মহম্মদ সেলিম
গত ২২ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি সিপিআই(এম)’র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৬তম সম্মেলন হয়েছিল ডানকুনিতে। গত ২ থেকে ৬ এপ্রিল মাদুরাইতে হয়েছে পার্টির ২৪তম কংগ্রেস। পার্টির রাজ্য সম্মেলনের পরে ইতিমধ্যে দু’মাস পার হয়েছে। পার্টির রাজ্য সম্মেলনে নির্দিষ্ট হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে আমাদের এগিয়ে চলার পথ। আমরা বলেছি তৃণমূল এবং হিন্দুত্ববাদী নয়া ফ্যাসিবাদী প্রবণতা আসলে যমজ। দুনিয়া জুড়ে যে দক্ষিণপন্থার উত্থান, ট্রাম্প থেকে মোদী, এর একটি অ্যাপেনডিক্স হলো তৃণমূল। অবশ্যই তার নিজস্ব কিছু চরিত্র আছে। এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। এটিই আজকের সময়ের রাজনীতি। এই লড়াইয়ে আমাদের নিজস্ব শক্তি বাড়াতে হবে।
পার্টি কংগ্রেসে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় ক্ষেত্রের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট পর্যালোচনা হয়েছে। তার ভিত্তিতে কিছু দায়িত্ব আমাদের সামনে হাজির করেছে। পুঁজিবাদ তার দীর্ঘস্থায়ী মন্দায় রয়েছে। সেখান থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি, এমনকি কোনও সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। বাজার সঙ্কুচিত হচ্ছে, মানুষের আয় কমছে। তার ফলে কর্মহীনতা এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে লাগাতার। সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে, দেশের ১ শতাংশ মানুষ ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদের অধিকারী। নয়া আর্থিক নীতিতে মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষিক্ষেত্র। আক্রান্ত কৃষিজীবীরা। অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেণির উপর আক্রমণও বেড়েছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাড়ছে। ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প সহ শ্রমজীবীদের নানা অধিকারের উপর আঘাত আসছে নিরবচ্ছিন্ন। এই পরিস্থিতিতে হিন্দুত্ব-কর্পোরেট আঁতাত তৈরি হয়েছে, যা প্রধানত তিনটি হাতিয়ারকে সামনে রেখে আক্রমণ নামিয়ে আনছে। প্রথমত তাদের হিন্দুত্বের কর্মসূচি। যার মাধ্যমে হিন্দুত্বকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা এবং ধর্মনিপেক্ষ-গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে নয়া ফ্যাসিবাদী আরএসএস-বিজেপি। দ্বিতীয়ত, সংসদীয় ব্যবস্থাকে দুর্বল, সঙ্কুচিত করে তারা একটি পুরোদস্তুর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করার দিকে এগচ্ছে। তৃতীয়ত, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক, যা গণতন্ত্রের একটি স্তম্ভ তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই শাসনে। হিন্দুত্বের রাজনীতি, দর্শনের বিরুদ্ধে প্রচার এবং সংগ্রামকে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে, মানুষের জীবনযন্ত্রণার ইস্যুতে লড়াইয়ের সঙ্গে সংঘবদ্ধ করতে হবে।
