সরকার পরিচালনার দায়িত্ব মানে জমিদারি নয়, ব্যক্তিগত মালিকানা। সরকার জনগণের, সরকারি অর্থও জনগণের। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের হয়ে কাজ করার জন্য। সেই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তৈরি করেন সরকার। সরকারি ক্ষমতা পাওয়া নিজের খেয়ালখুশি মতো চলা নয়। তেমনি সরকারটাকে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি মনে করা যায় না। মন্ত্রী হোন বা মুখ্যমন্ত্রী অথবা প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি সরকারি পাইপয়সাও নিয়মবিধি মেনে খরচ করতে হয় এবং সেই খরচের হিসাবও দিতে হয়। আবার হিসাব অডিটরকে দিয়ে পরীক্ষা করাতে হয় যাতে তাতে কোনও গলদ না থাকে। মন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন বলে যা খুশি করার অধিকার নেই।
ইদানীং নির্বাচিত সরকারগুলির মধ্যে জমিদারি মনোভাব প্রকট হচ্ছে। যেনতেন প্রকারে একবার ক্ষমতা দখল করতে পারলেই তারা মনে করতে শুরু করেন এবার বুঝি যা ইচ্ছে তাই করা যাবে। সরকারি অর্থ যেখানে খুশি, যেমন খুশি খরচ করবেন। কাউকে কৈফিয়ত দেবার দায় নেই। অর্থাৎ সীমাহীন ঔদ্ধত্য ও আধিপত্য নিয়ে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে। এরাজ্যের তথাকথিত মা মাটি মানুষের সরকার এমন মানসিকতারই জ্বলন্ত উদাহরণ। মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন সরকারটা একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত। তিনি যা মনে করবেন তাই করবেন। কোনও সমালোচনা, বিরোধিতা গ্রাহ্য নয়। তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে।
এমন সর্বময় কতৃত্ব করতে গিয়ে সরকার পরিচালনার নিয়ম কানুন সব পরিত্যাগ করেছেন। নিজের ইচ্ছে মতো ইধার কা মাল ওধার করছেন। হিসাবের কোনও বালাই নেই। মিড ডে মিলের টাকা খরচ হচ্ছে কম্বল বিতরণে। আবার দুর্ঘটনায় মৃতদের ক্ষতিপূরণের টাকা আসছে আর একটি খাত থেকে। এমনকি দলীয় কোন্দলে খুন হলেও মুখ্যমন্ত্রীর কৃপায় ক্ষতিপূরণের টাকা আসে সরকারি কোন তহবিল থেকে। একেবারে মগের মুলুক।
দুনিয়া জুড়ে মানুষ এটাই জানে এবং মানে টাকা খরচ করলে সেই টাকার হিসাব সময় মতো দিতে হয়। এই নিয়ম মানা অত্যাবশ্যকীয়। কারণ তা না হলে স্বচ্ছতা থাকে না। টাকা যথাযথভাবে খরচ হয়েছে কিনা সন্দেহ দেখা দিতে পারে। এমনও হতে পারে টাকা খরচ না করে মেরে দেওয়া হয়েছে। অথবা আংশিক খরচ করে বাকিটা পকেটে পুরে ফেলা হয়েছে। এই জন্যই সরকারি অর্থ খরচের হিসাব অডিটর দিয়ে পরীক্ষা করাতে হয়। তেমনি সরকারি কোনও দপ্তরের টাকা পৌরসভা, পঞ্চায়েত বা ঐ ধরনের সংস্থার মাধ্যমে খরচ হলে তাদের ইউটিলাইজেন সার্টিফিকেট (ইউসি) জমা দিতে হয়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ইউসি জমা না পড়লে পরবর্তী ধাপের টাকা বরাদ্দ হয় না। পশ্চিমবঙ্গে এসবের বালাই নেই। এখানে সরকারি টাকা মানে হরিলুটের বাতাসা। যে যেমন পারো লুটেপুটে খাও। রন্ধ্রে রন্ধ্রে চুরি, জোচ্চোরি, অনিয়ম, দুর্নীতি। এমনকি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের জন্য পাওয়াপ টাকারও ইউসি দেওয়া হয় না।
সম্প্রতি জাতীয় হিসাব পরীক্ষা সিএজি তাদের রিপোর্টে গুরুতর অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে। সরকারি প্রকল্পের বিশেষ করে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে দেওয়া কেন্দ্রীয় সরকারি অর্থের হিসাব পরীক্ষা করতে গিয়ে সিএসি’র চক্ষু চড়কগাছ। ২ লক্ষ ২৯ হাজার কোটি টাকা খরচের কোনও হিসাব নেই। খরচ করা হয়েছে কিন্তু কোথায় কিভাবে খরচ হয়েছে বিস্তারিত হিসাব নেই। কেন নেই? তার কোনও সদুত্তরও নেই। হিসাব যদি ঠিক হয় জমা দিতে অসুবিধা থাকার কথা নয়। কিন্তু যদি গরমিল থাকে তাহলে এড়িয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। মমতা ব্যানার্জির সরকারের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। সোয়া দু’লক্ষ কোটি টাকার হিসাবে। কোথায় গেছে সেই টাকা?
Comments :0