বৃহস্পতিবার একদফায় ত্রিপুরার ৬০টি বিধানসভা আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাজ্যের ৩৩৩৭টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে উত্তেজনাপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল ১১০০টি। অতি উত্তেজনা প্রবণ হিসেবে চিহ্নিত হয় ২৮টি বুথ। কেন্দ্রীয় নির্বাচনী আধিকারিক কিরণ গিট্টে বারবার আশ্বাস দিয়েছিলেন, নির্বাচনে কোনও অপ্রিতীকর পরিস্থিতি তৈরি হবেনা। তিনি ত্রিপুরার সমস্ত মানুষকে নিজের ভোট নিজে দেওয়ার অনুরোধ জানান। যদিও নির্বাচনের দিনে সেই আশ্বাসের বাস্তব প্রতিফলিন ঘটেনি। বিরোধীরা জানাচ্ছেন, বহু ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানিয়েও কোনও সুরাহা হয়নি। এদিন রাত পর্যন্ত ভোটের পূর্ণাঙ্গ হিসেব দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। তাঁরা জানিয়েছে, বিকেল ৪টে অবধি ত্রিপুরায় ৮১.১০ শতাংশ ভোট পড়েছে।
এরাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের কায়দায় ত্রিপুরায় বুধবার রাত থেকে অ্যাকশনে নামে বিজেপির বাহিনী। বিশালগড়ের গৌতমনগরে তরুণ দেবনাথ এবং মুড়াবাড়িতে অসীম দেবনাথের বাড়িতে পেট্রোল বোমা ছোড়ে বিজেপি কর্মীরা। রামনগর বিধানসভা এলাকার ১০ নম্বর বুথে সিপিআই(এম) পোলিং এজেন্ট এবং ভোটারদের ভয় দেখাতে শুরু করেন বিজেপি প্রার্থী সুরজিৎ দত্তের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা।
একই কায়দায় মাতাবাড়ি অঞ্চলে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে উদয়পুরের বিজেপি প্রার্থী অভিষেক দেবরায়ের দলবল। যদিও বিলোনিয়াতে ভোটারদের ভয় দেখাতে গিয়ে পালটা তাড়া খায় বিজেপি বাহিনী।
বৃহস্পতিবার দিনের আলো ফোটার আগে থেকেই শান্তিরবাজারের কেসি পাড়া অঞ্চলে ভোটারদের আটকাতে শুরু করে স্থানীয় বিজেপি কর্মীরা। বুধবার রাতের রেশ ধরে উদয়পুর মাতাবাড়ির উত্তর চন্দ্রপুর টাটুয়াটিলায় বৃহস্পতিবার সকালেও ভোটারদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে বিজেপির বিরুদ্ধে। একই অভিযোগ এসেছে খয়েরপুর থেকেও।
বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা থেকে শুরু হয় ভোটগ্রহণের কাজ। অভিযোগ, একের পর এক বুথে থমকে থাকে ভোট গ্রহণের কাজ। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, বিজেপিকে সুবিধা করে দিতেই ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়ার গতি শ্লথ করেছে প্রশাসন। রামচন্দ্রঘাট, কৃষ্ণপুরের ৩৮ নম্বর বুথ সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কয়েক ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়েও ভোট দিতে পারেননি সাধারণ মানুষ। চড়িলামের ২৬ নম্বর বুথেও দীর্ঘক্ষণ পরে শুরু হয় ভোট নেওয়া।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়তে থাকে বিজেপির ভোট প্রক্রিয়া দখলের উত্তাপ। শান্তিরবাজার কলাছাড়ায় সিপিআই(এম) সমর্থক ভোটারদের উপর সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়ে বিজেপি কর্মীরা। এই ঘটনায় আহত হন চন্দন দাস এবং শিপন মজুমদার নামে দুই যুবক। খয়েরপুরের ৩৯ নম্বর বুথে ভোটারদের উপর লাঠি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় বিজেপি কর্মীদের। কাঁকড়াবন-শালগড়া কেন্দ্রের ৩ এবং ৪ নম্বর বুথের সিপিআই(এম) পোলিং এজেন্ট অমিত কুমার ভৌমিক এবং রফিকুল ইসলামকে মেরে রক্তাক্ত করে বিজেপির গুন্ডাবাহিনী। অমরপুর কেন্দ্রের নতুনবাজারে সিপিআই(এম) পোলিং এজেন্ট রাজীব মজুমদারকে বুথ থেকে বের করে এনে মারধর করে বিজেপির বাহিনী। অভিযোগ, সব দেখেও চুপ ছিলেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা।
