চন্দন দাস
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আজ। আজই ‘এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা’-র ধারণা নিয়ে আলোচনার দিন। গোড়াতে তাই দু’জন আসবেন। আসবেনই— গোলওয়ালকার এবং জিন্না। কারণ? এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা— গোলওয়ালকার এবং জিন্নার ভাবনায় আশ্চর্য মিল। কোনও কাঁটাতার নেই। ‘পৃথক জাতি’ বিশ্বাসের কোনও ছায়া সেখানে নেই। এখানে কমিউনিস্টদের কথা একটু বলে নেওয়া দরকার। তাঁদের বক্তব্যেও কাঁটাতারের কোনও প্রভাব নেই। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৪৭। অক্টোবর। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির চতুর্থ সম্মেলন হয়েছিল কলকাতায়। দুই বাংলার কমিউনিস্ট কর্মীদের একসঙ্গে সর্বশেষ সম্মেলন। ৮ নং ডেকার্স লেনে, পার্টির তৎকালীন অফিসের ছাদে প্যান্ডেল বেঁধে সেই সম্মেলন হয়েছিল। সেই সম্মেলনে বলা হলো,‘‘পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভা বাংলা ভাষাকেই সরকারি ভাষা হিসাবে গ্রহণ করায় এই সম্মেলন তাঁহাদের অভিনন্দন জানাইতেছে। এই সম্মেলন আশা করে যে, পূর্ববঙ্গের মন্ত্রীমণ্ডলী অনতিবিলম্বে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসাবে গ্রহণ করিবেন।’’
কিন্তু তা হয়নি। আর সেই না হওয়াই হয়ে ওঠে একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান অনুঘটক।
আপাতত অবিভক্ত ভারতে হাজির হই। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ মহম্মদ আলি জিন্না, মুসলিম লিগ চেয়েছিল। চেয়েছিল হিন্দুত্ববাদীরাও— সাভারকার, আরএসএস, মমতা ব্যানার্জির ‘অটলজীর মতো অটল’ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিও। দুটি দেশের ভাষার প্রশ্নে তাঁদের ভাবনা কী? ‘উই অর আওয়ার নেশানহুড ডিফাইনড’-এ চোখ রাখা যাক। স্বয়ংসেবকদের ‘গুরুজী’, দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকারের লেখা এই প্রবন্ধগুচ্ছ আরএসএস’র দর্শন। ‘ভাষা’ শিরোনামে প্রথমেই গোলওয়ালকার লিখছেন,‘‘every Race, living in its own country evolves a language of its own, reflecting its culture, its religion, its history and traditions.” অর্থাৎ — একটি জাতি, একটি দেশ, একটি সংস্কৃতি একটি ধর্ম এবং একটিই ভাষা এই সবের প্রকাশের জন্য জরুরি। আরও নির্দিষ্ট করে বললে— ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থান।’ সঙ্ঘের দর্শন। হিন্দির কথা স্পষ্ট বলেছেন সেই গোলওয়ালকারই। এবার দেখা যাক ‘বাঞ্চ অব থট’। তাঁরই লেখা। ভারতে ভাষার বিষয়ে নিজের সঙ্ঘের ভাবনা জানাতে গিয়ে গোলওয়ালকার লিখছেন, ‘‘We have therefore to take Hindi in the interest of national unity and self-respect and not allow ourselves to swept off our feet by slogans like ‘Hindi imperialism’ or ‘domination of the North’ etc.
এই পথেই স্বয়ংসেবক নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে তারা দেশ গড়ে তুলতে চায়। আর এদেরকেই ‘প্রকৃত দেশপ্রেমিক’ মনে করেন মমতা ব্যানার্জি। অথচ পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদের বিভ্রান্ত করতে স্লোগান দেন ‘জয় বাংলা।’ আধিপত্যবাদী, অত্যাচারী, স্বৈরতান্ত্রিক দর্শন আর শাসকদের ছলের অভাব হয় না। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ চাওয়া পাকিস্তানের শাসকদের ভাবনা কেমন ছিল? ১৯৪৪-র ১৭ আগস্ট গান্ধীজীকে লেখা চিঠিতে গুজরাটে জন্ম নেওয়া, বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার মহম্মদ আলি জিন্না লিখছেন,‘‘আমরা মনে করি ও বিশ্বাস করি যে, জাতির যে কোনও সংজ্ঞায় ও পরীক্ষায় দেখা যাইবে যে হিন্দু ও মুসলমান দুইটি প্রধান জাতি। আমরা দশ কোটি মানুষের একটি জাতি। শুধু তাই নয়, জাতি হিসাবে আমাদের নিজেদের সুস্পষ্ট সৃষ্টি ও সভ্যতা, ভাষা ও সাহিত্য, কারুশিল্প ও স্থপতিশিল্প, নাম ও পদবী, মূল্য ও সামঞ্জস্যের জ্ঞান, আইন ও নৈতিক নিয়ম, আচার-ব্যবহার ও পঞ্জিকা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, দক্ষতা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা — এক কথায়, জীবন সম্বন্ধে ও জীবনের প্রতি আমাদের নিজস্ব এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি আছে।’’ গোলওয়ালকারের ভাবনার সঙ্গে চমৎকার মিল! ‘জাতির’ ধারণার সূত্র ধরেই ভাষার ধারণাতেও সাদৃশ্য স্পষ্ট। ১৯৪৭-র ১৭মে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই মুসলিম লিগ নেতা চৌধুরি খালেকুজ্জামান ঘোষণা করেছিলেন,‘‘ঊর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা।’’ তাহলে প্রথমে হলো ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা জাতির ধারণা। তারপর এলো একই ভাষার ধারণা!
