SITARAM YECHURY

বৈচিত্র্যই আমাদের বন্ধন সীতারাম ইয়েচুরির রাজ্যসভায় বিদায়ী ভাষণ (১০ আগস্ট ২০১৭)

জাতীয়

আমাদের দেশ শক্তিশালী হবে যখন আমরা আমাদের বৈচিত্রের মধ্যে চলতে থাকা ধর্মনিরপেক্ষতাকে শক্তিশালী করে তুলতে পারব। দেশে বৈচিত্রের মধ্যেই বন্ধনকে অটুট রাখা দরকার ভারতীয় সমাজের স্বার্থে। আমার গত ১২ বছরের সংসদীয় জীবনে অভিজ্ঞতায় আমি বলতে পারি সাধারণ মানুষকে আমাদের নিজেদের কথা শুধু বলা নয়, সাধারণ মানুষকে ভারত কোন পথে চলবে তার দিগ্‌নির্দেশ দিতে হবে আমাদের সংসদ থেকে, যা সংসদের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ দেশ গড়ে তোলার আন্দোলন গড়ে তুলবে। আমি তাতে আজও রয়েছি। আগামী দিনে সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাবো।
আমরা যখন ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা, হিন্দোস্তাঁ হমারা। হম বুলবুলে হ্যায় ইসকি, ইয়ে গুলিসতাঁ হমারা’, এই গানের কথা বলি, আসলে আমরা সেই বাগানের কথা বলি যে বাগানে নানা ফুল ফুটে থাকবে। সেখানে থাকবে নানা ধরনের পাখি, বাতাস ভরে থাকবে সুবাসে, ঘুরে বেড়াবে মৌমাছির দল, যারা ফুলের মধ্যে সংযোগ গড়ে দেবে। এই গুলিসতাঁই হলো আমাদের দেশ। এখন কোনও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থে সঙ্কীর্ণ দ্রুত সাময়িক ফায়দা তোলার কথা বলছি না। কিন্তু বলছি, কোনও গোষ্ঠীর স্বার্থে সঙ্কীর্ণ সাময়িক ফায়দা তোলার দিকে চললে তা আমাদের ঐক্যকে দুর্বল করবে। তাতে আগামী দিনে দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে। আমার কথা হলো, বিবেকানন্দের ধর্মের সংস্কারের কথা জানি। দেশের ভবিষ্যৎ বুঝতেন না, তেমন কোনও ব্যক্তি বিবেকানন্দ ছিলেন না। ধর্মের বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ধর্ম সমন্বয়ের কথাই তিনি বলতেন। আমরা জানি বর্তমানে এটাই আমাদের শক্তি। বৈচিত্রের বদলে যদি ধর্মের অভিন্নতা, ভাষার বৈচিত্রের পরিবর্তে অভিন্ন ভাষা এবং বৈচিত্রের সংস্কৃতি পালটে অভিন্ন সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে কেউ যদি চায়, তাতে আমাদের বৈচিত্রের দেশ আর এক থাকবে না, বিস্ফোরণ ঘটে যাবে।
দেশের ঐক্য যারা ভাঙবে তাদের সঙ্গে কোনও সমঝোতা নেই। এনিয়ে কোনও আলোচনা হতে পারে না। আমাদের দেশের ঐক্য ও সম্প্রীতি যে কোনও মূল্যে রক্ষা করতে হবে। আমি যেটা শেষে বলতে চাই, দয়া করে বুঝুন দেশে আমার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ আছেন। আমি মাদ্রাজে তেলুগু ভাষী এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছি। আমার ঠাকুর্দা ছিলেন ছিলেন বিচারপতি। ঠাকুর্দা বিচারপতি হিসাবে অন্ধ্র প্রদেশে বদলি হয়ে আসায় আমরা সেখানে চলে আসি। আমি স্কুলের পড়াশোনা করি হায়দরাবাদে। মুসলিম সংস্কৃতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমার স্কুলের পড়াশোনা। আমি যাঁকে বিয়ে করেছি তিনি হলেন সুফি সম্প্রদায়ের রাজস্থানের বাসিন্দা। তাঁর উপাধি হলো চিস্তি। তাঁর মা মহিশূরের রাজপুত। এক ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে সুফি পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করল। আমার ছেলের পরিচয় কী হবে? সে কি মুসলিম? নাকি হিন্দু? কিছুই না। সে হলো ভারতীয়। এটাই তার পরিচয়। আমি আমার পরিবারের এই উদাহরণ সব জায়গায় দিয়ে থাকি।
আমাদের সেই দেশ গড়ে তোলার কর্মসূচি দিতে হবে। এটাই সংহতিমূলক সমাজের জন্য শান্তি এবং ঐক্যের বোধকে শক্তিশালী করে তুলবে। আজ আমাদের দেশের বাস্তবতা আমাদের বুঝতে হবে। বাস্তব হলো, আমাদের কৃষকরা কৃষি সঙ্কটে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মঘাতী হচ্ছেন। প্রতিদিন আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে চলেছে। আমাদের দেশের যুবকদের হাতে কাজ নেই। তাদের আর্থিক অনিশ্চয়তা চরমে। আমরা যদি যুব সমাজের জন্য কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করতে পারতাম, তবে আমাদের বিশ্বের অন্যতম সেরা দেশ হয়ে ওঠা থেকে আমাদের কেউ আটকাতে পারত না। আমাদের সেই ক্ষমতা রয়েছে। এটাই হলো রাজনৈতিক অভিমুখ। কিভাবে এগুলো করা যেতে পারে তা নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ‘উত্তর সত্য’কে ভিত্তি করে দেশে ঐক্য ভাঙতে যারা চায়, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চালাতে হবে। 
আমাদের সংসদ পরিচালনার পিছনে রয়েছে এখানকার কর্মীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা। কখনো কখনো রাত দুটো পর্যন্ত চলেছে অধিবেশন। কর্মীরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। অথচ, ‘আউটসোর্সিং’য়ের প্রক্রিয়ায় তাঁদেরই এখন বিপন্ন করা হচ্ছে। একইভাবে দেখছি ‘এইমস’ হাসপাতালে ভিড় করেন মানুষ। কারণ, এখানের চিকিৎসার উন্নত গুণমান। এখানে যে চিকিৎসকরা রয়েছেন তাঁরা বেসরকারি ক্ষেত্রে চলে যাননি। তাঁরা দুবাই বা অন্যত্র চলে যাননি। আজ মঙ্গলগ্রহে রকেট পাঠানোর দিকে এগোনো গেলে তার কৃতিত্ব এদেশের বিজ্ঞানীদেরই। এই শক্তি আমাদের নিজেদের। অন্যদের উপর নিজেদের নির্ভরশীল করে আমরা এগোতে পারব না।

 

Comments :0

Login to leave a comment