Uttarkanya abhijan

যুবসমাজের যন্ত্রণা তুলে ধরবে উত্তরকন্যা অভিযান

সম্পাদকীয় বিভাগ

ধ্রুবজ্যোতি সাহা
 

১৩ এপ্রিল ডিওয়াইএফআই’র ডাকে উত্তরকন্যা অভিযান। হাজার হাজার যুবক-যুবতী শামিল হবেন এই অভিযানে। 
আমাদের রাজ্যের মাটিতে প্রতিদিন বেকার বাড়ছে। প্রতিদিন পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। পাহাড় থেকে সাগর কাজ না পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে প্রতিদিন বাইরের রাজ্যে কাজ করতে চলে যেতে হচ্ছে বাংলার যৌবনকে। আজ বাংলার যৌবনের হাতে বাটি মালুই ধরিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকার। নেই কৃষিক্ষেত্রে কোনও রকম উপার্জন, নেই কোনও শিল্প কলকারখানা, নেই কোনও স্থায়ী চাকরি। পড়ে রয়েছে শুধু শূন্য পদ। কারণ বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন- ‘‘এসএসসি টেট পরীক্ষা কি দুর্গাপূজা নাকি কালীপুজো যে  প্রতি বছর করতে হবে?’’
রাজ্যে নতুন কলকারখানা তো হচ্ছেই না, চালু শিল্পও ক্রমশ ধ্বংসের পথে। যে শিল্পগুলি বেঁচে আছে সেখানে কোনও স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ করা হচ্ছে না, ঠিকা শ্রমিকদেরকে দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের চিত্র যেমন। একদিকে চা বাগান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, চা বাগানে স্থায়ী শ্রমিক ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে, অস্থায়ী শ্রমিকদেরকে কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
মায়েদের বাচ্চাদেরকে জেলখানার মতন একটা নেটের ঘরে ভরে দিয়ে দুটো ভাতের জন্য চা বাগানে কাজে যেতে হচ্ছে। দিনের শেষে অল্প কিছু পারিশ্রমিক নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয় এইসব শ্রমিকদের। এই চা বাগান শ্রমিকদের  ছেলে মেয়েদের না হচ্ছে পড়াশোনা, না পাচ্ছে দুবেলা দু’মুঠো পেট ভরে খেতে। এখন এমনকি সেইটুকু কাজও না জোটায় চা বাগান এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ যাচ্ছেন পরিযায়ী শ্রমিক হতে। 
চা বাগানের স্থায়ী শ্রমিকদের সাথে এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী কোনো স্থায়ী শ্রমিক অবসর গ্রহণ করলে তার সন্তানদের কোনো একজনকে শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু আজ‌ও চা শ্রমিকদের সন্তানদের যোগ্যতা থাকলেও ম্যানেজমেন্ট স্টাফের চাকরি দেওয়া হয় না। এদিকে উত্তরবঙ্গের এই চা বাগানগুলিতে ম্যানেজারিয়াল স্টাফের প্রচুর পদ খালি, যুবসমাজের দাবি, এই শূন্যপদে অবিলম্বে স্বচ্ছভাবে নিয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ভাবে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ী ও টি- এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘বিঘা শ্রমিক’ (চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক) নিয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে বিঘা শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। বনসহায়ক পদে স্বচ্ছতার সাথে নিয়োগ করতে হবে এবং বনবস্তিবাসীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

চা বাগানের শ্রমিক বস্তিগুলি জন্মলগ্ন থেকেই সরকারি খাস জমিতে অবস্থান করে। একদিকে ‘চা সুন্দরী’ প্রকল্পের নামে এই বস্তিগুলি উচ্ছেদের চক্রান্ত চলছে, অপরদিকে সরকারি জমি বিক্রি করার বিল বিধানসভায় পাশ করিয়ে সরকার এই চা শ্রমিক বস্তির জমিগুলি টি-টুরিজমের নামে তুলে দিতে চাইছে কর্পোরেট মালিকদের হাতে। এইরকমভাবে কর্পোরেট স্বার্থে উচ্ছেদের পরিকল্পনা চলছে বনবস্তিগুলিতেও। তাই চা বাগানের শ্রমিক বস্তি ও বনবস্তিতে বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারকে অবিলম্বে জমির পাট্টা দেওয়া দরকার, সেই সাথে সরকারি জমি বিক্রি হলে বিভিন্ন এলাকায় পাট্টা বা লিজ হোল্ডাররাও ভিটে ছাড়া হবেন। তাই যুবসমাজের দাবি, সরকারি জমি বিক্রির এই বিল প্রত্যাহার করতে হবে।  
উত্তরবঙ্গে পর্যটন শিল্পের উন্নতির পাশাপাশি চা বাগানের অনুসারী শিল্প ( যেমন মেশিন বেল্ট, ছাতা, ছোট যন্ত্রাংশ বা চা-পাতা থেকে প্রাপ্ত ট্যানিন বা ট্যানিন থেকে প্রস্তুত শ্যাম্পু/কসমেটিক কারখানা) স্থাপন করা খুব প্রয়োজন। সুযোগও রয়েছে। কিন্তু সরকারের কোনো তৎপরতা নেই। 