যদিও বিজেপির হামলা প্রতিহত করার মেজাজও দেখা যায় সকাল থেকে। বিলোনিয়ায় সাধারণ ভোটারদের ভোট দিতে যাওয়ার পথে আটকায় বিজেপি কর্মীরা। এর পালটা ফেসবুক লাইভ করতে শুরু করেন বহু ভোটার। অবস্থা বেগতিক দেখে এলাকা ছেড়ে চম্পট দেয় বিজেপির বাইক বাহিনী। শান্তিরবাজারের ৫৭ নম্বর বুথে সাধারণ মানুষ দল বেঁধে ভোট দিতে যান। সেই মিছিলকে বাধা দিতে গিয়ে জনরোষের মুখে পড়ে বিজেপি কর্মীরা। উদয়পুরের জগন্নাথ দিঘীর কাছে দলবদ্ধ ভোটারদের আটকাতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় বিজেপি বাহিনীকে। খয়েরপুর থেকেও পালটা প্রতিরোধের খবর মিলেছে। বিশালগড়েও মহিলাদের নেতৃত্বে বিজেপির হুমকি উড়িয়ে ভোট দিতে যান সাধারণ মানুষ। অমরপুরের ৪২/৩১ নম্বর বুথে ছাপ্পা ভোট দিতে এসে গ্রেপ্তার হন এক মহিলা।
এদিন রামনগর বিধানসভার ১৪ নম্বর কালিকাপুর বুথে ভোটারদের লাঠিপেটা করার অভিযোগ উঠেছে বিজেপি প্রার্থী সুরজিৎ দত্তের গাড়ির চালক সুধাংশু দাসের বিরুদ্ধে। এর পাশাপাশি ঋষ্যমুখের হরিপুর দাসপাড়াতেও ভোটারদের উপর হামলা চালায় বিজেপি। যদিও সেখানেও প্রতিরোধ হয়েছে।
এদিন প্রথম থেকেই অশান্তির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ধনপুর কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করেছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রতিমা ভৌমিককে। এদিন ধনপুরের ২৫ নম্বর বুথে ছাপ্পা ভোট দিতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়ে এক বিজেপি কর্মী। এর পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, ধনপুরের একাধিক জায়গায় রাস্তায় বাঁশের ব্যারিকেড এবং চেকপয়েন্ট বানিয়ে ভোটারদের আটকাচ্ছে বিজেপি। বক্সনগরের সিপিআই(এম) অঞ্চল সম্পাদক আশিষ সরকারকে বেধড়ক মারধর করে প্রতিমা ভৌমিকের বাহিনী। তাঁর মাথায় ১৬টি সেলাই পড়েছে।
মাতারবাড়ি কেন্দ্রের ৩২/৩৮ নম্বর বুথে জয়ন্ত দেব নামে এক ভোটারকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে।
এদিন উপমুখ্যমন্ত্রী জিষ্ণু দেববর্মার কেন্দ্র বলে পরিচিত চড়িলামের ব্রজপুরে ছাপ্পা এবং বুথ দখলের অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। খয়েরপুরের সিপিআই(এম) প্রার্থী পবিত্র করের নির্বাচনী এজেন্টের গাড়িতে ভাঙচুর চালায় বিজেপি। গাড়ির সামনের কাঁচ ভেদ করে একটি মোটা কাঠের গুড়ি গাড়ির মধ্যে পুঁতে দেওয়া হয়েছে।
যদিও এদিন বিজেপির তরফে বেশ কিছু জায়গায় তিপ্রা মোথার বিরুদ্ধে রিগিং করার অভিযোগ আনা হয়েছে। গোলঘাটি, কৃষ্ণপুর এবং সীমনা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থীরা এই অভিযোগ তুলেছেন।
ঋষ্যমুখ কেন্দ্রের ১৪ নম্বর বুথে এসডিএম’র বিরুদ্ধে বিজেপির হয়ে ভোট করানোর অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। সিপিআই(এম) এবং কংগ্রেস কর্মীদের অভিযোগ, ঋষ্যমুখের ১৪ নম্বর বুথে ওয়েব কাস্টিংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন সেই বুথেরই বিজেপি পোলিং এজেন্ট। এই ঘটনা সামনে আসায় প্রবল বিক্ষোভ দেখান সাধারণ মানুষ। এছাড়া সাধারণ মানুষের চাপে কৈলাশহরের শ্রীনাথপুর স্কুলে ভুয়ো ভোটারকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় বাহিনী। তেলিয়ামুড়ায় বিজেপি প্রার্থী তথা বিগত বিধানসভার বিজেপি সদস্য কল্যাণী রায়কে দেখে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান তোলেন সাধারণ মানুষ। বিক্ষোভের জেরে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন ওই বিজেপি প্রার্থী।
এদিন ভোট শেষের কিছু আগে বিশালগড়ে বিজেপির ভোট লুঠেরা বাহিনীকে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। যদিও বাকি জায়গা গুলিতে তাঁরা নিষ্ক্রিয় ছিলেন। এমনটাই অভিযোগ বিরোধীদের।
Comments :0