BOOKTOPIC — SOURAV DUTTA — SHAHID — NATUNPATA | 11 AUGHST 2025, 3rd YEAR

বইকথা — সৌরভ দত্ত — “শহীদ” বাঙলার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের দলিল ও বিপ্লবীদের মূল্যবান জীবনীগ্রন্থ — নতুনপাতা, ১১ আগস্ট ২০২৫, বর্ষ ৩

ছোটদের বিভাগ

BOOKTOPIC  SOURAV DUTTA  SHAHID  NATUNPATA  11 AUGHST 2025 3rd YEAR

বইকথানতুনপাতা

“শহীদ” বাঙলার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের দলিল ও বিপ্লবীদের মূল্যবান জীবনীগ্রন্থ
সৌরভ দত্ত


গোপালচন্দ্র রায় লিখিত শহীদ বইটি বাঙলার প্রখ্যাত বিপ্লবী শহীদদের জীবন-কাহিনী। গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে–ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, কানাইলাল দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, যতীন্দ্রনাথ দাস, সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার,মাতঙ্গিনী হাজরা প্রমুখের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের দলিল। সূচনাতেই রয়েছে ভারতীয় বিপ্লববাদের অক্ষয় সেনানী ক্ষুদিরাম বসুর আত্মবলিদানের কথা। লেখক বলেছেন–“সেদিনকার সেইসব সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা ভারতের স্বাধীনতা সৌধের ভিত গড়ে তুলবার জন্য, নিজেদের কাঁচা মাথা দিয়ে ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন।”১৮৮৯ সালে ৩রা ডিসেম্বর মেদিনীপুর শহরের হবিবপুর অঞ্চলে ক্ষুদিরাম বসুর জন্ম হয়। তাঁর পিতা ত্রৈলোক্যনাথ বসু ও মাতার নাম লক্ষীপ্রিয়া দেবী। ১৮৯৫ সালের ১৮ই অক্টোবর ক্ষুদিরাম মাতৃহীন হন।এর ৪ মাংস পরেই ক্ষুদিরামের পিতা ত্রৈলোক্যনাথেও মৃত্যু হয়।ছেলেবেলা থেকেই ক্ষুদিরাম অন্যায় সহ্য করতেন না। তমলুক হ্যামিল্টন স্কুলে টিফিনের সময় একজন ফেরিওয়ালা স্কুলের ছেলেদের সাথে তার বচসা হয়। ফেরিওয়ালা গালাগালি দেয় ক্ষুদিরাম মার্বেল খেলছিলেন। ক্ষুদিরাম দৌড়ে গিয়ে ফেরিওয়ালার খাবারের ঝুড়ি ফেলে দেন।১৯০৫ সালের আগস্ট মাসে থেকে দেশজুড়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন এর সূচনা হয়‌।স্বদেশী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের সর্বত্র।১৯০৫ সালে আগস্ট মাসে প্রথমদিকে বঙ্গবিভাগের প্রতিবাদে বিরাট জনসভা হয়।এই সভায় ক্ষুদিরাম ও যোগ দেয়।এই সময় মেদিনীপুরে গুপ্ত বিপ্লবী চক্র ছিল। ক্ষুদিরাম প্রথম দিকে গুপ্ত সমিতিতে যোগ দিয়েছিলেন। ক্ষুদিরাম প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লেখক বলেছেন–“ক্ষুদিরাম একদিকে এইরূপ নির্ভীক ও অনমনীয় তরুণ বিপ্লবী হয়ে উঠলেও তাঁর হৃদয়ের আরও একটা দিক ছিল।সেটা তার দয়া ও করুণার। ক্ষুদিরাম দীনার্ত ভিখারিকে ট্রাঙ্ক খুলে একজোড়া ভালো শাল উপহার দিয়েছিলেন।