দেবাশিস মিথিয়া
কৃষি বরাবরই ভারতীয় অর্থনীতির মূল ভিত্তি এবং গ্রামীণ জনগণের জীবনীশক্তি। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকারই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। কৃষিকে স্বনির্ভর করার কথাও বারবার বলেছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সেই স্বপ্ন অধরা থেকে গেছে। কৃষকদের দুর্দশা কমেনি; ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে তাঁরা আত্মহত্যার মতো চরম পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ আজও অপুষ্টিতে ভুগছেন। ২০২৪ সালে, ক্ষুধা সূচকের মান অনুযায়ী, বিশ্বের ১২৭ টি দেশের যে তালিকা তৈরি হয়েছে তাতে ভারতের নাম রয়েছে ১০৫ নম্বরে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার এক দুর্বল চিত্র তুলে ধরেছে।
এইরকম এক পরিস্থিতিতে, ভারত সরকারের ‘কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রক’, এবং ‘ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদ (আইসিএআর)’ যৌথভাবে 'বিকশিত কৃষি সংকল্প অভিযান' শুরু করতে চলেছে। এই অভিযানের লক্ষ্য হলো 'ল্যাব টু ল্যান্ড' (গবেষণাগার থেকে জমি) এর সফল বাস্তবায়ন। অর্থাৎ, কৃষি গবেষণার ফলকে সরাসরি কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। ঠিক হয়েছে, ২৯ মে থেকে ১২ জুন পর্যন্ত সারা দেশের ৭২৩টি জেলার ৬৫,০০০-এরও বেশি গ্রামে ১৬,০০০ জন কৃষিবিজ্ঞানী সরাসরি কৃষকের দরজায় পৌঁছাবেন। তাঁরা কৃষকদের সমস্যা শুনবেন এবং তার সমাধান বাতলে দেবেন।
রাজনৈতিক কৌশল
'বিকশিত কৃষি সংকল্প অভিযান' কে সফল করতে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান, "এক দেশ, এক কৃষি, এক দল" – এই মর্মে স্লোগান তুলেছেন। এই প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রী জানিয়েছেন, এটি নিছকই একটি স্লোগান নয়, বরং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কৃষক সংগঠনগুলির মধ্যে একটি সত্যিকারের সমন্বয় গড়ে তোলার প্রয়াস। তিনি মনে করেন, সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কৃষকদের ক্ষমতায়ন, উৎপাদন ব্যয় কমানো এবং আয় বৃদ্ধি সম্ভব নয়। সরকারের সমর্থনকারীরা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, এই অভিযান ভারতীয় কৃষিতে এক নতুন জোয়ার আনবে। সমালোচকদের পালটা দাবি, এটি কৃষকের মন ভোলানোর কৌশল ছাড়া কিছুই নয়। এই বিতর্কে জানিয়ে রাখি, বিজেপি সরকার কৃষকদের মন জয় করতে বারবার চেষ্টা করলেও, কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায়নি।
এখানে যেটা উল্লেখ করা জরুরি, তা হলো, এই 'ল্যাব টু ল্যান্ড' এর ধারণাটি ভারতীয় কৃষিতে নতুন নয়। ১৯৭৯ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ (আইসিএআর) এই প্রোগ্রামটি চালু করে। ১৯৮৬ সালে "টেকনোলজি মিশন ফর অয়েলসিডস" চালুর সময়ও এতে জোর দেওয়া হয়। এছাড়া, এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে কৃষকদের কাছে সরাসরি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, উন্নত বীজ, সার ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি, রোগ ও পোকা দমনের উপায় এবং জল সংরক্ষণের কৌশল পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এর সাফল্যের বহু উদাহরণ রয়েছে। যেমন, মহারাষ্ট্রের কৃষকরা 'ল্যাব টু ল্যান্ড'-এর সাহায্যে প্রথাগত ফসলের চাষ ছেড়ে হলুদ, অ্যালোভেরা, লেবু এবং মাশরুমের মতো লাভজনক ফসল চাষে ঝুঁকেছেন এবং নিজেদের আয় পাঁচ গুণ পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। মহারাষ্ট্রের-ই জলনা জেলার শুষ্ক মাটিতে কৃষকরা তুলা, সয়াবিন ও অড়হর ডালের পরিবর্তে রেশম চাষ করে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ টাকা আয় করছেন। কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র এবং পাঞ্জাব এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির সহায়তায় পাঞ্জাবের কৃষকরা আধুনিক যন্ত্রপাতি, উন্নত জাতের বীজ এবং রোগ দমনের কৌশল ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা ও লাভ বাড়িয়েছেন। তাঁরা চাষে বৈচিত্র এনেছেন। ধান-গম চাষ ছেড়ে ভুট্টা, সরিষা, আখ এবং বিভিন্ন সবজির চাষ করছেন। ইফকো-র মতো সংস্থাগুলি ‘ল্যাব টু ল্যান্ড’ পদ্ধতির মাধ্যমে ন্যানোইউরিয়া এবং ন্যানোডিএপি কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এর ফলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমেছে, মাটির উর্বরতা বেড়েছে এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষকরা রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রাকৃতিক চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
