Ballabhpurer Rupkotha

বড় পর্দায় থিয়েটারের দিগ্বিজয়

ফিচার পাতা

ছবি: বল্লভপুরের রূপকথা
পরিচালনা: অনির্বাণ ভট্টাচার্য


অভিনয়ে: সত্যম ভট্টাচার্য, শ্যামল চক্রবর্তী, সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সঞ্জীব ভট্টাচার্য, দেবরাজ ভট্টাচার্য।
‘‘এক গপ্প হাজারবার বললি, সে আর এক গপ্প থাকে না। পালটি পালটি যায়। মানুষের জেবনের মত।’’ বল্লভপুরের রাজা, রায় রাহান শ্রীযুক্ত ভূপতি রায় ভুঁইয়া বাহাদুর যখন পাওনাদারদের ভয়ে আগের স্টেশনে নেমে, রাতের অন্ধকারে নদী পেছিয়ে নিজের প্রাসাদে ফিরছিলেন, তখন নৌকোয় থুত্থুরে বুড়ো, মহা বক্তিমেবাহু কিন্তু ঘোর দার্শনিক মাঝিভাইটি ওপরের ওই অমরবাণীটা শুনিয়েছিলেন। রাজামশাই অবশ্য বাণী শুনে, মাঝির ভাড়ার টাকাটা বাকি রেখেই, চাদর মুড়ি দিয়ে, ঝোপ-জঙ্গল পেরিয়ে প্রাসাদের দিকে ছুট লা‍‌গিয়েছিলেন! তবে প্রি-টাইটেল সিকোয়েন্স-এর এই সংলাপটা, বাকি ছবিটায় যে শুধু একাধিবার ফিরে ফিরে এসেছে, তাই নয়— ছবির ‘মরাল’-ও ওটাই। কারণ নাটকের মানুষ অনির্বাণ ভট্টাচার্যর বড় পর্দায় প্রথম কাজ ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ আসলে গপ্প বলার বা গপ্প সাজানোর গপ্পই। নাটকের কাঠামোয় গপ্পটা প্রথমবার শুনিয়েছিলেন বাংলা ভাষায় সর্বভারতীয় নাট্যকার প্রবাদপ্রতিম বাদল সরকার। সেটা ১৯৬০-এর দশকে। দেশের স্বাধীনতা তখন সবে ছোকরা। চাদপানে ঘটনার ঘনঘটা, তবে বল্লভপুরের ত্রিসীমানায় তারা নেই। এমন কী বাদলবাবুই ‘বাকি ইতিহাস’ বা এবং ইন্দ্রজিৎ-এর মতো মাইলফলক নাটকের সিলেবাসও পড়ে না ‘বল্লভপুর’, এই ‘রূপকথা’ তিনি যখন লিখছেন, তখনও তাঁর নাট্যজীবনের ‘অ্যাবসার্ড’ পর্ব আসেনি। আজ প্রসেনিয়াম-এর দেওয়াল উড়িয়ে ‘থার্ড থিয়েটার’ পর্ব শুরু হতে তো আজও অনেক দেরি।


