বিরোধীদের মতামতকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে চলার প্রবণতা বরাবরই দেখিয়ে আসছে মোদী সরকার। ওয়াকফ আইনের সংশোধনী খতিয়ে দেখার জন্য সরকারপক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যকে নিয়ে গঠিত যৌথ সংসদীয় কমিটিও (জেপিসি) সেই পথে হাঁটল। বাতিল করে দেওয়া হলো প্রস্তাবিত সংশোধনী বিলের উপর বিরোধী সদস্যদের আনা সমস্ত সংশোধনী এবং গ্রহণ করা হলো বিজেপি সাংসদদের পেশ করা সবকটি সংশোধনী। সোমবার নয়াদিল্লিতে কমিটির বৈঠকে বিরোধীপক্ষের সদস্যদের প্রবল প্রতিবাদের মধ্যে সরকারপক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কমিটির চেয়ারপার্সন বিজেপি সাংসদ জগদম্বিকা পাল। এর ভিত্তিতেই ওয়াকফ আইন সংশোধনী বিল নিয়ে কমিটির রিপোর্ট তৈরি করা হবে। বুধবার এই রিপোর্ট অনুমোদন করানো হবে কমিটির বৈঠকে, তাও অবশ্যই সরকারপক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে। তবে কমিটির বিরোধী সদস্যরা আপত্তি জানিয়ে লিখিত বক্তব্য পেশ করতে পারবেন এবং তা মূল রিপোর্টের সঙ্গে যুক্তও থাকবে, যে রিপোর্ট জমা পড়বে লোকসভার অধ্যক্ষের কাছে। বিরোধীপক্ষের কংগ্রেস, ডিএমকে, তৃণমূল কংগ্রেস এবং এআইএমআইএম’র সদস্যরা তা জমাও দেবেন।
মোদী সরকার ওয়াকফ আইনে সংশোধনী আনতে চেয়ে সংসদে যে বিল পেশ করেছে, তাতে ৪৪টি ধারা রয়েছে। যৌথ সংসদীয় কমিটিতে বিরোধীপক্ষের সদস্যরা ৪৪টি ধারার উপরেই সংশোধনী জমা দিয়ে আইনটি যেমন আছে তেমনই রেখে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, সরকারপক্ষ অর্থাৎ বিজেপি ও তার সহযোগী দলগুলির সাংসদদের তরফে পেশ করা হয়েছিল ২৩টি সংশোধনী। জগদম্বিকা পাল এদিন জানিয়েছেন, কমিটির বৈঠকে ভোটাভুটিতে বাতিল হয়ে গিয়েছে বিরোধীপক্ষের আনা সবকটি সংশোধনীই। আর সরকারপক্ষের আনা ২৩টির মধ্যে কমিটি গ্রহণ করেছে ১৪টি সংশোধনী। জানা গিয়েছে, এই ১৪টির মধ্যে রয়েছে বিজেপি সাংসদদের আনা সমস্ত সংশোধনী। সরকারপক্ষের যে ৯টি সংশোধনী বাতিল হয়েছে, সেগুলি সবই বিজেপি’র সহযোগী দলগুলির সাংসদরা জমা দিয়েছিলেন। এর অর্থ, যৌথ সংসদীয় কমিটিতে শুধু বিরোধীপক্ষের আনা সংশোধনীগুলিই বাতিল করা হয়েছে, তা নয়। কমিটিতে বিজেপি সাংসদদের সংখ্যা সবথেকে বেশি হওয়ায় কেন্দ্রের শাসক দল তার সহযোগীদের সংশোধনীগুলিকেও নস্যাৎ করে দিয়েছে। এদিনের বৈঠকে চেয়ারপার্সনের এই সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী ভূমিকার প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিরোধীপক্ষের সদস্যরা। তাঁরা বলেছেন, কমিটি যে রিপোর্ট লোকসভার অধ্যক্ষের কাছে পেশ করতে চলেছে, তাতে মোদী সরকারের প্রস্তাবিল সংশোধনী বিলের ‘দানবীয় চরিত্র’কে মান্যতা দেওয়া হবে। মুসলিমদের ধর্মীয় বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপের রাস্তা তৈরি করবে এই সংশোধনী বিল।
সূত্রের খবর, এদিন কমিটির বৈঠকে ১৬-১০ ভোটে বিরোধীপক্ষের আনা সমস্ত সংশোধনী বাতিল ও সরকারপক্ষের পেশ করা ১৪টি সংশোধনী গৃহীত হয়েছে। এদিন যৌথ সংসদীয় কমিটির চেয়ারপার্সন জগদম্বিকা পাল এই সিদ্ধান্ত জানানোর পরেই লোকসভার সহকারী বিরোধী নেতা ও কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এক্স-এ লেখেন, কমিটি তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করে সরকারের ‘রাবার স্ট্যাম্প’-এর পরিচয় দিল। কমিটির ডিএমকে সদস্য এ রাজা এদিন ক্ষোভ জানিয়ে বলেছেন, এই সংশোধনী বিল সংসদে অনুমোদিত হলেই সুপ্রিম কোর্টে এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে তাঁদের দল। তিনি