জানা অজানা
শক্তিগড়ের ল্যাংচার গল্প
তপন কুমার বৈরাগ্য
সালটা ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোন এক সময়।
শক্তিগড় তখন একটা গ্রাম।এই গ্রামে এক ,এক পা বিহিন
লোক বাস করত। সকলে তাকে ল্যাংচা বলে ডাকতো।
সে লেংচে লেংচে হাঁটত। তাঁর মনে খুব দুঃখ।তবু তিনি ভেঙে
পড়েন নি, যা হোক কিছু আবিষ্কার করে সে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে
লিখে যেতে চায়। সে জাতিতে ময়রা ছিলো।রাস্তার পাশে
তাঁর একটা ছোট্ট মিষ্টির দোকান ছিল। সেই দোকানে সে নানা রকম
মিষ্টি বিক্রি করতেন।একদিন তাঁর কি মনে হলো এক নতুন
ধরনের মিষ্টি তৈরি করবেন।অনেক ভেবে চিন্তে তিনি ময়দা
ছানা,খোয়া,চিনি দিয়ে কালচে বাদামী রঙের
পাশবালিশের মতো মিষ্টি তেরী করলেন।
সেই মিষ্টি একদিন তিনি বর্ধমানে বিক্রি করতে গেছেন।
তখন সবেমাত্র কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের
কন্যা বিষ্ণকুমারীর বিয়ে হয়েছে বর্ধমানের রাজা তিলকচাঁদের
সাথে। রানি ছাদেতে সখী পরিবৃত্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ল্যাংচা তখন সুর করে হেঁকে হেঁকে বলছেন--অপূর্ব মিষ্টি।
খাওয়ার সাথে সাথে অরুচি দূর হয়ে যাবে।
রানি একজন সখিকে পাঠালেন তাঁকে ডেকে আনার জন্য।
সেদিন এই মিষ্টি খেয়ে রানি খুব আনন্দিত হলেন।এমন কি তাঁকে
বকশিস পর্যন্ত করলেন। ল্যাংচা চলে যাবার পর রানি বললেন-যা,
বড্ড ভুল হয়ে গেছে।ওর নাম আর ঠিকানাটা তো জিজ্ঞেস
করা হলো না।সখীরা রাস্তায় নেমেও তাঁ খোজ পেলেন না।
এদিকে এক বছর পর রানি সন্তানসম্ভবা হলেন।মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র
মেয়েকে নিজের প্রাসাদে নিয়ে এলেন।রানিমা কিচ্ছু খায় না।
সব কিছুতেই তাঁর অরুচি।
একদিন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন--এভাবে কিছু
না খেলে তুই বাঁচবি কি করে মা?বল্ মা তোর কি খেতে ইচ্ছে
করছে? যতোই দুষ্প্রাপ্য হোক সেই খাবারের আমি ব্যবস্থা
করবো।
মেয়ে অনেক ভেবেচিন্ত বাবাকে বললেন- এক ধরণের কালচে বাদামী
রঙের মিষ্টি।
রাজা বললেন কোথায় সেই মিষ্টি পাবো?
মেয়ে বললেন -এই মিষ্টি যে তৈরি করে তাঁর নাম তো আমি জানি না।
তবে সে বর্ধমানের কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায় বাস করে।
তাঁর একটা পা নেই।
রাজা যেন আশার আলো দেখলেন।খোঁজ খোঁজ।বর্ধমানের চারিদিকে
লোক পাঠালেন।অবশেষে তাঁর সন্ধান পাওয়া গেল শক্তিগড়ে।
তাঁকে আনা হলো কৃষ্ণনগরের রাজ দরবারে। এদিকে রাজা
তিলকচাঁদও সেখানে উপস্থিত হলেন। ল্যাংচা রানির জন্য কালচে
বাদামী রঙের সেই মিষ্টি তৈরী করলেন। রানির খাওয়ার সাথে সাথে
মুখের অরুচি দূর হলো। রানির মুখে হাসি ফুটলো।
তিলকচাঁদ বললেন--আজ আমি খুব খুশি।বলো তুমি আমার
কাছে কি চাও?
ল্যাংচা করজোড়ে বললেন'--আমার জন্মস্থান এবং আমার
নাম যেন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে এই আমার নিবেদন।
ঠিক আছে তোমার নাম অনুসারে এই মিষ্টির নাম হলো ল্যাংচা।
আর ল্যাংচার সাথে আজ থেকে যুক্ত হলো শক্তিগড়।
এখন থেকে সবাই জানবে শক্তিগড়ের ল্যাংচা।
রাজা তিলকচাঁদ শক্তিগড়ে ল্যাংচার জন্য একটা সুন্দর
দোকান তৈরী করে দিলেন। ল্যাংচার কাছে অনেকেই এই
মিষ্টি তৈরীর কৌশল শিখে নিলেন।শক্তিগড়ে আরো ল্যাংচার
দোকান গড়ে উঠল। রাজা তিলকচাঁদ মিষ্টির প্রচারের জন্য
সবরকমে সাহায্য করতে লাগলেন।দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল
এই মিষ্টির কথা।সকলে এই মিষ্টি খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
আর শক্তিগড় ল্যাংচার জন্য জগৎ বিখ্যাত হয়ে গেল।
Comments :0