পার্থপ্রতিম বিশ্বাস
বাঙালির জীবনে এখন ম্রিয়মাণ চৈত্র সেলের দাপট! বছরভর দামি পণ্য বছর শেষে সুলভে বিক্রির এই পর্ব চৈত্র সেল হিসাবেই পরিচিত। কিন্তু তাই বলে সরকারি চাকরি চৈত্র সেলে বিক্রি? হ্যাঁ এমন অভাবনীয় ঘটনাই ঘটেছে এ রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পর। রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের আগে যে শিক্ষকের চাকরি ছিল বঙ্গবাসীর জীবনে অতি মহার্ঘ, সেটিই রাজ্যে পালা বদলের পর সেলের বাজারের পণ্যে পরিণত হয়েছে। জেলায় জেলায় পাড়ায় পাড়ায় রেট চার্ট ঝুলিয়ে বিক্রি হয়েছে শিক্ষকের চাকরি পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায়! আর এই প্রেক্ষিতে এবার চৈত্র সেলের বাজারেই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ধাক্কায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি হারিয়েছেন রাজ্যের ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক। এক লপ্তে এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষকের চাকরি চলে যাওয়ায় রাজ্যের চালু স্কুল শিক্ষা লাটে ওঠার উপক্রম ! ইতিমধ্যে অনেক স্কুলেই প্রধান শিক্ষক স্কুলের ঘণ্টা বাজাচ্ছেন, অস্থায়ী শিক্ষকের ঘাড়ে চেপেছে অতিরিক্ত ক্লাসের বোঝা, এমনকি পাড়ার বাসিন্দা স্কুলের প্রাক্তনীদের শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের ডাক এসেছে। ইতিমধ্যে এই শিক্ষকেরা যারা বোর্ডের পরীক্ষার খাতা দেখেছিলেন সেই পরীক্ষার ফলপ্রকাশ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চাকরিহারা শিক্ষকদের বিনা বেতনে স্কুলে গিয়ে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে বলেছেন। এমন অবস্থায় গরমের অছিলায় গ্রীষ্মের ছুটি সরকার এগিয়ে এনেছে। কিন্তু আশঙ্কা শিক্ষক নিয়োগের এই জটিলতা না কাটলে রাজ্যের স্কুলে অনির্দিষ্টকাল ছুটি ঘোষণা করতে হবে।
শিক্ষক নিয়োগ: দুর্নীতিরাজ
শিক্ষক নিয়োগে বেলাগাম বেনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে একসাথে ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি-খারিজ এদেশের নিরিখে বিরলতম ঘটনা। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে রায়ে স্পষ্ট, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বেনিয়ম এবং আইনভঙ্গের অভিঘাত এতটাই যে ওই বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের মধ্যে যোগ্য এবং অযোগ্য শিক্ষক আলাদা করার কোনও পথ ছিল না। ফলে এমন নিয়োগে ভয়াবহ বেনিয়মের প্রমাণ মেলায় যোগ্য অযোগ্য নির্বিশেষে বাতিল হয়েছে গোটা নিয়োগ। শিক্ষিত যুবকদের কাজের আকালের বাজারে এক লপ্তে ছাব্বিশ হাজার চাকরি বাতিল সমাজে ভিন্নমাত্রিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, রাজ্যের শিক্ষায় সিঁদুরে মেঘের আবহেই। শিক্ষার মানের প্রশ্নে নিয়োগ পরীক্ষার দুর্নীতি যে পরমাণু বোমার মতো