নিজেও মামলা দায়ের করবেন। এই সংশোধনী বিল নিয়ে কমিটিতে আলোচনার নামে আসলে প্রহসন হয়েছে। বিরোধীপক্ষের অন্য সদস্যরাও একই অভিযোগ করে বলেছেন, সব কিছুই ঠিক করা ছিল আগে থেকে। তাঁদের কার্যত কিছু বলতেই দেওয়া হয়নি। তাঁরা কমিটির বৈঠকে প্রস্তাবিত সংশোধনী বিলের প্রতিটি ধারা ধরে ধরে আলোচনা চেয়েছিলেন। কিন্তু তার অনুমতি দেওয়া হয়নি। বৈঠকে কমিটির চেয়ারপার্সন একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বিরোধীদের মতামতকে কোনও গুরুত্ব দেননি। কমিটির বিরোধী সদস্যরা দিনটিকে গণতন্ত্রের পক্ষে কালো দিন বলেও অভিহিত করেছেন। কমিটির চেয়ারপার্সন জগদম্বিকা পাল স্বাভাবিকভাবেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, সদস্যদের সমস্ত মতামতই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিবেচনা করেছে কমিটি। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত গৃহীত হয়েছে। তাঁর আরও দাবি, কমিটি প্রস্তাবিত বিলের উপর যেসব সংশোধনী গ্রহণ করেছে, সেগুলি ওয়াকফ আইনকে আরও উন্নত করবে। সেই সঙ্গেই তিনি জানিয়েছেন, যৌথ সংসদীয় কমিটি তার রিপোর্টে ওই বিলে যেসব পরিবর্তনের সুপারিশ করবে, সরকার তা মানতে বাধ্য থাকবে।
বিরোধীদের প্রবল আপত্তি ও হইহট্টগোলের মধ্যে গত বছর ৮ আগস্ট বিলটি লোকসভায় পেশ করেছিলেন আইন মন্ত্রী কিরেন রিজুজু। তারপর একরকম বাধ্য হয়ে সরকারের পরামর্শে বিলটি খতিয়ে দেখার জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠন করেন লোকসভার অধ্যক্ষ। ৩১ সদস্যের সেই কমিটিতে বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন শাসক জোট এনডিএ’র সদস্যরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিরোধীরা প্রথম থেকেই বলে এসেছেন, ওয়াকফ আইনে এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ওয়াকফ বোর্ডের উপর নিরঙ্কুশ সরকারি কর্তৃত্ব কায়েম করতে চাইছে মোদী সরকার। তাঁরা ওয়াকফ আইনের এই সংশোধনকে ‘অসাংবিধানিক ও মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ’ বলেও অভিহিত করেছেন। উল্লেখ্য, মোদী সরকারের সংশোধনীতে বলা হয়েছে, মুসলিমদের দান করা কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফের সম্পত্তি বলে ঘোষণা করার অধিকার ওয়াকফ বোর্ডের হাতে থাকবে না। তা ঘোষণা করার ক্ষমতা থাকবে সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকের। বিরোধীদের বক্তব্য, এতে ওয়াকফ বোর্ডের আর গুরুত্ব থাকবে না। বোর্ডের চেয়ারম্যানের থেকে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবেন জেলাশাসক। সংশোধনীর বিলে আরও বলা হয়েছে, ওয়াকফ বোর্ডে দু’জন মহিলা সদস্যের পাশাপাশি দু’জন অ-মুসলিম সদস্যকে রাখা বাধ্যতামূলক। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, অন্যান্য ধর্মীয় সংস্থায় যখন ভিন্ন ধর্মের কাউকে রাখার ব্যবস্থা নেই, তখন ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষেত্রে এই নিয়ম হবে কেন। মোদী সরকার ওয়াকফ আইনকে সংশোধন করে এই ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে যে, অন্তত ৫ বছর যিনি ইসলাম ধর্ম পালন করছেন, তিনিই একমাত্র ওয়াকফের জন্য সম্পত্তি দান করতে পারবেন। বিরোধীরা এর বিরোধিতা করে বলেছেন, যিনি সদ্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন, তিনি ধর্মীয় বা দাতব্যমূলক কাজের জন্য তাঁর সম্পত্তি দান করতে চাইলে তাঁকে ৫ বছর অপেক্ষা কেন করতে হবে। এটা মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকারে অন্যায্য হস্তক্ষেপ।
Comments :0