রুহুল আমিন গাজী
পাঠানকোট বিমান ঘাঁটিতে সন্ত্রাসবাদী হামলা, ২০১৮ সালে উরি শহরে সেনাঘাঁটিতে সন্ত্রাসবাদী হামলা, ২০১৯ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরে পুলওয়ামায় জম্মু-কাশ্মীর জাতীয় সড়কের উপর দ্রুতগতিতে আসা ৭৮ টি বাসে ২৫৭০০ জন সিআরপিএফ নিয়ে কনভয়ের মাঝে উল্টো দিক থেকে আসা ২৫০ কেজি আরডিএক্স ভর্তি গাড়িটি সজোরে ধাক্কা মারলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে এবং ৪০ জন সি আর পিএফ’র মৃত্যু হয়।
গত ২২ এপ্রিল ভূস্বর্গ কাশ্মীরের পহেলগামের কাছেই অপূর্ব সৌন্দর্য বৈসরণ ভ্যালিতে আচমকা সন্ত্রাসবাদী আক্রমণে নিরপরাধ ২৬ জন পর্যটকের প্রাণ চলে গেল। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন লস্কর-ই-তৈবার ছায়া সংগঠন টিআরএফ বলে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদীদের হামলার ঘটনা বহু পুরানো। সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য থাকে নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তারা। জম্মু কাশ্মীরে প্রতিনিয়ত ছোট বড় মাঝারি সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়ে থাকে। এবারে পহেলগামে পর্যটকদের উপর হামলা একটি বিরল ঘটনা। শিশু মহিলা পরিবার পরিজনের উপর পৈশাচিক নৃশংস আক্রমণে সমগ্র দেশ শোকস্তব্ধ। দেশের সরকার সব রাজনৈতিক দল সহ কোটি কোটি জনগণ একই সুরে ঐক্যবদ্ধভাবে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্বেগ ও নিন্দার বার্তা এসেছে।
নিরাপত্তা? বজ্র আপনি?
পুলওয়ামায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের পাশাপাশি উগ্রপন্থীরা বাসের কনভয়কে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। এই সন্ত্রাসবাদীরা কোথায় লুকিয়ে পড়ল? সেদিন জোর তল্লাশি চালিয়ে কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল গোয়েন্দা বিভাগের নজরদারির চূড়ান্ত ব্যর্থতা। সেনা কনভয় আসবে এটা পূর্ব ঘোষিত। একসঙ্গে এতগুলি কনভয় জাতীয় সড়ক দিয়ে যাচ্ছে সেখানে কোনও নিরাপত্তার সুব্যবস্থা ছিল না। কেন সেনা কনভয়কে রক্ষা করার জন্য নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে দেওয়া গেল না? বারে বারে এইসব ঘটনা ঘটছে। তৎকালীন জম্মু কাশ্মীরে রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক পুলওয়ামার ঘটনা সম্পর্কে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রকাশ্যে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। আজও তার তদন্ত অন্ধকার রয়ে গেল।
পহেলগাম বৈসরনের ভ্যালির মতো জনপ্রিয় পর্যটক কেন্দ্রে প্রতিদিন পায়ে হেঁটে ঘোড়ায় চড়ে প্রায় দুই হাজারের মতো পর্যটক ঘুরতে যান। অথচ সেখানে কোনও নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। এক ঘণ্ট পরে নিরাপত্তা কর্মীরা আসে। সন্ত্রাসবাদীরা সীমান্ত পেরিয়ে আট ঘণ্টা কাশ্মীরের অভ্যন্তরে পথ অতিক্রম করে পর্যটকদের খুন করে নিরাপদ আস্তানায় ফিরে গেল। আবারও দেখা গেল গোয়েন্দা বিভাগের চূড়ান্ত ব্যর্থতা। পুলওয়ামার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলে পাকিস্তানকে দেখে নেওয়া, উচিত শিক্ষা দেওয়া, ও বদলা নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন-" যে আগুন জনগণের মনে জ্বলছে তা আমার হৃদয় জ্বলছে"। বদলা নেওয়া, প্রতিশোধ নেওয়া, নিরাপত্তা বাহিনীর পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হলো। সেনাকর্তা কে জে এস ধিলোর হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন" কাশ্মীরে যারা ঢুকবে তারা আর জীবিত ফিরে যাবে না"।
পহেলগামের ঘটনায় সেই একই রকম হুঙ্কার ও হুঁশিয়ারির পুনরাবৃত্তি। প্রধানমন্ত্রী কি বলছে দেখুন "সন্ত্রাসবাদী হামলার কঠোর জবাব দেবে ভারত। এমন নৃশংস প্রত্যক্ষ করে প্রতিটি ভারতবাসী রক্ত ফুটেছে বলেই আমার বিশ্বাস"। সেদিনের হামলায় ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যায়বিচার পাবেন। সমুচিত জবাব দেওয়া হবে সন্ত্রাসবাদী এবং হামলার চক্রান্তকারী বা মদতদাতাদের। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। ঘটনার পর কেবলই হুঙ্কার ও হুঁশিয়ারি। গোয়েন্দা বিভাগের ব্যর্থতা কতটা প্রকট ১৪/১৫ দিন হয়ে গেল হামলাকারী সন্ত্রাসবাদীদের ধরতে পারেনি ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী। বিভিন্ন চ্যানেলগুলিতে কর্পোরেট মিডিয়া যেভাবে উচ্চস্বরে প্রচারে ঝড় তুলেছে তাতে মনে হয় যুদ্ধ লাগাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। সমগ্র দেশের মানুষ গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে। কেন্দ্রের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। তার কাছে বিহারের নির্বাচনে প্রচারে যাওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পার্লামেন্ট ও রাজ্যসভার অধিবেশন ডেকে দেশ-বিদেশের জনগণের কাছে কোনও সঠিক বার্তা দেওয়া গেল না।
নিরাপত্তার ঘেরাটোপ
স্বাধীনতার পর দেশ রক্ষার প্রশ্নে সেনাবাহিনী গঠন, সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত দেশকে শক্তিশালী করার জন্য প্রতিরক্ষা বাজেট নিয়ে কেউ কোনোদিন কোনও প্রশ্ন তোলেনি। তাহলে দেশের মাথা ভূস্বর্গ কাশ্মীরের নিরাপত্তা নিয়ে বারে বারে এত ফাঁক থাকছে কেন ? সন্ত্রাসবাদীদের গতিবিধির জন্য ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। জম্মু কাশ্মীরে ৩.৪৩ লক্ষ নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন। এরমধ্যে অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে ২.৩১ লক্ষ এবং সীমান্ত বরাবর ১.১২ লক্ষ নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত আছে নজরদারিতে গোয়েন্দা বাহিনী। নিয়ন্ত্রণ রেখার অনুপ্রবেশ রোখার জন্য থাকেন সেনা জওয়ান মধ্যবর্তী বৃত্তের দায়িত্বে মূলত সিআরপিএফ ও স্থানীয় পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকে জম্মু-কাশ্মীরের পুলিশ। তাহলে তিনটি বৃত্ত ভেদ করে নিখুত লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে। গোয়েন্দারা কোনও আগাম সতর্ক বার্তা দিতে পারলো না।
বিভাজন ও সাম্প্রদায়িকতা
