রাজ্যে ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি গেছে তৃণমূল সরকারের মন্ত্রী-আমলা-নেতাদের চুরি দুর্নীতির কারণে। এনিয়ে উত্তাল রাজ্য। ‘সততার প্রতীক’ প্রচারের ঝড় তোলা মুখ্যমন্ত্রী এখন মানুষের চোখে ‘দুর্নীতির রানি’। কি হবে এই ২৬ হাজারের মধ্যে ১৬-১৭ হাজার যোগ্য শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ? কি হবে যে বিদ্যালয়গুলিতে এরা পড়াতেন? সেই স্কুলগুলোর কয়েক লক্ষ পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ কি? রাজ্যের কয়েক হাজার স্কুল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে মুখ্যমন্ত্রী আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের দুর্নীতির জন্যই। এমনিতেই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে হাজার হাজার পদ শূন্য। রাজ্যের বেশিরভাগ সরকারি স্কুলগুলিতে শিক্ষকের অভাবে পঠনপাঠন আগেই লাটে উঠেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থা তথৈবচ। এই অচলাবস্থার অবসান করার ক্ষমতা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নেই, এটা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। আবার এই দুর্নীতির পাঁক রাজ্যের বিজেপি’র সর্বোচ্চ নেতাদের অনেকেরই গায়ে লেগে আছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু তো চাকরি, সারদা এসব দুর্নীতির দায়ে জেলযাত্রার ভয়েই সটান বিজেপি পায়ে আত্মসমর্পণ করে, রাতারাতি গেরুয়া তিলক কেটে গদা কাঁধে বিরাট সনাতনী হয়ে গিয়েছেন।
কলকাতা হাইকোর্ট ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই’র হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। মমতা সরকারের তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী এবং এবং তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দুটি ফ্ল্যাট থেকে মোট প্রায় ৪৯.৮০ কোটি টাকা নগদ এবং বিপুল পরিমাণ সোনার গয়না উদ্ধার হয়েছিল ২০২২ সালেরই ২২ এবং ২৭ জুলাই। সেই থেকে তারা জেলেই আছেন, কিন্তু কার অনুপ্ররণায় এই বিপুল টাকা চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে তোলা হয়েছিল, তা রাজ্যের সব মানুষ জানলেও মোদী সরকার নিয়ন্ত্রিত ইডি-সিবিআই নাকি জানতে পারেনি! জানতে পারেনি, নাকি দিল্লির সর্বেশ্বরের নির্দেশে ধামাচাপা দিয়েছে, কয়লা, বালি, গোরু, চিট ফান্ডের অর্থ পাচার কাণ্ডের মতোই? এদিকে ইডি-সিবিআই আদালতে জমা দেওয়া চার্জশিটে উল্লেখ করেছে, প্রাথমিক এবং এসএসসি দুর্নীতিতে ১০০০ কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়েছে, যা ভাইপো’র কোম্পানি ‘লিপ্স অ্যা ন্ড বাউন্ডস’ সহ বেশ কিছু বেসরকারি কোম্পানির হাত ঘুরে মানি লন্ডারিং-এর মাধ্যমে কোথাও উবে গেছে। এদের কাউকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো না, কার নির্দেশে? দিল্লিশ্বর মোদীজি’র নির্দেশে? এই কারণেই কি কাকু’র ভয়েস টেস্ট করানো যায়নি মাসের পর মাস? কালীঘাটের কাকুকে ধরতেই যে ইডি-সিবিআই ভয়ে গলদঘর্ম, তারা কালীঘাটের ভাইপো-পিসিকে ধরার সাহস করবে না, এই সহজ সরল সত্য বাংলার ১০ কোটি মানুষের কাছে আজ দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। তৃণমূলের দুর্নীতি বিজেপি আড়াল করবে, নিজেরাও কিছু প্রসাদের ভাগ পাবে, আর তার বিনিময়ে রাজ্যের তৃণমূল বিপদে পড়লেই জাত-ধর্ম-ভাষার নামে দাঙ্গা লাগিয়ে দাও। দুই দলেই মৌলবাদী দাঙ্গাবাজের ছড়াছড়ি, অভাব নেই। এদের পরিকল্পনাতেই রাজ্যের পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করা হচ্ছে। শুরুতেই সেনা নামিয়ে দাঙ্গা প্রতিহত করার পরিবর্তে, তা বাড়তে দেওয়া হলো কেন? মূল সমস্যা বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষে ভেসে যাক। দাঙ্গার আগুনের ধোঁওয়ার আড়ালে চোরেরা লুকোতে চাইছে। হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুধুমাত্র মুসলমানদেরই ধর্মীয় লড়াই নয়। হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষুদ্র একটি উগ্র রাজনৈতিক অংশ। তাদের আক্রমণ শুধু মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়। হিন্দুত্ববাদ দেশের যাবতীয় ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক পরিচ্ছদের বৈচিত্র শেষ করে হিন্দিভাষী, নিরামিষাশী, ব্রাহ্মণ্যবাদী ও পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি গোটা দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করতে চায়। ধর্মব্যবসায়ী দাঙ্গাবাজদের ব্যবহার করে শাসক দুই দল বিজেপি-তৃণমূল চুরি লুটপাট চালাতে চাইছে, আর চোরদের আড়াল করার লক্ষ্যেই দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে।
জ্যোতি বসু বলতেন, সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না। ওর সরকার চায়নি, তাই ৩৪ বছর রাজ্যে দাঙ্গাবাজরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এখনকার তৃণমূল সরকার বিপদে পড়লেই চায়, দাঙ্গা হোক, তাহলেই ওদের চুরি-জোচ্চুরি-লুট আড়াল করতে সুবিধা হয়। তাই, সমস্ত শান্তিপ্রিয়, গণতান্ত্রিক মানুষের কাছে আবেদন, শাসক দুই দলের এই ভয়ঙ্কর ফাঁদে পা দেবেন না। দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, এলাকায় শান্তি বজায় রাখুন।
Editorial
চুরি আড়ালেই দাঙ্গার আগুন

×
Comments :0