বিধ্বংসী সেটা স্পষ্ট হচ্ছে এই বিপুল শিক্ষকের চাকরি যাওয়ার সামাজিক অভিঘাতে। সাদা খাতা জমা দিয়ে, ইন্টারভিউ না দিয়ে, পরীক্ষায় পাশ না করে, বেছে বেছে কিছু প্রার্থীদের গ্রেস নম্বর দিয়ে, মেয়াদ উত্তীর্ণ প্যানেল থেকে নিয়োগ, মেধা তালিকা পরিবর্তন করে সমস্ত নিয়ম কানুন লাটে তুলে হাজার হাজার শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল এসএসসি’র মাধ্যমে ।
প্রাতিষ্ঠানিক চক্রান্তে স্বশাসন
সিন্ডিকেটের কায়দায় সেই টাকার ভাগ প্রশাসনের নিচ থেকে উপর অবধি পৌঁছেছিল যার প্রমাণ মিলেছে ইডি, সিবিআই’র খাতায় অভিযুক্ত ডজন খানেক নেতা মন্ত্রী, আমলা, বিধায়কদের জেলবন্দি হওয়ার ঘটনায়। এমনকি নিয়োগ দুর্নীতিতে আদালতের রায়ে অযোগ্য প্রার্থীরা বরখাস্ত হলে তাদের রক্ষাকবচ হিসাবে রাজ্য মন্ত্রীসভা অতিরিক্ত পদ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। ফলে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, এই বিপুল দুর্নীতি রাজ্য প্রশাসনের গোচরেই সংগঠিত হয়েছিল প্রকাশ্যে দিবালোকে, কিন্তু রাজ্য সরকার কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এখন সুপ্রিম কোর্টে গোটা নিয়োগ পদ্ধতি গুরুতর প্রশ্নের মুখে পড়ে এত শিক্ষকের চাকরি খারিজ হওয়ায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাজনৈতিক কারণে এসএসসি থেকে সরকারের দূরত্ব তৈরির চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাস্তবে স্বশাসিত সংস্থা হিসাবে এসএসসি তার দায়িত্ব পালন করার পরিবর্তে কার্যত শাসকের নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। সেই কারণেই মানিক ভট্টাচার্য থেকে সুবীরেশ ভট্টাচার্য কিংবা কল্যাণময় গাঙ্গুলি থেকে এসপি সিনহার মতো শাসক দলের অনুগত ব্যক্তিদের ওই সংস্থাগুলির মাথায় বসিয়েয়েছিল রাজ্যের সরকার। আর পরিকল্পিত উপায়ে সরকারি চাকরি বিক্রির ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ওই স্বশাসিত পর্ষদগুলি রাজ্য সরকারের ছাতার তলায়। সরকারি নির্দেশেই কমিশনের প্রথাগত আইন ভেঙে বেআইনি কমিটি গড়ে বহু নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছিল। ফলে আজ এসএসসি’র নিয়োগ দুর্নীতির দায় থেকে সরকার কোনোভাবেই পার পেতে পারে না। এমনকি রাজ্যের আইনে গড়া স্কুল সার্ভিস কমিশনের মতো স্বশাসিত পর্ষদ যদি নিয়মকে বুড়োআঙ্গুল দেখিয়ে দুর্নীতিতে যুক্ত হয়, তখন তার দায় সরকারের শিক্ষা দপ্তরের ওপরেই বর্তায়। আর সরকারের শিক্ষামন্ত্রী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হলে সেই দায় সামগ্রিকভাবেই রাজ্যের মন্ত্রীসভার এবং মুখ্যমন্ত্রীর।
চোরের মায়ের বড় গলা
ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি যাওয়ার পর রাজ্যের শাসক দল আইনের দার্শনিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, অপরাধ অন্বেষণে ব্যর্থ হলে হাজার দোষী পার পেয়ে গেলেও যেন একজন নির্দোষও দোষী সাব্যস্ত না হন! এখানেই সরকার ও শাসক দলের ভূমিকা আতশকাচের তলায়। গত কয়েক বছরে হাই কোর্টের রায় থেকে শুরু করে বিচারপতি বাগ কমিটির রিপোর্টে শিক্ষক নিয়োগে বেনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে টাকার বিনিময়ে চাকরি। প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত রাজ্যের নেতা, মন্ত্রী, আমলা, বিধায়করা এই দুর্নীতিতে যুক্ত। কিন্তু সেই দুর্নীতির ব্যাপ্তিতে মোট শিক্ষকের মধ্যে থাকা যোগ্য অযোগ্যের বিভাজন স্পষ্ট করা যায়নি উপযুক্ত তদন্তের অভাবে। এই তদন্তের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সিবিআই’র দীর্ঘসুত্রিতার কারণে যেমন এই তদন্তে যোগ্য–অযোগ্যের বিভাজন স্পষ্ট হয়নি, তেমনি রাজ্য সরকার ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের ভূমিকায় দুর্নীতি ও বেনিয়মের যাবতীয় তথ্য লোপাটের চেষ্টা হয়েছে। ফলে চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির মতোই সিবিআই তদন্ত থমকে দাঁড়িয়েছে অপরাধ অন্বেষণ অধরা রেখেই। এই প্রেক্ষিতে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে চাল কাঁকড়ের তফাৎ স্পষ্ট না হওয়ার কারণে যোগ্য অযোগ্য উভয় গোত্রের শিক্ষকেরাই আদালতের রায়ে চাকরি হারিয়েছেন। ফলে এই প্রেক্ষিতে রাজ্যের শাসক দলের গলায় যোগ্য অযোগ্যের বিভাজন নিয়ে নৈতিক প্রশ্ন কিংবা আইনের মুল ভিত্তি নিয়ে সরব হওয়াটা খানিক চোরের মায়ের বড় গলার মতই !
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে
ইতিমধ্যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কলকাতার চাকরিহারা প্রার্থীদের সামনে সমস্যা সমাধানের বিচিত্র পন্থা সুপারিশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পুনর্বিবেচনার দাবি জানাবেন দিল্লির সর্বোচ্চ আদালতেই। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন, দেশের বাঘা বাঘা আইনজীবীদের সরকারি টাকায় ভাড়া করে এতকাল যে যে তথ্য সরকার পেশ করেছেন আদালতের সামনে সেগুলি ধোপে টিকলো না কেন? চোর পালালে যেমন বুদ্ধি বাড়ে, সরকার এখন তেমনি চাকরিহারাদের নিয়ে সালিশি বৈঠকে বসেছে। অথচ গত কয়েক বছর ধরে এই চাকরি চুরির অভিযোগ নিয়ে হাজারো প্রতিবাদের খবর কানে তোলেনি সরকার সেই চুরি আড়াল করতেই। এখন আদালতের রায়ে এই বিপুল চাকরি হারানো শিক্ষকদের ঘিরে তীব্র সরকার বিরোধী নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। সেই প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে সামলানো এবং ধামাচাপা দিতেই যে এমন কৌশলী সালিশি সভার তোড়জোড়, সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। যোগ্য অযোগ্যের যে তালিকা এতদিনেও সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি চরম সরকারি অদক্ষতার কারণে, সেই তালিকার সমাধান সালিশি বৈঠকে উঠে আসবে সেটা কি আদৌ বাস্তবসম্মত?