যে শাল তাঁর বাবাকে নাড়াজোলের রাজা উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। ক্ষুদিরাম বৈপ্লবিক গুপ্ত সমিতিতে যোগদানের পরেই দিদির বাড়ীতে থাকা ছেড়ে দেন। ক্ষুদিরাম দিদির বাড়ী ছেড়ে বিপ্লব সমিতির তাঁতশালা নামক বয়ন বিদ্যালয়ের বাড়ীতে এসে বাস করতে লাগলেন।১৯০৭ সালে ডিসেম্বর মাসে মেদিনীপুরের রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে ক্ষুদিরাম সেচ্ছাসেবক রূপে যোগদান করেছিলেন।সেই সময় কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সীর ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মিস্টার কিংসফোর্ড । একবার সুশীল সেন নামক ১৫বছরের বালককে সার্জেন্ট মারলে । সুশীল তাকে ঘুসি মাসে কিংসফোর্ড পাল্টা সার্জেন্টকে ঘুসি মারে।কিংসফোর্ড এজন্য সুশীলকে ১৫ঘা বেত মারার নির্দেশ দেন।এরপর কিংসফোর্ড মুজফ্ফর পুরে জেলা ও দায়রা জজ হয়ে বদলি হয়ে যান বিপ্লবীরা শপথ নেন মুজফ্ফরপুরে গিয়েই অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যা করবেন।১৯০৮ সালে প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম হাওড়া থেকে মুজফ্ফর পুরে রওনা দেন। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল ঠিক করেছিলেন কিংসফোর্ড ইউরোপীয়ান ক্লাব থেকে বেরোলেই তাকে হত্যা করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্লাব থেকে শ্বেতাঙ্গ উকিল কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা ক্লাব থেকে ফিরছিলেন। প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম ভুলবশত ভাবলেন এটাই কিংসফোর্ড এর গাড়ী। ক্ষুদিরাম চরম প্রত্যাঘাতে গাড়ীর উপর বোমা ফেললেন।গাড়ী চুরমার হল,সহিংস আহত হল এবং মিস্টার কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা মারা গেলেন।এরপর প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম সন্তর্পনে স্টেশনের কাছের এক আমবাগানে আশ্রয় নেয়। প্রফুল্ল ক্ষুদিরামকে খাবার কিনতে পাঠায়। ক্ষুদিরাম যখন দোকানে গিয়ে জল খাচ্ছিলেন তখন ছদ্মবেশী শিবপ্রসাদ মিশ্র ও হতে সিং সন্দেহের বশে ক্ষুদিরামকে গ্রেপ্তার করে। ক্ষুদিরামকে মুজফ্ফরপুরে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ীতে তোলবার সময় “বন্দেমাতরম” ধ্বনি দেয়।৮ই জুন নরহত্যার অভিযোগে মুজফ্ফরপুরে ক্ষুদিরামের‌ বিরূদ্ধে মামলার বিচার আরম্ভ হয়। ক্ষুদিরামের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়।মামলায় সরকার পক্ষের মোট ২৪ জন সাক্ষী ছিল। বিখ্যাত আইনজীবী নরেন্দ্র কুমার বসু হাইকোর্টে ক্ষুদিরামের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। বিচারপতি ব্রেট ও বিচারপতি রাইভস্ ১৩ ই জুলাই মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন। উকিল কালিদাস বসু ক্ষুদিরামকে দিয়ে বড়লাট এর কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন জানালেও কাজ হয়নি।বড়লাট ক্ষুদিরামের ফাঁসি বহাল রাখে ।