পার্টি কংগ্রেসের এই দিকনির্দেশের ভিত্তিতে আমরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি, সমাজ এবং শ্রমজীবীদের অবস্থাকে বিচার করে দেখবো। আমাদের রাজ্যেও তৃণমূলের শাসনে, তৃণমূলের মদতে বেড়েছে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি। অন্যদিকে শ্রমজীবীদের উপর আক্রমণ বেড়েছে। আবার তাঁদের রুখে দাঁড়ানোর ইচ্ছাও প্রবল হচ্ছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে জানকবুল লড়াই হয়েছিল। শহীদ হয়েছেন বেশ কয়েকজন। কত লড়াই করে মনোনয়ন পেশ করা হয়েছিল। তৃণমূল ভোট লুট করল, সেই লুট আটকানোর চেষ্টাও হয়েছিল। পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় স্পষ্ট হয়েছিল গরিব মানুষের প্রতিশোধস্পৃহা। তাঁরা সব আমাদের শ্রেণির মানুষ। তৃণমূল-বিজেপি’র দুই মেরু বা বাইনারি কিছুটা ভেঙেছিল তখন। আমরা কিছুটা অগ্রসর হলাম। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে খেতমজুর, গরিব মানুষ, শ্রমজীবীরা, ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষকসভার কর্মীরা গ্রামে গ্রামে পদযাত্রা করেছিলেন। সন্ত্রাস কবলিত এলাকায় মানুষকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেছিল। লোকসভা নির্বাচনের আগে আমরা শ্রেণির মানুষকে সংগঠিত করার কথা বলেছিলাম। শ্রেণি আন্দোলন বাড়িয়ে, শ্রেণি সংগঠনকে জোরদার করেই আমাদের এগতে হবে। রাজ্য সম্মেলন থেকে এই লক্ষ্যই নির্দিষ্ট করেছি আমরা।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সম্মেলন শেষ হয়েছিল। সেদিন সমাবেশ হয়েছিল ডানকুনিতে। বিরাট সেই সমাবেশে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর সহ সমাজের সব অংশের শ্রমজীবীরা অংশ নিয়েছিলেন। সমাবেশ থেকে পার্টি আহ্বান জানিয়েছে, ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকেই ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের লড়াই শুরু। বিরামহীন সেই লড়াই চলবে। সেই অনুসারেই কাজ শুরু হয়েছে ডানকুনির সেই সমাবেশের পর থেকে। রাজ্য কেন্দ্র থেকে সুপরিকল্পিতভাবে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রকল্প গ্রহণ করে এগনোর চেষ্টা হচ্ছে। জেলায় জেলায়, অঞ্চলে পার্টিকর্মীরা প্রস্তুতি শুরু করেছেন। এবার সেই প্রস্তুতি বিধানসভা ভিত্তিক বুথ স্তরে শুরু করতে হবে।
পাশাপাশি আমাদের আন্দোলন, সংগ্রামকেও তীব্র করতে হবে। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমাদের ’২৬-এর লড়াই লড়তে হবে। পার্টি কংগ্রেস নির্দিষ্টভাবে এই ক্ষেত্রে আমাদের সামনে লক্ষ্য হাজির করেছে। প্রথমত, পার্টির নিজস্ব শক্তির বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। সেই কাজে জোর দিতে হবে মূল শ্রেণিগুলির মধ্যে আমাদের প্রচার, আন্দোলনে। পার্টির নিজস্ব, স্বাধীন কার্যক্রম বাড়াতে হবে। ধারাবাহিকভাবে স্থানীয় ইস্যুতে আন্দোলন গড়ার কাজ করতে হবে। সামাজিক এবং জাতি, লিঙ্গ বৈষম্যের মতো বিষয়ে পার্টিকে সরাসরি প্রচার এবং লড়াই গড়ে তুলতে হবে। গ্রামীণ গরিব, শহরাঞ্চলের বস্তিবাসীদের সমস্যা, সঙ্কটগুলির সমাধানের লক্ষ্যে আন্দোলনে জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে যুব সমাজকে সংগঠিত করতে। এই ক্ষেত্রে ‘সমাজতন্ত্রই বিকল্প’ এই প্রচার তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে।