আন্দোলন ঠেকাতে আলোচনা
আসলে সরকারের আলোচনায় বসার কৌশলী উদ্যোগ চাকরিহারা শিক্ষকদের রাজপথের আন্দোলনকে স্তিমিত করার চেষ্টায়। তাই আলোচনার আবহকে ঢাল বানিয়ে সরকার বলেছে আলোচনা এবং আন্দোলন একত্রে বরদাস্ত নয়। ফলে রাজ্যজুড়ে ডিআই অফিসের সামনে প্রতীকী অবরোধের যে কর্মসূচি নিয়েছিল চাকরিহারা আন্দোলনরত শিক্ষক সমাজ, তার বিরুদ্ধে প্রকৃত প্রতিশোধ নিতে নেমে পড়েছে রাজ্যের পুলিশ বাহিনী। প্রতিশোধের স্পৃহায় পুলিশ প্রশাসন আন্দোলনরত শিক্ষকদের লাঠিপেটা করেই থামেনি। লজ্জা ভয় নিয়ম কানুন লাটে তুলে শিক্ষকদের লাথি মারতেও পিছপা হয়নি রাজ্যের পুলিশ। আসলে পুলিশের লাথি শিক্ষকের দেহে পড়েনি, পড়েছে রাজ্যে সরকার পোষিত শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। যে শিক্ষক নিয়োগ ইতিমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে সেই দুর্নীতির অংশীদার হিসাবে এসএসসি, মধ্য শিক্ষা পর্ষদ, রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের সাথে পুলিশ প্রশাসনও জড়িয়ে গিয়েছে। ফলে প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রীর বান্ধবীর বাড়িতে যখন মানুষের রক্ত জল করা কোটি কোটি টাকা জমতে থাকে তখন রাজ্যের পুলিশ, সিআইডি নিষ্ক্রিয় থাকে। যখন চাকরি প্রার্থীরা রাজপথে দাঁড়িয়ে whistle blower-এর মতো একের পর এক দুর্নীতি প্রকাশ্যে আনে তখনও পুলিশ নীরব থাকে। যখন রাজ্যের জেলা জুড়ে রেট-চার্ট তৈরি করে চাকরি বিক্রি হয় তখনও পুলিশ নিরুত্তাপ থাকে! যখন এসএসসি’র কর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসে পুলিশ ফাঁড়িতে তখনও পুলিশ নীরব ছিল সেই অপরাধে সন্মতি দিয়ে। ফলে আজ শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার এই বেনজির দুর্নীতির পিছনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে পুলিশ প্রশাসনের। তাই আজ চাকরি হারাদের ডিআই অফিস অভিযানে আতঙ্কে দিশাহারা রাজ্যের পুলিশ।
আতঙ্কে দিশাহারা পুলিশ যখন হাতে পেন, পিঠে ব্যাগ নেওয়া শিক্ষকদের লাথি মারছে, তখন জঙ্গিপুরে বোমা গুলি হাতে দুষ্কৃতীদের নৈরাজ্যের আগুন ঠেকাতে ব্যর্থ পুলিশ ঝাঁপ বন্ধ দোকানে আশ্রয় নিচ্ছে। নৈরাজ্য যখন রাজনৈতিকভাবে শাসকের ভোট রাজনীতির পক্ষে যায়, তখন রাজ্যের পুলিশ শাসকদলের স্বেচ্ছাসেবকের মতো নৈরাজ্যের আগুন জ্বালিয়ে রাখে। আর ঠিক সেই কারণেই ১৪ আগস্ট রাতে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা যখন প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে আর জি কর হাসপাতালে ঢুকে তাণ্ডব চালায় তখন পুলিশ লুকিয়ে পড়ে হাসপাতালে স্নানঘরে। ফলে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে আর জি কর - প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশ প্রশাসনের বাঁকা শিরদাঁড়া আরও ঝুঁকে পড়ছে। তাই রুগ্ন মেরুদণ্ডের কারণে পুলিশকে বোম মারার নিদান দিয়েও ‘বীরভূমের বাঘ’পার পেয়ে যায়। পার পেয়ে যায় সন্দেশখালির বেতাজ বাদশা সরকারি জমি লুট করে জমির চরিত্র বদল করেও পুলিশের নজরদারিতে ।
আক্রান্ত সরকারি শিক্ষা
