কয়লা পাচারকাণ্ডে মনজিৎ সিং গ্রেওয়াল ওরফে জিট্টি ভাইয়ের সঙ্গে যৌথ সম্পত্তির পরে ফের নিয়োগ দুর্নীতিতে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের প্রসঙ্গ সামনে এল। এল মুখ্যমন্ত্রীর সেই ভাই সমীর ওরফে কার্তিক ব্যানার্জির নাম। নিয়োগকাণ্ডে ধৃত ‘সৎ রঞ্জন’ ওরফে চন্দন মণ্ডলের গ্রামের বাসিন্দাদেরই অভিযোগ, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ভাই তো গাড়ি করে কলকাতা থেকে আসতেন গ্রামে।
কালীপুজোর সময়েও আসতেন, অন্য সময়েও আসতেন। মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কলকাতা থেকে এত দূরে এই অজ গাঁয়ে যদি চন্দন মণ্ডলের বাড়িতে আসেন তাহলে আর সাধারণ মানুষের দোষ কী, তাঁরা চন্দন মণ্ডলের বাড়িতে লাইন দিয়ে টাকা দেবে চাকরির জন্য এটাই তো স্বাভাবিক। গ্রামবাসী মানে নিতান্তই সাধারণ মানুষ নন। খোদ বাগদার তৃণমূলী পঞ্চায়েত এক সদস্যের দাবি এমনই। সংবাদ মাধ্যমের সামনে প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন এমন অভিযোগ।
গ্যারান্টি সহকারে টাকার বিনিময়ে সরকারি স্কুলে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ এই চন্দন মণ্ডল। খালি খাতা জমা দিলেও মিলবে চাকরি, পশ্চিমবঙ্গে এই মডেল কার্যকর করতে তৃণমূলের শীর্ষনেতা, মন্ত্রীদের হয়ে মাঠে নেমেছিল এই চন্দন মণ্ডলরাই। নিয়োগ দুর্নীতিতে অযোগ্য প্রার্থীদের কাছ থেকে তোলা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা গাড়িতে করে কলকাতায় নির্দিষ্ট ঠিকানায় পাঠাতেন এই চন্দন মণ্ডল। এফআইআর দায়েরের আট মাসের বেশি সময় পরে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সিবিআই গ্রেপ্তার করে চন্দনকে।
মামাভাগিনা গ্রামের বাসিন্দা চন্দন মণ্ডল। তিনি আবার স্থানীয় স্কুলের প্যারাটিচার। গ্রামবাসীদের একাংশের কথায়, এখন বিপুল সম্পত্তির মালিক এই চন্দন মণ্ডল। শিক্ষকের বাড়িতে সাধারণভাবে সরস্বতী পুজো হয়। কিন্তু চন্দন মণ্ডলের বাড়িতে সরস্বতী পুজো নয়, ধুমধাম করে হতো কালীপুজো। সেই পুজোয় আলো করে থাকতেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক ব্যানার্জি।
একজন গ্রামের সাধারণ প্যারাটিচারের বাড়িতে কালীঘাট থেকে গাড়ি করে কেন যেতে হতো বারেবারে কার্তিক ব্যানার্জিকে, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দফায় দফায় জেরার মুখে এখন সেই চন্দন মণ্ডল। গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রে জানা গেছে, দফায় দফায় জেরার মুখে প্রভাবশালীদের সম্পর্কে প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলেও ক্রমেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন এই চন্দন মণ্ডল। কার্তিক ব্যানার্জির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার তথ্যও জানতে চাইছে সিবিআই।
এই চন্দন মণ্ডলের নাম প্রথম সামনে নিয়েছিলে প্রাক্তন মন্ত্রী উপেন বিশ্বাস নিজেই। সাংবাদিকদের সামনে তিনি জানিয়েছিলেন- ‘রঞ্জন বস্তা ভর্তি করে টাকা নিয়ে গাড়িতে তুলে কলকাতায় দিয়ে আসত। কার বাড়িতে দিয়ে আসত তা তো তদন্ত করতে হবে। কিন্তু কলকাতায় টাকা আসত এটা নিশ্চিত।
আর মামাভাগিনা গ্রামের একাধিক বাসিন্দা, এমনকি চন্দন মণ্ডলের আত্মীয়, পড়শিরাও জানিয়েছেন— সিবিআই যে টাকার কথা বলছে সেটা তে নস্যি। কোটি কোটি টাকার কারবার। এক কালীপুজোর বাজেটই ছিল মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। সব প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আসতেন। থানার বড়বাবু থেকে বিডিও আসতেন, মুখ্যমন্ত্রীর ভাই আসতেন। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, টাকা ভর্তি করে গাড়ি যেত কলকাতায়। বিভিন্ন জেলা থেকে শাসক দলের লোকজন আসতো তাঁর বাড়িতে।
তাঁদের আরও অভিযোগ, পুরো গ্রাম খালি করে দিয়েছেন এই চন্দন মণ্ডল। প্রতিটি ঘরের কেউ না কেউ ওঁকে টাকা দিয়েছে, জমি-জমা বেচে, গয়না বেচেও টাকা দিয়েছে। যারা চাকরি পেয়েছিল এখন তাঁদেরও চাকরি যাবে। গোটা গ্রাম শুকিয়ে গেল একটা লোকের প্রতারণায়।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কেন যেতেন চন্দন মণ্ডলের বাড়িতে? যোগসূত্র কী? কালীঘাটের কাকুর পাশাপাশি এখন এই তথ্যও জানতে চাইছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকরা।
এর আগেও কার্তিক ব্যানার্জি প্রসঙ্গ সামনে এসেছে জিট্টি ভাইয়ের কাণ্ডে। যার বিরুদ্ধে কয়লা পাচারকাণ্ডে ‘প্রভাবশালী’ নেতার টাকা লন্ডারিংয়ের অভিযোগ সেই ব্যবসায়ীর সঙ্গে যৌথ সম্পত্তি মিলেছে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক ব্যানার্জির স্ত্রীর।
২০১৭ সালের পর থেকে কয়লার টাকাই বিভিন্নভাবে, একাধিক রিয়েল এস্টেট সংস্থার মাধ্যমে, শিখণ্ডী সংস্থার মাধ্যমে কলকাতা শহরেই বিনিয়োগ হয়েছে। সেই সূত্রেই দিল্লিতে দফায় দফায় এই জিট্টি ভাইকে একাধিকবার জেরা করছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকরা। প্রভাবশালীর টাকাই সাদা করার চক্রে যুক্ত এই জিট্টি ভাই।
এই জিট্টি ভাইকেই মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূলের হিন্দি সেলের সভাপতি বানিয়েছিলেন। কার্তিক ব্যানার্জির দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ জিট্টি ভাই। কার্তিক ব্যানার্জির স্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর নিজের ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজরী ব্যানার্জির সঙ্গে জিট্টি ভাইয়ের ভবানীপুর কেন্দ্রে দুটি সম্পত্তির হদিশ মিলেছে। আবার কাজরী ব্যানার্জির সঙ্গে জিট্টি ভাইয়ের যৌথ সম্পত্তির হদিশ মিলেছে।
ফলে কয়লা পাচারকাণ্ডে মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তে যে জিট্টি ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে তাঁর সঙ্গে যেমন সখ্যতা মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক ব্যানার্জির তেমনি আবার নিয়োগকাণ্ডে ধৃত চন্দন মণ্ডলের সঙ্গেও রহস্যময় সখ্যতার তথ্য হাতে এসেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই’র।
Comments :0