পাকিস্তান তৈরির সময় থেকেই এই নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে। পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, মধ্যবিত্তদের একটি অংশ এর বিরোধিতা করছিলেন। ১৯৪৮-র ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণ পরিষদে ইংরেজি, ঊর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও সমান মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে ভাষণ দিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৭১-এ তাঁকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী হত্যা করে। ১৯৪৮-র ১৯ মার্চ জিন্না ঢাকায় যান। ২১মার্চ রেসকোর্সে জনসভায় ভাষণ দেন। সেখানে তিনি একমাত্র ঊর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করা হবে বলে ঘোষণা করেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ মুজিবুর রহমান লিখছেন,‘‘আমরা প্রায় চার পাঁচ শত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল,‘মানি না।’ তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন,‘‘ঊর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’’ — তখন ছাত্ররা তাঁর সামনেই বসে চিৎকার করে বলল,‘না, না, না।’ জিন্না প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন।’’ ‘কায়েদ এ আজম’ সোচ্চার ‘না’-র মুখোমুখি হয়েছিলেন এইভাবে, ‘অভিন্ন জাতির’ জন্য তৈরি তাঁর সাধের দেশের বয়স তখনও এক বছর হয়নি!
১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য ঢাকার রাস্তা রক্তে ভিজিয়ে দিয়েছিল ছাত্র রফিকউদ্দিন, শ্রমিক আবদুল জব্বার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত, সরকারি কর্মচারী আবদুস সামাদ প্রমুখ। সেই ঘটনা এবং তার দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়ার কথা পৃথিবী জানে। তার ইতিহাস অনেকে অনেকভাবে লিখেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা হায়দর আকবর খান রনো তাঁর ‘পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ’-র দ্বিতীয় খণ্ডে জানাচ্ছেন সেই দিনটির দশদিন আগে, ১৯৫২-র ১১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি একটি সার্কুলার জারি করেছিল পার্টিকর্মীদের উদ্দেশ্যে। কী ছিল তাতে? পার্টি নির্দেশ দিয়েছিল,‘‘আন্দোলন এখনও পূর্ববঙ্গের জনসাধারণের ব্যাপক অংশের মধ্যে প্রসার লাভ করে নাই। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন এখনও প্রধানত শহরে ছাত্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিয়া যাইতেছে।...পাকিস্তানের মজুর ও কৃষক শ্রেণি যাহাতে এই আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে এবং আন্দোলনকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগাইয়া আসিতে পারে, তার জন্য আমাদের পার্টির তরফ হইতে বিশেষ প্রচেষ্টা নেওয়া দরকার।’’ পার্টির আহ্বান ছিল জেলায় জেলায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠন করার, ২১ ফেব্রুয়ারি গ্রামাঞ্চলের বাজারগুলিতে হরতাল পালনের উদ্যোগ নেওয়া। ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টিকে দীর্ঘসময় আন্ডারগ্রাউন্ড থাকতে হয়েছে। পাকিস্তানের জেলে বছর পর বছর কাটাতে হয়েছে কমিউনিস্ট নেতাদের। জেলে তাঁদের গুলিতে ঝাঁঝরা হতে হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের আগেই, ১৯৫০-এ ২৪ এপ্রিল রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে ৭জন কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীকে খুন করা হয়েছিল। ইলা মিত্র, অপর্ণা পালদের উপর পাশবিক অত্যাচারও সেই সময়ে। কারণ, কমিউনিস্ট কর্মীরা তখন হাজং বিদ্রোহ, নানকার বিদ্রোহ, নাচোল সহ বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গি কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ভাষা আন্দোলনের এটিও ছিল এক গৌরবোজ্বল প্রেক্ষাপট— যা অনেকেই অনুচ্চারিত রাখতে চান। অনেক রাজনৈতিক দল, ইতিহাসবিদই মনে করিয়ে দিতে চান না যে, প্রথম থেকেই ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের জমিদার, ধনী শাসক শ্রেণি সাম্রাজ্যবাদের স্বাভাবিক মিত্র। সাম্প্রদায়িক শক্তি এমনই হয়। তাদের নাম মুসলিম লিগ হোক, অথবা বিজেপি! ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার সময়েই পেশোয়ারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি তৈরি হয়। ১৯৫৫-তে পাকিস্তান মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক চুক্তি (সাউথ এশিয়ান ট্রিটি অরগানাইজেশন)-র অন্তর্ভুক্ত হয়। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধে পরিণত হতে থাকা পূর্ব বাংলার মানুষের লড়াইয়ে এই বিষয়গুলিকে যুক্ত করার কাজ কমিউনিস্টরাই করেছিল। ফলে ভাষার জন্য লড়াই যেমন জাতীয়তাবাদের সংগ্রাম, তেমনই তা কৃষক-শ্রমিকের অধিকারের লড়াইয়ে সম্পৃক্ত। এবং অবশ্যই তা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের অংশ।
Comments :0