Post Editorial Ganashakti Price increase

মূল্যবৃদ্ধি: বাঁচা কঠিন এ ভারতে

সম্পাদকীয় বিভাগ

Post Editorial Ganashakti Price increase



দেশের বিজেপি সরকারের মুখপাত্ররা গর্বিত কারণ দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার ২০২২ সালে এখন বর্তমানে নিচের দিকে এবং ৬%-এর নিচে নেমেছে। দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে যে ব্যাঙ্কের আর্থিক নীতি অদল -বদল করেই এই কাজ করা সম্ভব হয়েছে। কী করা সম্ভব হয়েছে ? এই ৬% যা নিয়ে সরকার এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এত মাথাব্যথা তার অর্থই বা কী ? ২-৬% রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আর্থিক নিয়মে অর্থনীতির সহ্যশক্তির পরিমাপ। তাই এই সহ্যশক্তির উচ্চসীমার সামান্য নিচে মূল্যবৃদ্ধির হার যেই নেমেছে সরকারি ভাষ্যে সাফল্যের দাবি করা হচ্ছে । কিন্তু গত এক বছরে কেমন ছিল এই মূল্যবৃদ্ধির হার ? গত জানুয়ারি মাস থেকে সারা বছর জুড়ে কখনোই মূল্যবৃদ্ধির হার ৬%-এর নিচে ছিল না। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে তা ছিল ৭.৩%। আর বছর যখন শেষ হচ্ছে তা সবে ৬% ছুঁয়েছে। এই বছর ধরে তা সবসময় ৬%-এর বেশি ছিল।

ভারত সরকার এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলেছিল যে লক্ষ্যমাত্রা ৪%-এ থাকবে । কিন্তু কোনোদিন তা রাখতে পারেনি। একটি দেশের মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত যে সহ্যশক্তির কথা বলা হয়, তা অর্থনীতির সহ্যশক্তি। মূল্যবৃদ্ধি আর্থিক বৃদ্ধিকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে। দেশের অর্থনীতি, আর্থিক বৃদ্ধির কি দুরবস্থা তা তো এখন কোনও সরকারি রিপোর্টেও লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না ।


আমাদের দেশের অর্থনীতির সমস্যা হলো এই যে দেশের সরকার নিজের দেশের আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলা করার বদলে তা অস্বীকার করেছে, বিদেশের অর্থনীতিতে যা ঘটছে তার প্রতিফলন বলে বলার চেষ্টা করেছে। এই বিপুল হারে  মূল্যবৃদ্ধির সময়েও সেই একই কাজ তারা করছে। সম্প্রতি জি-২০ নামে কুড়িটি দেশের সভা নেতৃত্ব করার জন্য ভারত সরকার এগিয়ে এসেছে। এই ২০টি দেশ হলো আর্জেন্টিনা, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ক্যানাডা, চীন, ইউরো দেশগুলি, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনাশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রিটেন, আমেরিকা। এই দেশগুলিতেও মূল্যবৃদ্ধির হার বেশি । আইএমএফ দুটি বিষয়ের কথা বলেছে- কোভিড অতিমারী এবং ইউক্রেন যুদ্ধ এই দেশগুলিকে প্রভাবিত করেছে।

তাই এখানে মূল্যবৃদ্ধির হার বেশি। আমাদের দেশের সরকারও তাই এই কারণদুটির কথা বলছে। বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগে বিপর্যয় ঘটলে আমদানি-রপ্তানির মূল্যে একমাত্র তার প্রভাব পড়বে। কেন্দ্রীয় বাণিজ্য দপ্তর যে আমদানি-রপ্তানির তথ্য জানিয়েছে তাতে জানা যায় যে সামান্য হারে রপ্তানি বাড়লেও, আমদানি ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের তুলনায় ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে ১২% -এর বেশি কমে গেছে। তাই আমদানি জাত উৎপাদনের উপাদান পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে বলে সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে এমন ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না । আমদানির চাহিদা দেশের ভিতরে কমে গেছে । ওদিকে আমাদের ভারতীয় রপ্তানির চাহিদাও বহির্বিশ্বে কমেছে বিশেষ করে আমেরিকা আর ইউরোপ থেকে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য জানাচ্ছে যে বিশ্ব বাজারের যা প্রভাব তার চেয়ে দেশের ভিতরের অর্থনীতির বিপর্যয়ের প্রভাব অনেক বেশি। 

