২০০৭ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শালবনীতে জিন্দাল গোষ্ঠীর ইস্পাত কারখানা তৈরি করা হবে। ৪৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় প্রকল্পের জন্য। সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে শালবনীর মাটিতে গড়ে উঠত এশিয়ার সর্ববৃহৎ ইস্পাত শিল্প হাব। সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলত ১ লক্ষ মানুষের। ইস্পাত শিল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠা অনুসারি শিল্পে কর্মসংস্থান মিলত আরও কয়েক লক্ষ মানুষের। সব মিলিয়ে প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাবিত পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
এই লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখেই এই প্রকল্পে যাবতীয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার। প্রকল্পের জন্য নেওয়া হয়েছিল সরকারের হাতে থাকা ৩০৩৫ একর খাস জমি, প্রাণী সম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের ৭৯৯ একর জমি এবং পাট্টা প্রাপকদেরকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে সংগ্রহ করা হয়েছিল আরও ১৮৯ একর জমি।
পাশাপাশি ২৯৪ একর রায়তি জমি সরাসরি কৃষকদের থেকে কিনে নিয়েছিল জিন্দাল গোষ্ঠী। ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর এই প্রকল্পের শিলান্যাস করেন রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় ইস্পাতমন্ত্রী রামবিলাস পাসওয়ান। সমস্ত কিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চললে, ২০১৩ সাল নাগাদ এই কারখানা সম্পূর্ণ ভাবে তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এই প্রকল্পে প্রতি বছর ১কোটি টন ইস্পাত উৎপাদন হত। প্রকল্প এলাকায় কারখানার পাশাপাশি একটি ১৬২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে ওঠারও কথা ছিল। প্রকল্পের জন্য জমি দিয়েছিলেন কমবেশি ১২০০ পরিবার।
মাওবাদী, তৃণমূল গোড়া থেকেই প্রকল্প ভেস্তে দিতে সক্রিয় ছিল। শালবনী ইস্পাত প্রকল্পের শিলান্যাস করে ফেরার পথে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের মুখে পড়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং রামবিলাস পাসওয়ানের কনভয়। সেই ঘটনাকে সামনে রেখে তৃণমূলের মদতে তিন বছরের বেশি সময় ধরে পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়া জুড়ে চলে তথাকথিত মাওবাদীদের সন্ত্রাস। ৩০০’র কাছে সিপিআই(এম) কর্মী সমর্থকের রক্তে ভেজে লাল মাটি। রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য থমকে যায় কারখানার যাবতীয় কাজ।
মাওবাদীদের পাশাপাশি এই প্রকল্পের বিরোধীতায় নামে তৃণমূলও । নন্দীগ্রামের ধাঁচে গড়ে ওঠে শালবনী জিন্দাল ল্যান্ড লুজার্স কমিটি। এই কমিটিকে সামনে রেখে জমি ফেরতের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে মমতা ব্যানার্জির দল।
২০১১ সালের পরে ধাপে ধাপে সুর নরম করতে শুরু তৃণমূল। ২০১২ সালে ২৫০ একর জমিকে সামনে রেখে ইস্পাতের বদলে সিমেন্ট কারখানা তৈরির ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। বাকি ৪ হাজার একর জমিতে শুরু হয় কলাচাষ। সিমেন্ট কারখানা ঘিরে একাধিক দাবিও করতে শোনা যায় মমতা ব্যানার্জিকে। যার অন্যতম ছিল বাৎসরিক ২৪ লক্ষ টন সিমেন্ট উৎপাদনের দাবি। বাস্তবে এর ধারেকাছেও পৌঁছয়নি সিমেন্ট উৎপাদনের পরিমাণ। তারফলে কয়েক লক্ষের বদলে কয়েক হাজার মানুষেরও কর্মসংস্থান হয়নি এই প্রকল্পে।
সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে জানান, ‘‘পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পকে গত ১০ বছর ধরে ধ্বংস করেছে তৃণমূল।’’
জানা গিয়েছে চুপিসারে এই প্রকল্পে পাকাপাকি ভাবে লালবাতি জ্বালানোর তোড়জোড় করছে রাজ্য সরকার। এই এলাকায় তৃণমূল ২০১১ সালের পর থেকে নির্বাচনে জিতে এলেও কারখানা নিয়ে স্থানীয় মানুষের আবেগ রয়েছে। তাঁরা এখনও চান এখানেই কারখানা হোক। সিঙ্গুরের পরিণতি দেখার পরে সেই জনমত আরও জোরালো হয়েছে। তাই সবদিক বিবেচনা করে এগোতে চাইছে তৃণমূল।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনের একটা অংশ জানাচ্ছে, সপ্তাহ খানেক হল প্রকল্প এলাকায় আনাগোনা বেড়েছে জেলা প্রশাসনের কর্মীদের। জমি মাপার কাজও শুরু হয়েছে। কিন্তু কেন জমি মাপা হচ্ছে, সে বিষয়ে কাউকেই স্পষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের মনোভাব আঁচ করতে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ‘‘ সরকার জমি ফিরিয়ে দিতে চাইছে।’’
এই প্রসঙ্গে শালবনী জিন্দাল ল্যান্ড লুজার্স কমিটির তরফে পরিষ্কার মাহাতো জানান, ‘‘ এই বিষয়ে ভালো করে কিছু জানি না। কিন্তু নানান আকার ইঙ্গিতে শুনছি, শিল্প না হলে জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে।’’
এই বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী শ্রীকান্ত মাহাতো বলেছেন, ‘‘ ওই এলাকায় শিল্প গড়ে ওঠেনি। এই বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। মুখ্যমন্ত্রী শিল্প গড়ার জন্য একাধিকবার জিন্দালদের চিঠি পাঠিয়েছেন। তাও কোনও কাজ হয়নি। এখানে ছোট ও মাঝারি শিল্প গড়ার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু একান্তই শিল্প করা না গেলে জমি ফেরানোর ভাবনা চিন্তা চলছে।’’
এই বিষয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা শাসক খুরশিদ আলি কাদরি বলেন, ‘‘ আমি এখানে ২-৩ হল এসেছি। মুখ্যমন্ত্রী এই প্রকল্প নিয়ে ঠিক কি চাইছেন জানিনা। মন্ত্রীর সভা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আমি এই বিষয়ে এখনই কিছু বলতে চাইছিনা।’’
এপ্রসঙ্গে সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘শালবনীতে জিন্দালরা জমি ফেরত দিতে চাইছে। এর আগে সিঙ্গুরে শিল্পের জন্য নেওয়া জমি রাজ্য সরকার ফেরত দিয়েছে। কিন্তু জমি ফেরতের ফলে না কৃষকের কোনও লাভ হয়েছে, না শিল্প সম্ভাবনার কোনও লাভ হয়েছে। শালবনীতে জিন্দালরা ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ ইস্পাত হাব তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই সময় মমতা ব্যানার্জিরা চেয়েছিলেন এই প্রকল্পে একটা অঘটন ঘটুক। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং রামবিলাস পাসওয়ানের কনভয়ে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ তারই ফলশ্রুতি। পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পকে গত ১০ বছর ধরে ধ্বংস করেছে তৃণমূল। এখন জমি ফেরত করা ছাড়া কোনও উপায়ও নেই।’’
এরসঙ্গে সুজন চক্রবর্তী যোগ করেন, ‘‘আমাদের আশঙ্কা, তাজপুরেও একই দিকে হাঁটছে রাজ্য। সাগরে বামফ্রন্ট সরকার গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিল। সেটাকে খারিজ করে তাজপুরে বন্দর তৈরির কথা বলছে তৃণমূল। এখন সেই পাখিও উড়ে যাবে মনে হচ্ছে। এরপর দেউচা পাঁচামি। সেখানে স্থানীয় আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে লুঠেরাদের হাতে প্রকল্প তুলে দেওয়ার চক্রান্ত করেছে রাজ্য। মমতা ব্যানার্জির মতো রাজ্যের এই পরিমাণ ক্ষতি ইতিহাসে কেউ কখনও করেনি।’’
Comments :0