দেশভাগের পর থেকে পাকিস্তানের মাঝে অধুনা পূর্ব পাকিস্তান এবং এখন বাংলাদেশের মৌলবাদী শাসক শ্রেণি দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতা দখলের জন্য ভারতে ইসলাম বিপন্ন, ভারতের মুসলিমরা ঘোর বিপদে, হিন্দু ভারত ইত্যাদি বিদ্বেষ মূলক প্রচার তুলে ক্ষমতায় আসতে চায়। একইভাবে ভারতে বর্তমানে বিজেপি সরকার ক্ষমতা থাকার জন্য বাইরের শত্রু পাকিস্তান এবং ভিতরের শত্রু মুসলিমদের লক্ষ্য করে ধর্মীয় মেরুকরণ রাজনীতিকে হাতিয়ার করে নির্বাচনে সাফল্য পেতে চায়।
সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনায় এই প্রথম দেখা গেল সরকার ও গোয়েন্দা বিভাগের ব্যর্থতা ঢাকতে শাসক শ্রেণির রাজনৈতিক দল বিজেপি ও তাদের হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, আইটি সেল, কর্পোরেট মিডিয়া একযোগে দেশজুড়ে রাস্তায় নেমে সন্ত্রাসের দায় কাশ্মীরি জনগণ ও মুসলিমদের উপর চাপিয়ে বিভাজন,মেরুকরণ ও বিদ্বেষের প্রচার তীব্রতর করছে। এমনকি দেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন প্রগতিশীল এই গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদেরকে নিশানা করা হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে বিজেপি ও সঙ্ঘের লোকেরা প্রচার তুলেছে, সন্ত্রাসবাদীরা হিন্দু পরিচয় জেনে খুন করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার বলছে এই সন্ত্রাসের পিছনে পাকিস্তান সরকার, তার আইএসআই গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা মদতপুষ্ট। এরা পাকিস্তানের অর্থ অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে তৈরি হয়। এই সন্ত্রাসবাদীরা তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভারত ও জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যপরিচয় খুঁজতেই পারে। এখানে সন্ত্রাসবাদীদের এই বিভাজনের কৌশলকে পুঁজি করে ভারতের উগ্র জাতপাত ধর্ম বর্ণের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে কাশ্মীরি ছাত্র-ছাত্রী চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী বিশেষ করে শাল ব্যবসায়ীদের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে, এমনকি পুলিশ দিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করে গ্রেপ্তার পর্যন্ত করা হচ্ছে। এমনকি দেশের বহু স্থানে সাধারণ নিরীহ মুসলিমরা আক্রমণের শিকার হচ্ছে। কর্পোরেট মিডিয়া হিন্দু পরিচয়ে খুন প্রচার তুলে অজানা না বোঝা মানুষদের মধ্যে বিভ্রান্ত ছড়ানো হচ্ছে। এই দেশে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিরোধের থেকে হিন্দু হিন্দুতে, মুসলমান মুসলমানদের মধ্যে মারামারি হুমকি আক্রমণ খুন ইত্যাদি হাজার গুণ বেশি হয়। সমাজে শ্রেণি স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ, আর্থিক সংঘাত, ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে হানাহানি মারামারি গ্রেপ্তার খুন পর্যন্ত অহরহ হচ্ছে। সুতরাং পহেলগামে সন্ত্রাসের মোকাবিলা দলমত নির্বিশেষে সবাই একজোট হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে করতে হবে। বিভাজন সাম্প্রদায়িক জিগির তুলে ও মেরুকরণের রাজনীতি করে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করা যাবে না।