পার্টি কংগ্রেসের পনেরো দিনের মাথায় চারটি বামপন্থী সংগঠনের ডাকে ব্রিগেডের সমাবেশ। এই সমাবেশের প্রচার অবশ্য পার্টির রাজ্য সম্মেলনেরও আগে গণসংগঠনগুলির কর্মীরা শুরু করেছিলেন। সেই প্রচার হয়েছে কারখানার গেটে, শ্রমিক মহল্লায়। প্রচার পৌঁছেছে গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায়, খেতমজুরদের উঠোনে। সন্ধ্যায়, সারাদিনের পরিশ্রমের পরে চাটাই পেতে গ্রামীণ শ্রমজীবীদের দেখা গেছে ব্রিগেডের সমাবেশের বৈঠকি সভায়। প্রচার হয়েছে বস্তিতে বস্তিতে, বাড়ি বাড়ি। মৎস্যজীবী সহ নানা পেশার শ্রমজীবীদের কাছেও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে প্রচার। ছোট ছোট সভা হয়েছে। পদযাত্রা হয়েছে অনেকগুলি। রাজ্য জুড়েই এই প্রচার হয়েছে। কী হয়েছে এই প্রচারের ফল তা পরবর্তীকালে ব্রিগেড সমাবেশের আয়োজক চারটি সংগঠন পর্যালোচনা করবে। খুঁজে দেখতে হবে কতটা নিবিড় হয়েছে প্রচার, গরিব, শ্রমজীবী মানুষের কাছে কতটা পৌঁছানো গেল। মানুষের দাবি, স্থানীয় দাবি কতটা তুলে আনা গেল, খতিয়ে দেখতে হবে এই সবই। এখন প্রয়োজন শ্রেণি ঐক্য গড়ে তোলা।
আমাদের রাজ্যে তৃণমূলের আক্রমণের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছেন গরিব মানুষ। সিপিআই(এম)-কে সমর্থন করার জন্য হামলা হয়েছিল তাঁদের উপর বেশি। তাঁদের উপর তৃণমূল চাপিয়েছিল জরিমানা। তৃণমূলের দুর্নীতি আর মোদী সরকারের কৌশলে রাজ্যে রেগার কাজ বন্ধ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেই গরিব গ্রামীণ শ্রমজীবীরা। আবাস যোজনার তালিকায় নাম থাকলেও তাঁরা বাড়ি পাননি তৃণমূলের দুর্নীতির কারণে। তাঁদের জন্য ত্রাণের বরাদ্দ চাল, ত্রিপল চুরি করেছে তৃণমূল। প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাঁরা বারবার আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের নামে মিথ্যা মামলা হয়েছে। মিথ্যা অভিযোগে তাঁরাই জেলবন্দি হয়েছেন। তাঁদের পরিবারের মহিলাদের উপর আক্রমণ হয়েছে। ভোট দিতে গিয়ে তাঁরা রক্তাক্ত হয়েছেন। বুথে বুথে রুখে দাঁড়িয়েছেন তাঁরাই। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে তাঁরা পাট্টা পেয়েছিলেন। তৃণমূলের শাসনে সেই পাট্টা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। গরিব মানুষের উপর এইভাবে হামলার পাশাপাশি লাল ঝান্ডার কর্মীদের উপরও লাগাতার আক্রমণ চালিয়েছে তৃণমূল। যাতে গরিব মানুষের ভরসার, আস্থার জায়গা দুর্বল হয়। আর এইভাবেই রাজ্যে আরএসএস-কে জায়গা করে দিয়েছে তৃণমূল। তৃণমূল সরকার গড়ার পর যেদিন হুগলীতে কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সভা হতে দেয়নি, সেদিনই ইংরেজবাজারে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সভা হয়েছে সরকারি সহায়তায়। এমন অনেক উদাহরণ আছে। গত মার্চে রাজ্যে ঘুরে গেছেন আরএসএস প্রধান। আবার একই স্ক্রিপ্ট তৈরি করে গেছেন। তৃণমূল বিজেপি আপাত দৃষ্টিতে পরস্পরের বিরোধী মনে হলেও আসলে একে অপরের পরিপূরক-রাজনীতি করছে। যার পরিণতিতে ঈদ, রামনবমী, হনুমান জয়ন্তীকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা চালিয়েছে তৃণমূল-বিজেপি। ওয়াকফ সংশোধনী আইনের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করেও বিভাজনের রাজনীতিকেই উসকানি দিতে চেয়েছে এই দুই শক্তি। যদিও ওয়াকফ সংশোধনী বিলের ভোটাভুটিতে হাজির থাকেননি তৃণমূলের কয়েকজন সাংসদ। দেশজুড়ে যখন ওয়াকফ সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে, সব বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, সিপিআই(এম) সহ বিভিন্ন অংশ সেই আইনের বৈধতার প্রশ্নকে নিয়ে যাচ্ছে আদালতে তখন মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘কেন এত তাড়াহুড়ো করল বিল আনতে?’ এটা বলেননি যে, এই আইন সংবিধান বিরোধী, তিনি এই আইনের বিরোধী। জঙ্গিপুরের হাঙ্গামায় আমরা দেখলাম পুলিশ সময় দিলো দুষ্কৃতীদের চার পাঁচ ঘণ্টা। যাতে দুষ্কৃতীরা হাঙ্গামা চালাতে পারে, সেই হাঙ্গামা সাম্প্রদায়িক চেহারায় হাজির করা যায়। অথচ আমরা সেখানে গিয়ে দেখেছি বাড়ি ঘর-দোর দোকানে হামলা রুখতে এগিয়ে এসেছেন আমাদের পার্টিকর্মীরা। তাঁরা কোন ধর্মের তা বিচার্য হয়নি। খুন হলেন আমাদের দুই পার্টিকর্মী কমরেড হরগোবিন্দ দাস ও কমরেড চন্দন দাস, এবং সুতিতে নিহত হলেন যুবক ইজাজ আহমেদ।
