অধিকাংশ গ্রাম পুরুষ শূন্য। প্রিয়জনের দেহ আগলে ‘আরাবুল-সওকত’দের ফাঁসির দাবিতে বিলাপ করছে বিস্তীর্ণ জনপদ।
জনপদের নাম ভাঙড়। তৃণমূলের একচেটিয়া মাফিয়া রাজের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর নাম ভাঙড়। হতদরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের স্পর্ধার নাম ভাঙড়।
বুধবার রাত থেকে ভাঙড়ে নতুন করে শুরু হওয়া সন্ত্রাসের বলি ৩টি তরতাজা প্রাণ। ভোগালি-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের কাটাডাঙা’র হাসান মোল্লা(৩০), চিনাপুকুরের রাজু মোল্লা (২৫) এবং কারবালার রেজাউল গাজি(২২)- এই হল তিন প্রাণের পরিচয়।
এলাকার সাধারণ মানুষ জানাচ্ছেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে আটটা নাগাদ যাবতীয় গন্ডগোলের সূত্রপাত। ঘটনাস্থল ভাঙড়-২ নম্বর ব্লক। সকালে প্রহসনের পরেও এই ব্লকে নির্বাচন হওয়া গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের ৮৫ শতাংশে জয়ী হয়েছেন বাম-আইএসএফ প্রার্থীরা। প্রশাসনিক নিয়মের ফাঁক গলে ভাঙড়-২ ব্লককে পঞ্চায়েত স্তরে বিরোধীশূন্য করলেও জেলা পরিষদ স্তরে ভোট দিয়েছেন ভাঙড়ের মানুষ। বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বইছে কার্যত তৃণমূল বিরোধী ঝড়। সেই ঝড় ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হলে কি হতে পারে, সেটা অনুমানের জন্য ভোট বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে আটটা নাগাদ তৃণমূলও টের পায় সেই ঝড়ের পরিণাম। ভাঙড়-২ ব্লকের ১টি জেলা পরিষদ আসনে ৪ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হন আইএসএফ প্রার্থী জাহানারা বিবি। কিন্তু তাঁর হাতে জয়ের শংসাপত্র তুলে দিতে অস্বীকার করে প্রশাসন। স্থানীয় থানা ক্রমাগত চেষ্টা চালায় জাহানারা বিবিকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে, ‘‘আমি ভোটে হেরে গিয়েছি।’’
রাত ১১টা অবধি জাহানারা বিবি অস্বীকার করেন মিথ্যা মুচলেকা দিয়ে গণনাকেন্দ্র থেকে পালিয়ে যেতে।
সাড়ে আটটার সময় গণনাকেন্দ্রের লাউড স্পিকারে ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছে জাহানারা খান জয়ী হয়েছেন। কিন্তু তারপরেও তিনি বেরোচ্ছেন না কেন? ক্রমেই গণনা কেন্দ্রের সামনে ভিড় জমাতে শুরু করেন আইএসএফ কর্মী-সমর্থকরা। রাতের গভীরতার সঙ্গে সেই ভিড়ের পরিমাণ সমানুপাতিক।
ভাঙড় অশান্তিতে নিহত হাসান মোল্লার পরিজনরা
এলাকাবাসীর অভিযোগ, গণনাকেন্দ্রের ভিতরে উপস্থিত ছিলেন ভাঙড়ের অশান্তির মূল পান্ডা আরাবুল ইসলাম। ভিড় বাড়তে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি। ব্লক প্রশাসনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পরেই একাধিক নম্বরে ফোন করেন আরাবুল। তারপরেই শুরু হয়ে যায় ‘অ্যাকশান’। নইলে নেতাকে অক্ষত অবস্থায় বের করে আনা সম্ভব নয় যে!
নিহতদের পরিবারের দাবি, ক্যানিং থেকে আসা তৃণমূলের বাহিনী র্যাফের পোশাক পরে গুলি চালিয়েছে।
প্রশাসনের দাবি, ‘দুষ্কতীদের’ ছোড়া গুলিতে আহত হয়েছেন বারুইপুর পুলিশ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক অফিসার এবং তাঁর দেহরক্ষী। নিহতদের পরিবারের মানুষ ক্ষোভের সঙ্গে জানাচ্ছেন, ‘‘দুষ্কৃতী আবার কী? সবটাই তৃণমূল। পুলিশ চেনে কারা গুলি চালিয়েছে। পুলিশই তো ওদের বাঁচিয়েছে।’’
মঙ্গলবার রাতের ঘটনার পর থেকেই পুরুষশূন্য ভাঙড়। জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা। যদিও এলাকার তৃণমূলের ‘ডাকাবুকো’ নেতারাও এলাকা ছেড়েছেন। আক্ষরিক অর্থেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে জনরোষ সৃষ্টি হয়েছে ভাঙড়ে। সেই জনরোষ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সাংগঠনিক কিংবা নৈতিক শক্তি-কোনোটাই নেই তৃণমূলের।
কিন্তু তৃণমূলের ভাঙা কোমড় মেরামতের দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। দুষ্কৃতী দমনের নামে কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং পাঞ্জাব পুলিশের জওয়ানদের চিনিয়ে দেওয়া হচ্ছে পরিচিত আইএসএফ এবং সিপিআই(এম) কর্মী সমর্থকদের বাড়ি। চলছে যথেচ্ছ ভাঙচুর এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার রাতের অশান্তি শুরুর পর থেকে জাহানারা বিবিরও আর খোঁজ মেলেনি।
তৃণমূলের এই দখলদারির মাশুল গুনতে হচ্ছে হতদরিদ্র ৩টি পরিবারকে। চিনাপুকুরের রাজুর পরিবারের লোক জানাচ্ছে মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন ছিল তাঁদের ঘরের ছেলে। এলাকার মানুষও পছন্দ করতেন ২৫ বছরের এই যুবককে। তাঁর দেহে মাটি দিতে হবে ভেবেই ক্ষোভে ফেটে পড়ছে চিনাপুকুর।
রেজাউল গাজী আর হাসান মোল্লা- দু’জনেই ব্যাগ তৈরির কারিগর ছিলেন। হাসানের ২ শিশু সন্তান। বাড়িতে গর্ভবতী স্ত্রী। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্যকে হারিয়ে ভাষা হারিয়েছে তাঁর পরিবার। শোকে বিহ্বল হাসানের স্ত্রীর একটাই কথা-‘‘আরাবুলের ফাঁসি চাই।’’
একইরকম প্রায় অবস্থা রেজাউলের পরিজনদেরও। বড়জোর একমানুষ সমান পাঁজরা বের করা ইঁটের বাড়ি। সেই বাড়ির মাথায় টালি, ত্রিপল এবং অ্যাজবেস্টোসের আচ্ছাদন। দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। বুধবার বিকেলে সেই বাড়ির দরজায় রেজাউলের ছবি আঁকড়ে দাড়িয়ে তাঁর ভাগ্নে এবং ভাগ্নি।
রেজাউলের দেড় বছরের মেয়ে কী কোনওদিন জানতে পারবে, বাবা মানে কী?
Comments :0