যে যে কারণে দেশে এই মূল্যবৃদ্ধি তার মধ্যে আশঙ্কার কথা এই যে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি স্থায়ীভাবে বেশি থেকেছে এবং বর্তমানে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ৭%। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার তুরস্ক, আর্জেন্টিনায় অনেক বেশি এই কথা বলে দেশের সরকার নিজের দোষ ঢাকতে পারে কিন্তু সাধারণ মানুষের এই কথা শুনে কী লাভ? দেশের মানুষ কিন্তু দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার এবং দেশে গড় মূল্যবৃদ্ধির হার নিয়ে চিন্তিত নন। দেশের মানুষের কাছে চিন্তার বিষয় তার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারা, খাদ্যপণ্য কিনতে পারা। মূল্যবৃদ্ধির হার আর্থিকভাবে সহনীয় না হলে দেশের মানুষের মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে আশঙ্কা বাড়তে থাকে। ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচক কিন্তু গত এক বছরে অসহনীয়ভাবে বেড়েছে, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্য কোনোভাবেই কমছে না। মূল্যবৃদ্ধির হার সম্পর্কে চিন্তা এখানেই যে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার কমানো না গেলে মূল্যবৃদ্ধির হারে লাগাম টানা যাবে না।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এক সমীক্ষা করেছে যাতে দেখা গেছে যে শহরের মানুষের মধ্যে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি অর্থাৎ আর্থিক বৃদ্ধি এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে হতাশার পরিমাণ খানিকটা কমলেও, নাগরিকদের অর্ধেকেরও বেশি এ বিষয়ে হতাশাগ্রস্ত অর্থাৎ তাঁরা মনে করেন না যে মূল্যবৃদ্ধির হার কমবে। এমনটা হলে বিপদ এটাই যে মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়বে ধরে নিয়ে তারা আর্থিক সিদ্ধান্তগুলি নেবেন এবং তা এই হারকে আরও বাড়িয়ে দেবে। এই দেশের অর্থনীতির উপর ভরসা চলে গেলে কোনও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প সংগঠিত করা যাবে না। সব কিছুই হবে স্বল্পমেয়াদি এবং ফাটকাপ্রবণতা বাড়বে ।

দেশের এই মূল্যবৃদ্ধির হারের সাথে প্রায় তাল মিলিয়েই দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। দেশে আয়ের বৈষম্য এতই বেড়েছে যে কোটিপতির সংখ্যা যেমন বাড়ছে, অনাহারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। তাই আমাদের দেশে ভোগ্যপণ্যের বিক্রির মধ্যেও এই বৈষম্য ধরা পড়ছে। বিলাস পণ্য যা একমাত্র উচ্চবিত্ত মানুষেরাই কেনেন, তার বিক্রি বাড়ছে। কিন্তু জ্বালানি, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ নাগরিকদের ভোগের মাত্রা কমে গেছে। তাদের সঞ্চিত অর্থে টান পড়ছে। নাগরিকদের সঞ্চয় কমছে। মূল্যবৃদ্ধির জন্য টাকার অঙ্কে মোট ক্রয় বাড়লেও, পণ্যের পরিমাণ কমছে। এক বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষার ফল বলছে ৩৫% নাগরিক মনে করছেন যে যা তারা আগে কিনতেন, তার চেয়ে তাদের খরচ বেশি হলেও কেনার পরিমাণ কমে গেছে। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় পণ্য কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে। চাহিদা ক্রমাগত কমিয়ে দিয়েও এর মোকাবিলা করতে পারছে না দেশের মানুষ।

দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়া দেশের আর্থিক উন্নতির পক্ষে ক্ষতিকারক। কিন্তু এই ক্ষতিকারক দিকটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে বিজেপি সরকার। মূল্যবৃদ্ধির জন্য যে মানুষের চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার, এই মনোভাব কোনোদিন তাদের ছিল না। 
মূল্যবৃদ্ধির দুটি কারণ হয়— উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি এবং ভোগ্যপণ্যের চাহিদা । এদেশে তো সঙ্কট দেশের মানুষের কমে যাওয়া ক্রয়ক্ষমতা এবং এর ফলে চাহিদার সঙ্কোচন। কিন্তু আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি, কোটিপতি ও ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বিলাস পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি কিন্তু খাদ্যপণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া– এই অবস্থা থেকে দেশকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বিজেপি সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কে দায়িত্ব দিয়েছে যা ক্রমাগত সুদের হার বাড়িয়ে এর মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে । কিন্তু এর ফলে কি শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত মজুরি বাড়বে? মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রকৃত মজুরি কমতে থাকে, এর ফলে অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল হয়ে ওঠে। ইউরোপ, আমেরিকায়, অন্যান্য ধনী দেশগুলিতে অনিবার্যভাবে শ্রমিক বিক্ষোভ, ধর্মঘট হয়। বর্তমানে তাই আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এই ধরনের মূল্যবৃদ্ধি রোখা সম্ভব হয় না ব্যঙ্ক ব্যবস্থার মাধ্যমে সুদের হার ওঠা নামা করিয়ে।

মানুষের হাতে সঞ্চয় করার মতো অর্থ না থাকলে সঞ্চয়ের পরিমাণের সাথে সুদের হারের সম্পর্ক থাকে? দেশের মানুষের এক বড় অংশ কিনতে না পারলে, উৎপাদন উৎসাহ পায় না। সবটাই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের আর্থিক নীতির চোখ দিয়ে বিচার করলে হয় না। দেশের মানুষের চাহিদা বাড়ানোর ক্ষমতা রিজার্ভ ব্যঙ্কের নেই। 
দেশের বেশির ভাগ মানুষ যেখানে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত, তাদের হাতে অর্থ তুলে দেওয়া প্রয়োজন। এটা প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কেইন্সের দাওয়াই শুধু নয়। অর্থনীতি আগে টিকে থাকবে, তারপর তো তার বৃদ্ধি হবে। দেশের মানুষ আগে খেতে পাবে, তারপর তো সে সঞ্চয় করবে। গণবণ্টন বা রেশন প্রকল্পকে মজবুত করার প্রচেষ্টা নেওয়া প্রয়োজন ছিল বহু আগে থেকেই। কোভিডের সময়েও তাকে শক্ত পোক্ত করতে সরকার নারাজ ছিল। কিছুদিন আগে সরকার ঘোষণা করতে কার্যত বাধ্য হয়েছে যে ২০১৩ সালের খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুযায়ী দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বিনামূল্যে রেশন পাবে। প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বন্ধ হয়ে যাবে। তাহলে বিনামূল্যে ৫ কিলো চাল-গম পাওয়ার আর কোনও প্রকল্প রইল না। আর বেশ কিছু টন খাদ্যশস্য সরকার খোলা বাজারে ছেড়ে দিতে পারে যেখান থেকে আবার দেশবাসীকে সেই অগ্নিমূল্য দিয়ে কিনতে হবে। কারণ অতিমারীর বিশেষ ব্যবস্থা গুটিয়ে যাচ্ছে, এখন কম পরিমাণে রেশন পাওয়া যাবে। প্রয়োজন ছিল দুটি প্রকল্পই চালু করা। এই সময়েই তো দেশে ক্ষুধা, খাদ্যসঙ্কট তীব্র হয়েছে।

ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির প্রকৃত সঙ্কট আড়াল করে এসেছে বিজেপি সরকার। বারবার সঙ্কটের জন্য বহির্বিশ্বকে দায়ী করেছে সরকার। কিন্তু দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কিভাবে বাড়বে তার কোনও দায়িত্ব নেয়নি কোনোদিন। এবারো সেই দায়িত্ব এড়িয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সুদের হারের গতিবিধি দিয়ে ফাটকা পুঁজির সুবিধা করে দিচ্ছে সরকার। এভাবে কি অর্থনীতিকে বেশি দিন টিকিয়ে রাখা যায়? এভাবে কি দেশের শ্রমজীবী মানুষের বিক্ষোভ দাবিয়ে রাখা যায় ? সারা পৃথিবীতে যা সম্ভব হয়নি, বিজেপি সরকার তাই করে দেখানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে দেশের মানুষকে, যা এককথায় বাতিল এবং অসম্ভব পরিকল্পনা ।     

Comments :0

Login to leave a comment