এই সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টির কারণ মানুষের মূল সমস্যা থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া। কাজের অভাব, বাসস্থানের অভাব, খাদ্যের অভাব, রেগার বকেয়া মজুরি, তার কাজ, শিক্ষক নিয়োগ, স্কুলগুলি বন্ধ হতে বসা, সর্বক্ষেত্রে তৃণমূলের দুর্নীতি, বিজেপি’র আর্থিক নীতি তার মারাত্মক প্রভাব সমাজে এমন ইস্যুগুলিকে আড়াল করতেই তৃণমূল, বিজেপি’র এই কৌশল। মানুষের জীবন-জীবিকার এই প্রশ্নগুলি সামনে এলে তাদের বিপদ। আমরা বলছি স্কুল, কলেজ, ব্যাঙ্ক, বিমা, রেল, বাস, মানুষের কাজের গ্যারান্টির মতো প্রকল্পগুলি চালানো, পরিকাঠামো গড়ে তোলা সরকারের কাজ। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের নীতি হলো এই কাজগুলি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া। সরকার বলছে তারা মন্দির বানাবে, ওয়াকফ চালাবে। অথচ রাষ্ট্রের এসব কিছুর থেকে দূরে থাকার কথা। ওয়াকফের সম্পত্তি নিয়ে দুর্নীতি দেশের বিভিন্ন রাজ্যেই আছে। আমাদের রাজ্যে ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করেছে তৃণমূলের নেতারা। ওয়াকফ বোর্ডকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার দায়িত্ব। ওয়াকফ সম্পত্তি দখল মুক্ত করায় সরকারের দায়িত্ব আছে। ওয়াকফ আইন সংশোধনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার উলটো পথে হাঁটছে। ওয়াকফ সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি হটানোর বদলে সরকার যে পথ নিয়েছে তা হলো, শিশুকে স্নান করানোর বদলে জলের সঙ্গে শিশুকেও ছুঁড়ে ফেলছে।
রাজ্য আর জি কর হাসপাতালে ট্রেনি তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ, নৃশংস খুনের ঘটনার পরে তৃণমূল, বিজেপি’র ভূমিকা দেখেছেন। দেখা গেছে তৃণমূল-বিজেপি’র পরস্পর বিরোধী উক্তি থাকলেও পরস্পর-বিরোধী যুক্তি তারা রাখছে না। বরঞ্চ নতুন তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে বিষ ছড়াচ্ছে তারা। আমরা গুজব শুনেছিলাম। এখন মানুষের মধ্যে ঘৃণার চাষ করা হচ্ছে। মেহনতি মানুষ এককাট্টা হলে তাঁরা তাঁদের হক আদায় করেই ছাড়বে, তা বিজেপি-তৃণমূল জানে। তাই লুটে খাওয়ার বিরুদ্ধে খেটে খাওয়াদের লড়াই ভাঙতে, তাঁদের মধ্যে বিভাজন আনতে তৃণমূল-বিজেপি একে অপরের পরিপূরক হিসাবে কাজ করছে। আমাদের রাজ্যে এই দুই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই জাতীয় ক্ষেত্রে নয়া ফ্যাসিবাদ এবং শাসকের আর্থিক নীতিগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।