'ল্যাব টু ল্যান্ড' কেন সফল হয়নি
তবে এই সাফল্য বিক্ষিপ্ত, সর্বজনীন নয়। কৃষি মন্ত্রীর দাবি, ‘বিকশিত কৃষি সংকল্প অভিযান’-এর মাধ্যমে কৃষি গবেষণার ফল এবার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। তিনি আরও বলেন, কৃষি বিজ্ঞানীরা মাটি, সার, বীজ ও সরকারি প্রকল্প নিয়ে চাষিদের পরামর্শ দেবেন। অন্যদিকে, কৃষকরা বিজ্ঞানীদের কাছে তাদের জমির সমস্যা, আবহাওয়ার প্রভাব বা বাজারের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরবেন। এই আদান-প্রদান ভবিষ্যতের কৃষি গবেষণাকে কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করতে সাহায্য করবে। এগুলি সবই ভবিষ্যতে হতে চলেছে!! কিন্তু অতীতে এই প্রোগ্রামটি কেন পুরোপুরি সফল হয়নি, তা দেখে নেওয়া যাক:
ভারতের বেশিরভাগ কৃষকেরই জমি ছোট ও ছড়ানো-ছিটানো। জমির স্বল্পতা এবং খণ্ডীকরণের কারণে ভারতীয় কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বেশ ব্যয় বহুল। এর ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় এবং কৃষকদের আয় কমে আসে।
সরকারি কৃষি সম্প্রসারণ ব্যবস্থা কৃষকদের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। তথ্যের একমুখী প্রবাহ এবং কৃষকদের বাস্তব চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যহীনতা এই ব্যবস্থার দুর্বল দিক। তাছাড়াও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কৃষি গবেষণার ফলগুলি সঠিক সময়ে জমি পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তাই 'ল্যাব টু ল্যান্ড' এর বাস্তবায়নে গতির অভাব চোখে পড়েছে।
বীজ, সার, কীটনাশকের মতো উপকরণের ক্রমবর্ধমান দাম বৃদ্ধির কারণে, রাসায়নিক চাষের নতুন প্রযুক্তি ছোট কৃষকদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থেকেছে । তাই সেই প্রযুক্তি গ্রহণে, তাঁদের আগ্রহ ছিল না।
কৃষকরা ভালো ফলন ফলালেও— দুর্বল বাজার ব্যবস্থা, ফড়েদের দৌরাত্ম্য এবং সংরক্ষণের অভাবে প্রায়শই চাষি ফসলের ন্যায্য দাম পান না। ফলে নতুন প্রযুক্তিতে উৎপাদন বাড়লেও কৃষকের পকেটে অতিরিক্ত অর্থ আসে না, যা নতুন পদ্ধতি গ্রহণে তাঁদের নিরুৎসাহিত করে।
ছোট কৃষকদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পাওয়া বেশ কঠিন। যেহেতু নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে প্রাথমিক বিনিয়োগের প্রয়োজন অনেকখানি, তাই ঋণের অভাব কৃষকদের নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের ঝুঁকি নিতে বাধা দিয়েছে।
কৃষকরাই প্রকৃত বিজ্ঞানী
সরকার কৃষি বিজ্ঞানীদের, কৃষকদের কাছে পাঠিয়ে কৃষির উন্নতি ঘটাতে চাইছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, ভারতীয় কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কৃষি সংক্রান্ত জ্ঞান বাড়িয়েছেন। চাষের নতুন নতুন পদ্ধতি নিজেরাই আবিষ্কার করে চলেছেন। ছত্তিশগড় ও মধ্য প্রদেশের হাজার হাজার কৃষক ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে কয়েক হাজার ধানের জাত এবং শত শত সবজি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছিলেন। ড. রিচারিয়া পরবর্তীতে রায়পুরের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেগুলি সংরক্ষণ করেন। এই জাতগুলির মধ্যে ছিল বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যযুক্ত ধান, যা প্রমাণ করে এখানকার প্রতিটি গ্রাম সে অর্থে এক একটি কৃষি গবেষণাগার, এবং প্রতিটি কৃষক এক একজন কৃষি বিজ্ঞানী। এর থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার: কৃষকদের কাছে কৃষি বিজ্ঞানীর চেয়ে বেশি জরুরি কৃষির অন্যান্য সমস্যার সমাধান।
বহুজাতিক চক্রান্ত
