JAGCHEY GRAM

কীসের শিবির? কাজ চেয়েই সোচ্চার শকুন্তলারা

রাজ্য জেলা

CPIM LEFT FRONT WEST BENGAL PANCHAYAT ELECTION TMC CORRUPTION

তিনদিন আগে তারাডাঙাতে ‘দুয়ারে সরকার’র শিবির হয়েছিল। শনিবার ভরদুপুরে সেই মদনতোড় পঞ্চায়েতের এক কর্মী জানালেন, ‘কই সেই উদ্দীপনা আর? আগে দু’বারের শিবিরে যেখানে ৫০০ লোক ভিড় করতো এবার তো একশো জনকেও দেখা গেল না!’

এই মদনতোড় গ্রাম পঞ্চায়েতের সাত্তোর হাইস্কুলের মাঠে আগামী ১৯ তারিখ দুয়ারে সরকারের আরেকটি শিবির হবে। তা নিয়ে প্রচারও চলছে। রাজ্য সরকারের ১৮টির বেশি প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া যাবে সেই শিবিরে, স্বাস্থ্যসাথী, লক্ষ্মী ভাণ্ডার তো আছেই!

এই দুয়ারে সরকার নিয়ে গ্রাম বাংলার অভিজ্ঞতা কী? তাহলে এসে দাঁড়াতেই হবে নজরুলের জন্মভিটে চুরুলিয়ার পাশের পঞ্চায়েত মদনতোড়ের সাত্তোর গ্রামে। 

দুপুরে তখন সাত্তোর গ্রামের ওপর দিয়েই যাচ্ছে লাল ঝান্ডার পদযাত্রা। গ্রামের জরাজীর্ণ রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে মহিলারা, কেউ হাত নাড়াচ্ছেন, কেউ বা খালি পায়েই কোলে সন্তান নিয়ে গ্রামের মোড় পর্যন্ত সঙ্গ দিলেন সেই পদযাত্রাকে। মাইকে ভেসে আসছে সেই চেনা স্বর, পঞ্চায়েতে বাস্তুঘুঘুর বাসা ভাঙো, গরিবরের পঞ্চায়েত ফিরিয়ে আনো/রেগায় কাজ দাও, কাটমানি দেব না/আবাস যোজনার ঘর চাই, লুটের পঞ্চায়েত চাই না’। প্রতিটি স্লোগানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গলা মেলাচ্ছেন গত বছরেরও মজুরি না পাওয়া একশো দিনের শ্রমিক, চলতি বছরে একদিনও কাজ না পাওয়া খেতমজুর, গ্রামের বেকার যুবক। 

সেই পদযাত্রাতেই ঘরের বেকার ছেলে ফাগু বাউড়িকে নিয়েই যোগ দিয়েছিলেন শকুন্তলা বাউড়ি। মা-ছেলে হাঁটছেন একইসঙ্গে। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট তৃণমূলী আক্রমণে শহীদ কমরেড হাসমত শেখের গ্রাম মধুডাঙা থেকে সকাল নটায় শুরু হয়ে দুপুর দেড়টা নাগাদ সাত্তোরে এসে পৌঁছালো গ্রামের যন্ত্রণার ভাষা বয়ে নিয়ে চলা পদযাত্রা।

শকুন্তলা বাউড়ি বললেন, ‘‘সকাল নটা থেকে যে কটা গ্রাম ঘুরলো এই মিছিল কোথাও কোনও গ্রামে খোঁজ পেলাম না যে একজনও কোনও স্থায়ী চাকরি করে। সব দিনমজুর। তাও কাজ নেই। গত বছরের রেগার প্রায় ছয় হাজার টাকা এখনও পায়নি। দু’বছর আগে ফাগুর বাবা মারা গেছে, কীভাবে সংসার চলে পঞ্চায়েত জানে?’’ মায়ের পাশে দাঁড়িয়েই তখন ফাগু বাউড়ি বলে উঠলেন, ‘‘দু’বার দুয়ারের সরকারের শিবিরে গেছি, জাতি শংসাপত্র নিয়ে আজও ঘুরিয়ে যাচ্ছে। কীসের শিবির? ছিল ছোট কার্ড, হয়ে যাচ্ছে রেশনের বড় কার্ড। কাজ নেই আমাদের গ্রামে, দুয়ারে সরকার কী কাজ দেবে? ৫০০ টাকার লক্ষ্মী ভাণ্ডার দিলেই সব মিটে যায়?’’