১১ই আগস্ট ফাঁসির দিন ধার্য হয়। কারাগারে ক্ষুদিরামের ফাঁসির প্রত্যক্ষ দর্শী উপেন্দ্রনাথ সেন “ক্ষুদিরাম” প্রবন্ধে লিখেছেন–“দ্বিতীয় লৌহদ্বার উন্মুক্ত হ’লে আমরা জেলের আঙিনায় প্রবেশ করলাম। দেখলাম,ডান দিকে একটু দূরে প্রায় ১৫ ফুট উঁচুতে ফাঁসির মঞ্চ।দুদিকে দুটো খুঁটি একটা মোটা লোহার আড়দ্বারা যুক্ত।…মঞ্চে উপস্থিত হলে তার হাত দুখানি পিছনে এনে রজ্জুবদ্ধ করা হল।একটা সবুজ রঙের পাতলা টুপি দিয়ে তার গ্রীবামূল পর্যন্ত ঢেকে দিয়ে গলায় ফাসিঁ লাগিয়ে দেওয়া হল।‌ক্ষুদিরাম সোজা দাঁড়িয়ে রইল । এদিকে ওদিকে একটুও নড়ল না।উডম্যান সাহেব ঘড়ি দেখে একটা রুমাল উড়িয়ে দিলেন।একটি প্রহরী মঞ্চের একপাশে অবস্থিত একটি হ্যাণ্ডেল টেনে দিল। ক্ষুদিরাম নীচের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।”ফাঁসি হলে গেলে কালিদাস বসুর নেতৃত্বে ক্ষুদিরামের শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করা হয়। সরকারের নির্দেশে নির্দিষ্ট পথ দিয়ে ক্ষুদিরামের মৃতদেহ নিয়ে শবানুগমন হয়। রাস্তায় দুপাশে দাঁড়িয়ে বহু মানুষ সেদিন চোখের জল ফেলেছিল। লেখক বলেছেন–“ক্ষুদিরামের নশ্বর দেহ শেষ হয়ে গেছে কবে, কিন্তু তিনি এখন ও অবিনশ্বর হয়ে রয়েছেন তাঁর দেশবাসীর হৃদয়ে।”তাঁর মৃত্যুর পর কোনো এক অজ্ঞাত কবি গান রচনা করেছিলেন–“(আমায়) এবার বিদায় দে মা,/ঘুরে আসি/হাসি হাসি পরবো ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।”ক্ষুদিরাম ছাড়াও প্রফুল্ল চাকীর মুক্তি সাধনার কথা উঠে এসেছে গ্রন্থে।যিনি নিজের শত্রুর হাতে ধরা পড়ে গেছেন বুঝে রিভলবার দিয়ে শেষ করে দিয়েছিলেন নিজেকে।৩রা মে বন্ধু ক্ষুদিরামকে দিয়ে সনাক্ত করা হয়েছিল তার দেহ। অগ্নিযুগের বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিবৃত্ত রয়েছে বইটিতে। কানাইলাল এর পৈতৃক বাড়ি ছিল শ্রীরামপুরে। ফাঁসির দণ্ডাদেশের পর থেকে ফাঁসির দিন পর্যন্ত কানাইলালকে খুব খুশি দেখা যেত। ফাঁসির দিন পর্যন্ত তার ওজন ১৬ পাউণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছিল। হাসিমুখে তিনি ফাঁসির মঞ্চে এসেছিলেন। ফাঁসির সময় কানাইলাল শুধু বলেছিলেন-“দড়িটা কড়া হয়েছে,বড় লাগছে;ঠিক করে পরিয়ে দিন। মৃত্যুর পর বিরাট শোভাযাত্রা করে কানাইলালের মৃতদেহ শ্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়।বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু থেকে শুরু করে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, যতীন্দ্রনাথ দাস, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার,মাতঙ্গিনী হাজরা প্রমুখের অকুতোভয় সংগ্রামী জীবনের কাহিনি ও কারাবরণ থেকে মৃত্যু বর্ণের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে “শহীদ” নামক এই গ্রন্থটিতে।

গ্রন্থের নাম–শহীদ
লেখক–গোপাল চন্দ্র রায় 
প্রকাশক–শ্রী যতীন্দ্রনাথ সেন
সেন্ট্রাল বুক এজেন্সি 
মূল্য–দেড় টাকা
প্রকাশকাল–ডিসেম্বর ১৯৪৮

Comments :0

Login to leave a comment