আর যেটা গোপনে ঘটেছে, সেটা হলো, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের সহায়তায়, কিছু বহুজাতিক কোম্পানি, কৃষকদের ঐতিহ্যবাহী ও অমূল্য এই বীজগুলি চুরি করে নিয়েছে। আলফব্রেনানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাওবাদী নেতা বাসবরাজ এই গুরুতর অভিযোগ করেছিলেন। এই চুরি করা ধানের জাতগুলিতে (যেমন, আই আর -36, আই আর-72) আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের লেবেল সেঁটে বহুজাতিক সংস্থাগুলি বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছে। এর ফলে ভারতীয় কৃষকরাও বীজের জন্য বহুজাতিক কোম্পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। আদিবাসী অঞ্চলের স্থানীয় ধানের জাত, শস্যদানা, কন্দ, শাকসবজি ও ফলের বীজ সহ শত শতঐতিহ্যবাহী জাত আজও টিকে আছে, যাদের কর্পোরেট আগ্রাসন থেকে রক্ষা ও সংরক্ষণ করা অত্যাবশ্যক।
সফলতার পথে চ্যালেঞ্জ
পরিশেষে যেটা বলার, দেশের সরকার 'বিকশিত কৃষি সংকল্প অভিযান' নামে একটি পুরানো কৃষি প্রকল্পকে নতুন মোড়কে জনগণের সামনে এনেছে। এই প্রকল্পের সাফল্য ভবিষ্যতে বোঝা যাবে, তবে এর বাস্তবায়নের যে পরিকল্পনা তা কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তৈরি করেছে:
এই অভিযান ১৫ দিনের, এর দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিকতা আদৌ বজায় থাকবে কি? তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অতীতে অনেক ভালো প্রকল্পই নিয়মিত ফলো-আপের অভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
একজন বিজ্ঞানী শুধু তাঁর নিজের বিষয়টাই ভালো বোঝেন। তাই তিনি কৃষকের সব সমস্যার (যেমন: জিনিস বেচা, ধার নেওয়া, বা ফসলের বিমা) সমাধান দিতে পারেন না। শুধু বিজ্ঞান জানলেই কৃষকদের সাথে ভালো করে কথা বলা যায় না। তাই প্রশ্ন হলো, বিজ্ঞানীরা মাঠে নামার আগে কৃষকদের সাথে কথা বলার কৌশল এবং তাদের সমস্যা বোঝার জন্য ট্রেনিং ঠিকমতো পেয়েছেন তো ?
কৃষিতে নতুন কিছু প্রয়োগের ক্ষেত্রে কৃষকরা সুস্পষ্ট ফলের অপেক্ষায় থাকেন। যতক্ষণ না সাফল্য চোখে দেখবে ততক্ষণ তা গ্রহণ করতে চান না। অর্থাৎ চাষিদের পুরানো অভ্যাস স্বল্প সময়ের অভিযানে পরিবর্তন করা কঠিন। এর জন্য লম্বা সময় ধরে সাহায্য এবং ধাপে ধাপে ছোট ছোট সাফল্য দরকার।
বিভিন্ন স্তরের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, কেন্দ্র-রাজ্য জটিল সম্পর্ক এর কারণে "এক দেশ, এক কৃষি, এক দল" - বাস্তবে প্রায় অসম্ভব।
এখন রবি শস্য কাটার এবং খরিফ শস্য বোনার সময়। এই সময় কৃষকরা অত্যন্ত ব্যস্ত থাকেন। এই সময়ে বিজ্ঞানীরা মাঠে গেলে তাদের পক্ষে কতটা সময়দেওয়া সম্ভব হবে, তা বলা মুশকিল ।
আশার আলো নাকি অতীতের ব্যর্থতা?
'বিকশিত কৃষি সংকল্প অভিযান' সময়োপযোগী পদক্ষেপ হলেও তা ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে পারবে তখনই, যখন কৃষির চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। হতাশার কথা হলো, বিজেপি সরকারের কৃষি-সংক্রান্ত বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই অতীতে ব্যর্থ হয়েছে, বরং অনেক সময় কৃষকদের অসন্তোষই বাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে: এই নতুন অভিযান কি কেবল আরও একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা, যা অতীতের ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে? ১৫ দিনের একটি অভিযান কি সত্যিই কৃষকদের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারবে, নাকি এটি শুধু একটি প্রতীকী পদক্ষেপ হয়ে থেকে যাবে? বহুজাতিক কোম্পানিগুলির প্রভাব এবং বাজারের ত্রুটিপূর্ণ কাঠামো মোকাবিলায় এই অভিযান কতটা কার্যকর হবে?
ভারতের কৃষি এবং খাদ্য সুরক্ষার জন্য একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ গড়তে হলে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং বাস্তবতার নিরিখে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা অত্যন্ত জরুরি। একই সাথে, কৃষকদের সহজাত জ্ঞানকে সম্মান জানানো এবং তার বাস্তব প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন নিশ্চিত করা উচিত। এইগুলি করতে না পারলে এই 'উদ্দেশ্য' কেবল ক্ষণিকের ঝলক হয়েই নিভে যাবে, যা দেশের কৃষকদের জন্য নতুন কোনও আশার সঞ্চার করতে পারবে না।
Comments :0