জঙ্গিপুরে আমরা দেখেছি হাঙ্গামা সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরির ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন এজেন্সি মারফত, যাদের ভোট লুট করতে যে দুর্বৃত্ত লুটেরাদের কাজে লাগে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। শাসক, প্রশাসন সেই সময়ে নিশ্চুপ থেকেছে। দুষ্কৃতীরা নিরুপদ্রবে তাদের দুষ্কৃতীমূলক কাজ করেছে। সেই উত্তেজনা মালদহ, বীরভূম, নদীয়ার সংলগ্ন এলাকাতেও ছড়ানোর চেষ্টা করছে। এই ঘটনায় কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসক দল বহিরাগত তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। সীমানা পার হয়ে কেউ এলে, তার দায়িত্ব কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের। অন্য জায়গা থেকে এসে হামলা করলেও তার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের, তাদের গোয়েন্দা বিভাগের। শাসক দলকে বুঝতে হবে তারা বিরোধী নয়। তাদের অপদার্থতা এবং ব্যর্থতাকে তারা স্বীকার করুক। লোকসভা, বিধানসভা থেকে জনসভা, প্রতিদিন উসকানিমূলক ভাষণ হচ্ছে, ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। কিন্তু সেই ঘৃণা ভাষণের বিরুদ্ধে কোনও মামলা হচ্ছে না।
দেশে আরএসএস-বিজেপি নয়া ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র গড়ে তোলার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে, তাদের কাজ হচ্ছে সমাজের একটি অংশের বিরুদ্ধে আর একটি অংশকে খেপিয়ে তোলা, ঘৃণার ভাব তৈরি করা। আমাদের রাজ্যে তা বিভিন্নভাবে দেখা যাচ্ছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিকায় আমাদের সমাজে, রাজনীতিতে যে বহুত্ববাদ গড়ে উঠেছিল, তাকে রক্ষা করা ও উদ্যাপন করার যে মনোভাব তাকে আঘাত করা হচ্ছে। এই বিপদের কথা সুনির্দিষ্টভাবে পার্টির সর্বস্তরে নিয়ে যেতে হবে। পার্টির কেউ যেন এর আওতার বাইরে না থাকেন। ব্রিগেড সমাবেশের প্রস্তুতিতে যে কাজ হয়েছে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সমাজের শিকড়ে আমাদের প্রচার করতে হবে। যেতে হবে শ্রেণির মানুষের কাছে। অভিজ্ঞতা বলছে যেখানে তা করা গেছে সেখানে সাড়া পাওয়া গেছে। আজকের পরিস্থিতিতে বিশেষত এইভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা না করাই অপরাধ। পাশাপাশি মানুষ যে বিষয়গুলি উত্থাপন করেছেন, সেই ইস্যুগুলি নিয়ে দ্রুত, নাছোড়বান্দা মনোভাব নিয়ে, আশু আদায়যোগ্য বিষয়গুলিকে নিয়ে আন্দোলন তীব্র করতে হবে। রাজ্য সম্মেলন, পার্টি কংগ্রেস কিংবা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের সমাবেশ— কোনোটিই শেষ নয়। তিনটিই নতুন ধারার সূত্রপাত।
আমাদের দায়িত্ব বামপন্থার পুনরুত্থান। সম্প্রতি গ্রাহাম স্টেইন এবং তাঁর সন্তানদের যারা জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করেছিল, তাদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জেলমুক্তি ঘটেছে। জেলের বাইরে তাদের বিপুল সংবর্ধনা দিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা। এখন বিশ্ব জুড়ে ইস্টার পালিত হচ্ছে। ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন যিশু খ্রিস্ট। কিন্তু সেখানেই ইতিহাসের যবনিকা পাত হয়নি। খ্রিস্টান বিশ্বাস অনুযায়ী ‘রেসারেকশান’ বা পুনরুত্থানই আসল। আমাদের দর্শন, আদর্শ ঐতিহ্য যার মূল কথা সব শোষণের অবসান, এমন এক সমাজ যা প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, সব ধরনের বৈষম্য দূর করবে। আমাদের সেই লক্ষ্যে এগতে হবে মেহনতি মানুষের ঐক্যকে সুদৃঢ় করে। আর সেই পথে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা— ‘একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে/ রাজার দোহাই দিয়ে/ এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি,/মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি-।’
তাই, সাধু সাবধান।
Comments :0