সন্ত্রাসবাদের ধর্ম সন্ত্রাসবাদ
ইঁদুর মারার জন্য কেউটে সাপ পুষলে তার ছোবল খেতে হবে। পাকিস্তানের অর্থ অস্ত্রে ও প্রশিক্ষণে পুষ্ট লস্কর-ই-তৈবা,জৈস-ই মোহাম্মদ হযরত-আল-মুজাহিদিন নির্বিচারে কাশ্মীরিদের খুন করেছিল। ঝিলাম নদীর বুক দিয়ে যত জল গড়িয়েছে তার থেকে বেশি কাশ্মীরিদের রক্ত ঝরেছে। সন্ত্রাসবাদ বুমেরাং হয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিখ্যাত লাল মসজিদ সহ অন্যান্য মসজিদ, ঈদগাহ মাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শহরের জনবহুল বাজার সেনাবাহিনীর প্রধান কেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শত সহস্র নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তানে এখনো প্রায় প্রতিদিন সন্ত্রাসবাদী বিস্ফোরণ ও নাশকতামূলক কাজকর্ম সংঘটিত হচ্ছে। এখানে তো মুসলিম মুসলিমদের খুন করছে। পাকিস্তানের তালিবানী সন্ত্রাসবাদীরা কিশোরী মালালা ইউসুফজাইকে খুন করতে চেয়েছিল, সে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। পরে শান্তি পুরস্কারে ভূষিত। বাংলাদেশে ৭১ -এর স্বাধীনতা যুদ্ধে নয় মাসে ত্রিশ লক্ষ পুরুষ ও দু’লক্ষ মহিলাকেদের খুন করেছিল জামাত, রাজাকার, আল বদর ইসলামপন্থী মৌলবাদী পাকিস্তানিরা। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে কিশোরগঞ্জে ঈদের নামাজে দু’লক্ষ মানুষের জমায়েতকে লক্ষ্য করে সন্ত্রাসবাদীরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বেশ কিছু মানুষকে খুন করেছিল। শেখ হাসিনা বলেছিলেন— ঈদের দিন যারা মানুষ খুন করে তারা ইসলামের কেউ না, সন্ত্রাসবাদী। তারা ইসলামের শত্রু। ইরাকের শহরে সিয়া-শুন্নিদের মধ্যে লড়াই রক্ত ঝরেছিল। সিরিয়াতে আসাদ ও তার বিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটছে। এখানে সবই তো মুসলমান মুসলমানদের খুন করছে। তাহলে এখানে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে মুসলিম সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক কোথায়? সন্ত্রাসবাদীদের ধর্ম সন্ত্রাসবাদ, ইসলাম নয়। আবার সব মুসলমান সন্ত্রাসবাদী নয়। তাই ধর্মীয় পোশাক পরে হাতে রাইফেল নিয়ে আল্লাহ আকবর ধ্বনি দিয়ে বা হিন্দু পরিচয় জেনে সন্ত্রাসবাদীরা ইসলামকে ব্যবহার করে খুন করতে পারে। কিন্তু ধর্মীয় আদর্শ নীতিনৈতিকতা, আচার-আচরণের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের কোনও সম্পর্ক নেই। তাই হিন্দু হিন্দু ভাই ভাইয়ের অর্থ কি? আদানি আম্বানির কারখানায় কর্মরত হিন্দু শ্রমিকদের হিন্দু বলে ১০ টাকা মজুরি বেশি দেয় না, দু’ঘণ্টা কাজ কম করায় না। হিন্দু বলে হিন্দুরা যদি হিন্দুদের ভালো চাইতো তবে কেন নাথুরাম গডসে ধার্মিক হিন্দু মহাত্মা গান্ধীকে খুন করেছিল? যুক্তিবাদী, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আস্থাশীল নরেন্দ্র দাভালকার, এমএস কালবুর্গি ও গৌরি লঙ্কেশকে হিন্দুত্ববাদীরা কেন খুন করেছিল? হিন্দুদের মধ্যে এত গরিব দারিদ্র বেকারি কেন? ধনী বড়লোক হিন্দুরা হিন্দু বলে এদেরকে দেখছে না কেন?