এই ভয়াবহ নিয়োগ দুর্নীতি আসলে এক প্রাতিষ্ঠানিক চক্রান্ত এই সরকার পোষিত শিক্ষাকে সজ্ঞানে ধ্বংস করার। আজ যে যোগ্য প্রার্থীরা রাস্তায় নেমে লড়ছেন নিজের চাকরি বজায় রাখার লড়াইয়ে তারা আসলে এই ঘুণ ধরা সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা বাঁচানোর লড়াইটাই চালাচ্ছেন নিজেদের জীবন বাজি রেখে। এই প্রেক্ষিতে আজ এই যোগ্য শিক্ষকদের চাকরি বাঁচানোর আন্দোলন এক সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে। আর জি কর আন্দোলনে যেমন অভয়ার হত্যা ছিল এক প্রাতিষ্ঠানিক চক্রান্ত। সেই চক্রান্তে সবচেয়ে বড় শিকার কেবল ডাক্তারেরা ছিলেন না বরং ছিল সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল রাজ্যের মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত কোটি কোটি মানুষ। আজ শিক্ষাক্ষেত্রেও এই নিয়োগ দুর্নীতির ধাক্কায় রাজ্যের নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পড়ুয়াদের সিংহভাগের গন্তব্য সরকারি স্কুল শিক্ষার মৃত্যু ঘণ্টা বেজে গিয়েছে। মানুষের ভোটের রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের প্রাথমিক দায় সরকারি শিক্ষার বিকাশ ও মান উন্নয়ন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ রাজ্যের শাসক দল সরকারি চাকরি, চৈত্র সেলের মতো করে হাটে বাজারে বিক্রি করেছে। ফলে আজ হাজার হাজার স্কুল ঝাঁপ বন্ধের মুখে দাঁড়িয়ে, সরকারি অব্যবস্থার বলি হয়ে।
খুলছে বেসরকারি শিক্ষার ঝাঁপি
ফলে যখন সরকারি স্কুলের ঝাঁপ বন্ধ হতে চলেছে সরকারি চক্রান্তে, তখন নতুন বাণিজ্যের ঝাঁপি খুলে বসেছে রাজ্যজুড়ে বেসরকারি শিক্ষা। ফলে সেই ফেলো কড়ি মাখো তেলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় রাজ্যের প্রান্তিক পরিবারের পড়ুয়ারা যে ছিটকে যাবেন তার আগাম পূর্বাভাস মিলতে শুরু করেছে রাজ্যের ভয়াবহ স্কুল ছুটের সংখ্যায়। ইতিমধ্যে রাজ্যে সরকারি স্কুলে ছাত্র শিক্ষক অনুপাত দেশের গড়ের চেয়ে ঢের নিচে নেমে গেছে। এমন অবস্থায় গালভরা সেমিস্টার চালু করার মাঝপথে এই ভয়াবহ নিয়োগ দুর্নীতির কারণে হঠাৎ করে এক ধাক্কায় শূন্য পদের সংখ্যা বিপুল বেড়ে গেলে শেষমেশ রাজ্য বোর্ডের লেখাপড়ার মান নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠবে জাতীয় স্তরে। ফলে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার পথও সঙ্কুচিত হতে থাকবে রাজ্যের পড়ুয়াদের। এমন প্রেক্ষিতে দ্রুত শিক্ষক পদে যোগ্য ও স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ না হলে এই নৈরাজ্যের পর্ব, দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে যাবে রাজ্যের শিক্ষা মানচিত্রে।
কার্যত সরকারি স্কুল শিক্ষায় রাজ্যে ধারাবাহিক দুর্নীতির প্রভাবে সরকারি ব্যবস্থা যে আদপে অদক্ষ অযোগ্য এটাই প্রমাণের চেষ্টা চলবে নতুন উদার অর্থনীতির প্রচারের আবহে। যেভাবে কর্মী সঙ্কোচন করে, আত্মঘাতী নীতি গ্রহণে বাধ্য করে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বিমা, রেল কিংবা স্বাস্থ্য পরিষেবায় বেসরকারিকরণের পথ প্রশস্ত করেছে স্বয়ং দেশের সরকার, ঠিক সে পথেই এই নিয়োগ নৈরাজ্য তুলে আনবে সরকারি স্কুল শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা এবং অস্তিত্ব নিয়ে বড় প্রশ্ন! বৃহত্তর বিপদের বীজ লুকিয়ে আছে এখানেই।
Comments :0