সাত্তোর তফসিলি প্রধান গ্রাম। হাজার খানেক পরিবার। দু’বার দুয়ারে সরকার, তিনবার বাহাদুরপুরে ব্লকে গিয়ে আবেদন জানানোর পরেও ৫০০-র বেশি পরিবার ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘর পায়নি, সিংহভাগ পরিবার জাতিগত শংসাপত্র পায়নি। কাগজের অজুহাতে বারেবারে ফেরানো হচ্ছে। ‘‘ওই তো শুধু লক্ষ্ণীর ভাণ্ডারের ফরম জমা দেওয়া। এবার দেখুন দুয়ারে সরকারে ক’জন যায়। আমাদের গ্রাম থেকে তো একশোজনও জুটবে না শিবিরে’, সোজাসুজি বলে দিলেন সহদেব বাউড়ি। 
রেগার কাজ বন্ধ, গ্রাম জুড়ে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা, আকালের ছবি। সহদেব বাউড়ির মাও এসেছেন মিছিলেন, আদরি বাউড়ি। বলছিলেন, ‘‘আমি লক্ষ্ণীর ভাণ্ডার পাই। কী করবো খাওয়া জোটে না। তাতে ৫০০ টাকাই অনেক। কিন্তু যদি ছেলেটা কাজ পেত, তাহলে লক্ষ্ণীর ভাণ্ডারের টাকা না পেলেও তো চলতো। কাস্ট সার্টিফিকেট না দেওয়ায় তো হাজার টাকাও পাচ্ছি না, ছেলেটার মাসে তো দশদিনও কাজ জোটে না, কীভাবে চারজনের পেট চলে বলুন।’’ 

পদযাত্রা তখন ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়েছে সাত্তোরেই। একটু জল খাওয়ার বিরতি, তারপর আবার হাঁটা। সেই ফাঁকে সাত্তোরের প্রৌঢ়া ঝরনা বাউড়ি, আদরি বাউড়ি হাত ধরে বললেন, ‘‘চলুন গ্রামের ভিতরে, দেখুন ঘর বাড়িগুলির অবস্থা।’’ মাটির রাস্তা ধরে রুক্ষ গ্রামের ভিতরে দুপা হাঁটতেই দেখা মিললো এক বিবর্ণ তল্লাটের ছবি। 

এবারে কোলে নাতিকে নিয়েই ঝরনা বাউড়ি বললেন, ‘‘এই গ্রামের সবাইকে জিজ্ঞাসা করুন, সেই ২২টা টিভি তো আর ফেরত আসলো না!’’
গ্রামের কাজের আকাল, নিদারুণ চেহারার কথা বলতে এসে টিভির প্রসঙ্গ কেন, তাও আবার ২২টা টিভি?

মিছিলে হাঁটা সেই সহদেব বাউড়ি এবার খোলসা করলেন। ‘‘২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের জামুড়িয়ায় সিপিএম জিতলেও রেজাল্টের পরে এই গ্রামে হামলা চালায় তৃণমূলের বাহিনী। ৩৬টা বাড়ি তছনছ করে দেয়, আমাদের বাড়িতেও হামলা হয়েছিল। কিচ্ছু রাখেনি, ভেঙেচুরে সব নিয়ে চলে যায়, ঘরের গোরু টাকা বস্তার ধান সব নিয়ে চলে যায়। ৩৬টি বাড়ি থেকে ২২টি টিভি খুলে নিয়ে চলে যায়। ছয় বছর আগে যে বাড়ি ভেঙেচুরে দিয়েছিল, দেখুন আজও ভাঙাচোরাই পড়ে আছে, কী করে সারাই করবে, খাবারই জোটে না।’’

