখনই প্রথম জানা যায় এই ব্যক্তির প্রসঙ্গে। ঐ স্টিং অপারেশনের সম্প্রচারিত ফুটেজেও অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে এক যুবকের সঙ্গে লেনদেনের ছবি দেখা গেছে।সঙ্গে মাঝবয়সি আরেকজন, যার পরিচয় দেওয়া হচ্ছে সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র নামে। ফুটেজে দেখা যায় ম্যাথু স্যামুয়েলের কাছে ওই যুবক দাবি করেছিল, একেবারে সঠিক ব্যক্তির কাছে এসেছেন। সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র নামে ওই ব্যক্তি রাজ্যের মন্ত্রীদের সঙ্গে, অভিষেক ব্যানার্জির সঙ্গেও কথা বলিয়ে দিতে পারবে। অভিষেক ব্যানার্জির খুবই ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করা হয়।
নিয়োগ দুর্নীতির বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের তদন্তে এবার কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা তাই সুজয় ভদ্রকে তলবের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেই জানা গেছে।
Comments :0