‘বল্লভপু‍‌রের রূপকথা’ একটা নিটোল, নির্ভেজাল, আগাপাশতলা উপভোগ্য কমেডি। পুরোটাই নির্মল মজা, সেই সিচুয়েশনাল মজার ভাঁজে ভাঁজে সলমা-জরির কাজের মতো ঝকমকায় বাদল সরকারের মেধাবী উইট। আজ ওই উইট-এর ফাঁক-ফোঁকরে যেন আনমনে আলগোছে ফেলে রাখা রাজা-প্রজা-পাইক-বরকন্দাজ-জমি-পুঁজি-সামন্ততন্ত্র-বৈশ্যতন্ত্রের সূক্ষ্ম রাজনীতি। দর্শক সেটা টের না পেলেও মজার কোনও খামতি হবে না। অনির্বাণের ছবির টেক অব নাটকটার এই অন্তরমহল থেকেই। ছবির টাইটেল সিকোয়েন্স-এ অনির্বাণের নিজের লিরিক-এ ‘জয় বাদল, জয় বাদল জয়’ জয়ধ্বনি দিয়ে মূল নাটককারকে আন্তরিক ‘ট্রিবিউট’ দেওয়াই শুধু নয়— বাদল-ছায়া ছেয়ে থেকেছে গোটা ছবিটাতেই। তবে ওই যে! নাটকের গপ্প, সিনেমার চিত্রনাট্যে চালান হয়ে গেলে সে তো ‘‘আজ এক গপ্প থাকেনি।’’ অবশ্য সিনেমার এই পালটে পাল্টে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অনির্বাণ নাটকের উপাদানগুলিকে পুরোদমে ব্যবহার করেছেন বা বলা যায় ‘বি-সাইক্লিং’ করেছেন, আজ এটা শুরু হয়ে যাচ্ছে একেবারের ধূমপান নিয়ে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ— এক সময় থেকেই ছবিতে বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও সংস্কৃতেও সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। ‘সিগারেটটি খেওনি বাপু, ক্যানসার হয়ে অক্কা পাবে’ গোছের একটি বার্তা, সংস্কৃত শ্লোকে যেন মেঘের আড়াল থেকে, বহুযুগের ওপার হতে ঝমঝম করে একুশ শতকের ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে মূল নাটকটা যাঁরা পড়েননি, বা দেখেননি, কিংবা রেডিওতে শোনেননি, তাঁরাও বিরতির পক্ষে আরেক দফা সতর্কবার্তার সময় অবশ্যই মালুম পেয়ে যান। এই সুললিত সংস্কৃতের সঙ্গে বল্লভপু‍‌রের রূপ-রহস্য কথা আসল যোগসাজশটা ঠিক কোথায়!
আস‍‌‍‌লে এখানে সিনেমার সঙ্গে থিয়েটারের একটা সচেতন ও ক্রিয়েটিভ যোগসাজশে অনির্বাণ কমেডির রাজপ্রাসাটা গড়তে গড়তে গেছেন। কিন্তু সেটা যাতে হোঁচট খেয়ে কমেডি হরর গোছের কোনও জ’র গর্তে পড়ে, ভেঙেচুরে একসা না হয়ে যায়, সে ব্যাপরটাও খুব যত্ন করে খেয়াল রেখেছেন। এই সিনেমার ভূত তাই বলিউডের জমজমাট হরর— কমেডি ‘স্ত্রী’র মতো দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে, চেঁচামেচি করে ভয় দেখায় না। এই ভূত আসলে অতীত ইতিহাস। দেনার দায়ে কান অবধি ডুবে থাকা আজকের যে রাজাবাবুটি, রাজগৌরব আর বংশগরিমা ‍শিকেয় তুলে, ভাঙা প্রাসাদের মস্ত ছাদে, ফতুয়া আর গামছা পরে হাঁ করে ঘুমোন— এই ভূত আসলে তেনারি কাউন্টার পয়েন্ট। কিংখাব-মখমলের জোব্বা-টোব্বা পরে, রেশমি পাগড়ি এঁটে, কপালে তিলক-টিলক কেটে, ছমছম রোমান্টিক গলায় কালিদাস-জয়দেব আউড়ে, তিনি আসলে সামন্ততন্ত্রের জমে থাকা ধ্বংসস্তূপের ‘এথনিক’ মূল্য বাড়ান। আধুনিক পুঁজিতন্ত্র যা দেখে হাততালি দিয়ে ‘স্পেলন্ডিড’ বলে আজ এককথায় চেক কেটে দেয়। এবং রাজবাড়ির এই ভূগর্ভস্ত অতীত আজ দেনাগ্রস্ত বর্তমানের মধ্যিখানে রাজকীয় মহিমায়  যত খুঁদকুড়ো, সব সামলে-টামলে দাঁড়িয়ে থাকে ভুঁইয়া বংশের খাস-খানসামা মনোহর।