ছয় বছর আগে যে ২২টি বাড়ি থেকে টিভি নিয়ে গিয়েছিল সেই ২২টা বাড়িতে আজও টিভি ঢোকেনি।  ২২টা টিভি ফেরত আসেনি, গত ছয় বছরে গ্রামের চেহারা তৃণমূলের সেই লুটপাটের ক্ষতকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। রেগাহীন গ্রামে টিভি তাই এখন ‘বিলাসিতা’!

পদযাত্রা এগোচ্ছে আরও, সাত্তোর পেরিয়ে প্রেমবাজার, জামবাঁধ হয়ে তালতোড়। আরেক সন্ত্রাস বিদ্ধ তল্লাট। ২০২১-র ভোটের পরেও একাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাটের কাহিনি।
দুপুর তিনটা নাগাদ যখন তালতোড়ে এসে পৌঁছালো পদযাত্রা, তখন গোটা গ্রাম জুড়ে যেন উচ্ছ্বাসের চেহারা। গত কুড়িদিন ধরে গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে চাল, ডাল সংগ্রহ করেছিলেন চণ্ডী বাউড়িরা। গ্রামের মানুষের সাহায্যে এদিন গ্রামেই বড় উনুনে একসঙ্গে খাওয়া, গরম খিচুড়ি আর তরকারি। চণ্ডী বাউড়ি, সুদাই রুইদাসরা বলছিলেন, ‘‘জানেন এমন গোপনে আমাদের বিরোধী দলের লোকজনও এসে চাঁদা দিয়ে গেছে। বলছে তোরা কাজের দাবিতে, রেগা চালুর দাবিতে মিছিল করছিস, নে কটা টাকা।’’

এই জামুড়িয়ায় এবার চাষ প্রায় হয়নি বললেই চলে। সঙ্গিন অবস্থা খেতমজুরদের। সাত্তোর থেকে তালতোড়, একজন খেতমজুর এবার একদিনও মাঠে কাজ পাননি। বদ্রী রুইদাস বলছিলেন, খেতে কাজ নেই, দিনমজুরির কাজেও টান। এই বয়সে গ্রামের বাইরে যাওয়ার শক্তিও নেই।

পদযাত্রায় পা মেলানো শ্রমিক নেতা মনোজ দত্ত বলছিলেন, ‘‘জামুড়িয়ায় ১৪টি স্টিল, ৪টি রিফ্র্যাক্টরি সহ একাধিক কারখানা। তারপরেও এই হাল। গত এগারো বছরে একটা কারখানাও হয়নি,  রেশমী সিমেন্টের মতো কোম্পানি স্রেফ তোলাবাজির জন্য হিজলগড়ে কারখানা না করেই চলে গেল কয়েক মাস আগে। বামফ্রন্টের আমলে অদক্ষ কাজে স্থানীয়দের নিয়োগের জন্য মালিকপক্ষকে বাধ্য করা হতো, এখন সব বাইরের লোক। এদিকে গ্রামে তৃণমূলের চুরি, তোলাবাজি। পঞ্চায়েত দুর্নীতির আঁখড়া। কোথায় যাবে মানুষ?’’

তালতোড়েই দুপুরে খাওয়ার সময়তেই এক ফাঁকে তখন সুরেশ বাউড়ি জনা কুড়ি যুবককে নিয়ে এসে শুধু বলে গেলেন, ‘‘দাদা আমরা তৃণমূলের অত্যাচারে বিজেপিতে গেছিলাম। ঐ দলটাও তো প্রায় একই। ভুল হয়েছে, তাই এই পদযাত্রায় হাঁটছি সবাই মিলে।’’

জীবন-যন্ত্রণার সঙ্গেও উপলব্ধি বদলে যায়, সাক্ষী গ্রামীণ পদযাত্রা।
 

Comments :0

Login to leave a comment