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাশ্মীরের জনগণ
জম্মু কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ বলেছেন-" ২৬ বছরে এই প্রথম আমি দেখলাম জম্মু কাশ্মীরের মানুষ সন্ত্রাসের পিছনে যুক্তি খুঁজলেন না, বৈধতা দিলেন না, নীরব থাকলেন না। তারা এক যোগে সশব্দে প্রতিবাদ করলেন। নিজেরা নিজেদের থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন কোনও রাজনৈতিক দলের ডাকে না, সরকারি ফরমানে নয়, মানুষ নিজেরাই রাস্তায় নেমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিল করে সন্ত্রাবাদীদের বুঝিয়ে দিলেন"। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী-মেহবুবা মুফতি প্রতিবাদ মিছিল শামিল হয়ে বললেন— "পহেলগামের ঘটনায় কাশ্মীর লজ্জিত"। ধার্মিক লোকেরা ইসলামিক ব্যাখ্যা করে সন্ত্রাসবাদী কাজকে খারিজ করেছেন। কাশ্মীরের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কথা— পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা সমগ্র কাশ্মীরি জনগণের মনে যন্ত্রণা বহুগুণ বেড়ে গেছে। কি দোষ ছিল ওদের? ওরা তো স্বামী-স্ত্রী পরিবার পরিজনদের নিয়ে কাশ্মীরে প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য ভোগ করতে এসেছে। পর্যটকরা আমাদের কাছে মেহমান। আর আমরা কাশ্মীরিরা ভীষণ অতিথিপরায়ণ। কাশ্মীরের অর্থনীতি বিরাট অংশ পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভর। অধিকাংশ পরিবারের ভরণপোষণ চলে পর্যটন ব্যবসার উপর। সন্ত্রাসবাদী হামলা, আতঙ্ক ও প্রাণহানির আশঙ্কা থেকে নিরাপত্তার কোনও পরিবেশ না থাকায় চোখ জোড়ানো ভূস্বর্গ কাশ্মীরের প্রধানত পর্যটন শিল্প ভীষণভাবে মার খাচ্ছে। ফলে কাশ্মীরে বাড়ছে দারিদ্র,যুবকদের মধ্যে ভয়াবহ বেকারি। বেকারত্বের জ্বালায় কাশ্মীরিরা নিজের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ভ্রাম্যমাণ শীত বস্ত্রের ব্যবসা করে। সুতরাং পর্যটকরা যদি ঘুরতে না আসে, তবে তারা খাবে কি? কাশ্মীরিরা কখনো চাইবে না পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসবাদী হামলা। সুতরাং হামলার মোকাবিলা তাদের কাছে বেঁচে থাকা, রুটি রুজির প্রশ্ন জড়িয়ে।
কাশ্মীরের ভারতভুক্তি
দেশভাগের পর কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে চির বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছিল। পাকিস্তান গণভোটের দাবি করে কাশ্মীর পেতে চেয়েছিল। ১৯৪৭ সালের পর কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। দেশভাগের চুক্তি অনুযায়ী ঠিক হয় সামন্ত রাজ্যগুলির শাসকরা স্বাধীন থাকতে পারবে, বা মনে করলে পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে। কাশ্মীরের স্বাধীন রাজা ছিল হরি সিং। হরি সিং দুর্বল রাজা পাকিস্তানের আক্রমণে পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি হানাদাররা শ্রীনগরের তিরিশ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে। তখন কাশ্মীরি জনগণের পক্ষে মূল ক্ষমতার অধিকারী শেখ আব্দুল্লাহ প্রতিরোধের উদ্যোগ নিয়ে ভারতের সাহায্য চাইলো। ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢুকে কাশ্মীরকে রক্ষা করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু ও শেখ আব্দুলার মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রতিরক্ষা, মুদ্রা, যোগাযোগ থাকবে ভারত সরকারের হাতে। বাকি সব বিষয়ে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন থাকবে। এই চুক্তিতে কাশ্মীরি জনগণের বিশেষ মর্যাদা ৩৭০ নম্বর ধারা যুক্ত হলো। এই ধারায় অধিকার আদৌ কোনও সম্প্রদায়িক বিষয় নয়। বর্তমান বিজেপি সরকার ৩৭০ নম্বর ধারা বাতিল করে কাশ্মীরের ভারত ভুক্তির ঐতিহাসিক সত্যকে আড়াল করে বিভাজন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সামনে নিয়ে দেশকে দুর্বল করতে চাইছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দাম্ভিক ঘোষণা ছিল ৩৭০ নম্বর ধারা বাতিল করে জম্মু কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে সন্ত্রাসবাদের অস্তিত্ব নির্মূল করা গেছে। এখন কেউ নুড়ি ছড়ার সাহস দেখাতে পারবে না। সন্ত্রাসবাদের কোমর ভেঙে দিয়েছি বলে বিজেপি নেতারা দাবি করে।
পহেলগামে হত্যা সংঘটিত করে সন্ত্রাসবাদীরা নিরাপদে বাড়িতে চলে গেল।
সুতরাং পহেলগামের ঘটনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর মিথ্যা বাগাড়ম্বর প্রমাণিত হলো।
Comments :0