SATYAJIT RAY

ছুটবে আবার কল্পনাটা সত্যজিতের পথ ধরে...

রাজ্য বিশেষ বিভাগ

প্রতীম দে

 

বৃষ্টির রেশটা কেটে আবার কাঠ ফাটা রোদ উঠতে শুরু করেছে। ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ রেখে জনঅরণ্যের সোমনাথের হঠাৎ মানিক বাবুর কথা মাথায় এলো। আজ যে সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন।

সত্যজিৎ রায়। বাংলা সিনেমায় বিশ্বকে ছুঁয়ে গিয়েছেন। তাঁর ‘জনঅরণ্য’-র সোমনাথ কলকাতার রাস্তায় কলার খোসায় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন চাকরি খুঁজতে খুঁজতে। এক দশক আগেও বাংলার মানুষ ভাবেননি যে চাকরি নিয়ে দুর্নীতির আস্ত পর্বের সাক্ষী থাকতে হবে। 

সত্যজিৎ রায়ের জন্ম বার্ষিকীতে এই তুলনা আসবেই। 

জনঅরণ্যে সত্যজিৎ রায় এক মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলের চাকরি পাওয়ার লড়াইকে তুলে এনেছিলেন পর্দায়। একের পর এক চাকরির পরীক্ষা দিয়েও সফল না হওয়ায় তার মধ্যে তৈরি হওয়া হতাশা, যন্ত্রণা। 

চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যোগ্য চাকরি প্রার্থীদের আজকের বাংলায় বসে থাকতে হচ্ছে রাস্তায়, টানা লড়াই চালাতে হচ্ছে ন্যায্য অধিকার পেতে। 

সত্যজিৎ রায়ের একের পর এক ছবি প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে।

উদয়ন পণ্ডিত আজ নেই। তাঁর শ্রষ্ঠাও আজ নেই। হীরক রাজাও নেই। কিন্তু  ‘হীরক রাজারা’ রয়েছে, শাসনের চলার কায়দায় তার নমুনা পাওয়া যাচ্ছে। মগজ ধোলাই হচ্ছে, শিক্ষার ওপর আক্রমণও তো সে জন্যই। শ্রমিকের ওপর আক্রমণ, কৃষক ওপর আক্রমণেও কায়দা তেমনই। সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যেই সেই আক্রমণ চলছে। প্রতিনিয়ত শ্রমিকদের বোঝানো হচ্ছে, কৃষককে বোঝানো হচ্ছে অদৃষ্টের ওপর তাদের নির্ভর করতে হবে। দাবি থাকবে না, অধিকার থাকবে না। কেবল অনুদান মেনে নিতে হবে। ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ২৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবি। আট ঘন্টা কাজের দাবি। ফসলের ন্যায্য দামের দাবি। চেষ্টা হচ্ছে খেটে খাওয়াকে ধর্মে, জাতে ভাঙার। নিজেদের মধ্যেই ‘ওরা’ তৈরি কর। যাবতীয় যন্ত্রণা এই ‘ওদের’ ওপর উগরে দাও। আদানিদের এমন বিপুল সম্পদ হয় কী করে, মন্ত্রী নেতারা পাঁচ বছরে কোটিপতি হন কী করে, এ সব প্রশ্ন লুকানোর সবচেয়ে ভালো কৌশল। মগজ ধোলাই না তো কী! 

হীরক রাজার দেশে একজন শ্রমিক দিন রাতের কোন হিসাব না করেই হীরের খনিতে কাজ করে যেতেন। আজও কাজের কোন নির্ধারিত সময় নেই। সকাল ৯টার মধ্যে যেই ছেলে বা মেয়েটিকে অফিসে যেতে হচ্ছে সে বাড়ি ফিরছে রাত ১১টার সময়। এরা সস্তার শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। নেই কোন বেতন কাঠামো। কাজের কোন নিশ্চয়তাও নেই। আজ কাজ আছে তো কাল কাজ নাও থাকতে পারে। সব কিছু নির্ভর করছে মালিকেরইচ্ছার ওপর। 

কিন্তু রয়ে গিয়েছে উদয়ন পণ্ডিতের লড়াই। 

পাঠশালা বন্ধ করে মগজ ধোলাই করে সবাইকে নিজের তাঁবেদার বানাতে চেয়েছিল হীরক রাজা। কিন্তু রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন উদয়ন পণ্ডিত। গুপি এবং বাঘা উদয়নের দিকে।

আজও একই ভাবে শাসক চায় ছাত্রদের মগজ ধোলাই করতে। এই মগজ ধোলাইয়ের কোন যন্ত্র নেই। জাতীয় শিক্ষা নীতি। মগজ ধোলাইয়ের নতুন অস্ত্র। জাতীয় শিক্ষা নীতিতে যেই সিলেবাস তৈরি প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে পুরোপুরি বিজেপি আরএসএসর হিন্দুবাদী চিন্তা ভাবনার বহিপ্রকাশ। যেই ডারউইনের বিবর্তনের তত্ত্ব বিজ্ঞানের অন্যতম মূল বিষয় তা বাদ গিয়েছে পাঠ্যক্রম থেকে। বাদ পড়েছে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস।

রাজ্যে বন্ধ হতে চলেছে ৮২০৭টি স্কুল। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাল্টিপেল এন্ট্রি এবং এক্সিট পদ্ধতি চালু হচ্ছে। 

লেখা পড়া করে যে অনাহারে মরে সে।

সস্তার শ্রমিক তৈরির করার রাস্তা সুগম করছে এই নয়া শিক্ষা নীতি। গঠনমূলক আলোচনা বাদ পড়ছে সিলেবাস থেকে। তার জায়গায় স্থান পাচ্ছে বিজেপি আরএসএসের হিন্দুবাদী এজেন্ডা। 

এই প্রবনতা আমাদের রাজ্যে অনেক আগেই দেখা যায়। মমতা ব্যানার্জির সরকার অষ্টম শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে সিঙ্গুর আন্দোলনকে যুক্ত করে। রাজ্যে শিল্পায়ন বিরোধী যেই আন্দোলন সেই সময় ডানা বাঁধে সেই আন্দোলন পড়ানো হয় ছাত্র ছাত্রীদের।

 

ঠিক। এখন উদয়ন পণ্ডিত নেই। কিন্তু উদয়ন পণ্ডিতের ছাত্ররা রয়েছে। আর তাই গোটা দেশে জাতীয় শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে তা বাতিলের দাবিতে রাস্তায় নেমে লড়াই চলছে। 

এই সবের মধ্যে যার কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। প্রদোষ সি মিটার। আজ উনি অনেকটাই অসহায়। মগনলাল মেঘরাজের মতো অপরাধীকে একাধিকবার শায়েস্তা করেছেন তিনি। কিন্তু আজকে যেই দুর্নীতির জাল গোটা রাজ্যে ছড়িয়েছে তার কোনও প্রতিকার কি ফেলুদা করতে পারতেন? 

আজ সকাল থেকে তাই বাকিদের মতো ফেলুদার মনে পড়ছে মানিক বাবুর কথা। তিনিই বলতেন, মগনলালদের ধরতে হলে তৈরি রাখতে হয় মগজাস্ত্র।

Comments :0

Login to leave a comment