বল্লভপুরের রূপকথাটি  সাজানোর  ব্যাপারে  তাই  মানোহরের একটা বড় ভূমিকা থাকে। আসলে গপ্পটাকে তিনটে পরতে সাজিয়েছেন অনির্বাণ। প্রথম পরতটা তো  সোজাসাপটা। বল্লভপুরের ভাঙা রাজবাড়িটা মোটামুটি ভালো দামে বেচে দিতে পারলে ভূপতি রাজার পুরানো দেনা সব শোধ করে কলকাতায় দাঁতের ডাক্তারির চেম্বারটাও হয়ে যাবে। বাড়ি দেখতে আসছেন  স্বপ্নছন্দা সাবান কোম্পানির মালিক বিপি হালদার, সঙ্গে স্ত্রী স্বপ্না আর মেয়ে ছন্দা। ভূপতি চাইছেন তাদের মোগলাই খানা খাইয়ে বাদশাহী চাল দেখিয়ে ‘ইম্প্রেস’ করতে। পুরোটাই একরকমের ‘অ্যাকটো’। ভূপতির তিন পাওনাদারও  সেই নাটকে শামিল হয়ে যান। এমনকি আচমকা এসে-পড়া ডেন্টাল কলেজের বন্ধুকেও বহুরূপীর  কংস-রাবণ-মহিষাসুরের কমন গোঁফ লাগিয়ে ট্যাঁকখালির জমিদার ভূপতির এস্টেট ম্যানেজার বানিয়ে দেওয়া যায়। এই পুরো নাটকটাই ‘পরিচালক’ মনোহর। এমনকি মঞ্চে ভূপতির ‘এন্ট্রি’ কখন কিভাবে হবে, সেটাও তিনিই ঠিক করে দেন। নিরীহ  গোবেচারা পাওনাদাদের, দারোয়ান, বরকন্দাজ-খানসামা সাজার রিহার্সাল পর্বটাতো দুর্দান্ত। এখানে সাহানা বাজপেয়ীর গলায় ‘সাজো-সাজাও’ গানটার ব্যবহার এক ধরনের ব্রেখটিয় অ্যালিয়েনেশনও তৈরি করে। এই অবধি সব ঠিকই ছিল। হালদার অ্যান্ড ফ্যামিলি নাটক দেখে খুশি হয়ে দিব্যি ফিরেও যাচ্ছিল। কিন্তু টাইমিং-এর গোলমালে ভূপতি মনোহরের সেই নির্ভূল  স্ক্রিপ্টও বেমক্কা ঢুকে পড়লো রাজবাড়ির অতীত-কাম-ইতিহাস-কাম-অভিশাপ-কামভূত—শ্রীমান রঘুদা। এই ‘রঘুদা’ কে-কি-কেন-কবে-কোথায়, সেটা আরেকটা গপ্প— মানে দ্বিতীয় পরত। যাঁরা মূল নাটকের কাহিনিটা জানেন না, তাঁরা বরং সিনেমাঘরে গিয়ে এই ব্যাপারটা বুঝে নিন। আমরা সেই ফাঁকে চিত্রনাট্যের তৃতীয় পরতটায় ঢুকে পড়ি।


এই যে পরতটা, এটা কিন্তু ঠিক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার নয়। ‘কিছু কিছু কথা বুঝে নিতে হয়’, এটা সেইরকম। সেটা কিভাবে হচ্ছে?  সেটা এভাবেই হচ্ছে যে, অনির্বাণ এই ছবির সময়টাকে মূল নাটকের রচনাকালের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। মানে ওই  ১৯৬০-এর দশকের প্রথম ভাগটা,  শুধু কস্টিউম ষাটের দশকের বাংলা সিনেমার সুরটা খেয়াল করা যায়। এই ছবির নায়ক-নায়িকা, মানে ভূপতির ভূমিকায় সত্যম ভট্টাচার্য ও ছন্দার ভূমিকায় সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়ও  কোথাও নিজেদের চরিত্র হয়ে ওঠার পাশাপাশিই একটু আলগোছে। বোধহয় উত্তম-সুচিত্রার স্টাইল, সেন্টিমেন্টটাও ছুঁয়ে যান। তবে তার চেয়েও বড় কথা, ওই সময়ের বেশকিছু সিনেমার মতোই এই ছবিটাতেও অনিবার্ণ একঝাঁক শক্তিশালী চরিত্রাভিনেতাকে দিয়ে ভীষণ ভালো কাজ করিয়ে নিয়েছেন।  এঁদের মধ্যে অবশ্যই সবচেয়ে‌ মুগ্ধ করেন মনোহরের ভূমিকায় শ্যামল চক্রবর্তী। অনির্বাণ খুঁজে এনে না দিলে বাংলা সিনেমার দর্শক তো এত শক্তিমান অভিনেতাকে কোনোদিন চিনেই উঠতেন না। শ্যা মলের মতোই এ ছবির  বাকি কস্টিংটাও হয়েছে গ্রুপ থিয়েটার থেকেই। সেদিক থেকে  বল্লভপুর বাংলা থিয়েটারেরও বড় জয়। সৌমিক হালদারের ক্যামেরাকে বাহন করেই বল্লভপুরের রূপকথা থিয়েটারের অন্দর থেকে সিনেমার বারান্দার উঠোনে। আবার সেখান থেকে মঞ্চের  সেট কম্পোজিশনের ভিতর মহলে সাবলীল যাত্রা যাতায়াত করেছে। তবে উত্তরবঙ্গ বলে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার পাহাড়টা না দেখানোই ভালো ছিল। বিধিসম্মত সতর্কীকরণ:  এই ছবির এন্ড-টাইটেল পুরোটা না দেখে বোঝালে খুব বড় ভুল করবেন।
 

Comments :0

Login to leave a comment