সরকারি প্রকল্পগুলিতে সীমাহীন দুর্নীতি। উত্তর বা দক্ষিণ রাজ্যের সর্বত্রই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ১০০ দিনের কাজ। শিল্পের জমি লুট হয়ে যাচ্ছে। লুট হয়ে যাচ্ছে পাথর, কয়লা, নদীর বালি। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে নদী থেকে শ্রমিকদের মাধ্যমে বালি তোলা হত। আজ নদীতে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে জেসিবি মেশিন- কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিকেরা। জেসিবি মেশিন দ্বারা বালি তোলার ফলে গতিপথ হারাচ্ছে নদী। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পরিবেশ। আবার কখনো কখনো সরকারি নিয়মে বালি তোলা বন্ধ করে দিয়ে চোরা পথে বালি চালানো হচ্ছে এবং বালি মাফিয়ারা রাতারাতি কোটিপতিতে পরিণত হচ্ছে। কাজ হারাচ্ছে ট্রাক্টরের ড্রাইভার সহ শ্রমিকরা। বেকারত্বের জ্বালা নিয়ে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে একশ্রেণির যুবকেরা। এই শ্রেণির যুবকরা কি নিজেরাই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে নাকি আসক্ত করা হচ্ছে? বালি, পাথর, কয়লা খাদান এলাকার এবং চা বাগান এলাকার যুব বয়সি শ্রমিকদেরকে নেশার জালে আটকে ফেলা হচ্ছে।
কৃষক ফসলের লাভজনক দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করছেন। আত্মহত্যা করছে আলু চাষিরা। বামফ্রন্ট সরকার আমলে সার সহ কীটনাশকের দাম অনেক কম ছিল, এখন শুধু সারের দাম বৃদ্ধিই হয়নি, তৃণমূল সরকারের আমলে সারে কালোবাজারি শুরু হয়েছে। সারে কালোবাজারি, কৃত্রিম উপায়ে সারের সঙ্কট দেখানো হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে সারের বস্তার গায়ে যে প্রিন্ট লেখা আছে তার থেকে দ্বিগুণেরও বেশি দামে বাজারে সার বিক্রি হচ্ছে। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে যে ইউরিয়ার বাজারদর ছিল ৬ টাকা প্রতি কেজি সেই ইউরিয়ার বাজারদর এখন ১০ টাকা  প্রতি কেজি। যে ডিএপির বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বাজার দর ছিল ১০ টাকা কেজি, তা এখন ২৭ টাকা প্রতি কেজি। আবার  কালোবাজারিতে দাম ৫০ টাকা প্রতি কেজি। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে যে পটাশের বাজার দর ছিল তিন টাকা কেজি সেই পটাশের বাজার দর এখন  ২১ টাকা প্রতি কেজি। কিন্তু কালোবাজারিতে কৃষকদেরকে ৪৪ টাকা দামে কিনতে হচ্ছে। কৃষকের সবজি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষকের সবজি রাখার জন্য নেই কোনও বহুমুখী হিমঘর। কৃষকের সবজি যে প্রকার হিমঘরে থাকছে সেই হিমঘরের ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অথচ পুঁজিপতিরা বাজার থেকে ফসল ক্রয় করার পরে উন্নত মানের হিমঘরে ফসল সংরক্ষণ করে রাখছেন। কৃষকের আলুর বীজ হিমঘরে নষ্ট হচ্ছে কিন্তু পুঁজিপতিদের বীজ নষ্ট হচ্ছে না। হিমঘরে ফসল নষ্ট হওয়ার মূল কারণ হল নিম্নমানের ভেজাল গ্যাস সরবরাহ। অথচ পুঁজিপতিদের হিমঘরে খুব ভালো গ্যাস পাঠানো হচ্ছে। আবার অন্যদিকে তৃণমূল সরকারের আমলে প্রতিবেশি রাজ্যে আলু পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হল। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির আলু বিক্রি হচ্ছে না। দক্ষিণবঙ্গেও মাঠে আলুর অভাবী বিক্রি হয়েছে। সরকারের কী ভূমিকা? কৃষি ক্ষেত্রে কোনও রকম উপার্জন হচ্ছে না। কৃষকেরা তাই প্রতিদিন কৃষি কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বাংলার যৌবন, কাজ না পেয়ে চলে যাচ্ছে রাজ্যের বাইরে,মা বাবা ঘর-সংসার সব ছেড়ে।

দেশে নয়া উদারবাদী  অর্থনীতির প্রয়োগ চলছে আরো বেআব্রু ভাবে। স্বাধীনতার পর এতো বেকারি দেশ কখনও দেখেনি। বিগত ৫০ বছরে দেশে বেকারত্ব সর্বোচ্চ ৯.৯৮%। আমাদের দেশের বেকার যুবদের জীবনে পরিবর্তন আসেনি। নেমে এসেছে চরম হতাশার অন্ধকার। সিএমআইই রিপোর্ট অনুযায়ী মোদী সরকারের প্রথম ৫ বছরে  ৪ কোটি ৭০ লক্ষ  মানুষ নতুন করে বেকার হয়েছেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে ৬ লক্ষ ৮৩ হাজার ৮৩২ শূন্যপদ। ভারতীয় রেলে শূন্যপদ অবলুপ্ত করা হচ্ছে। নয়া উদারবাদের পথে দেশ চালাতে গিয়ে দেশের প্রতিরক্ষা, উৎপাদন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক-বিমা, রেল, সরকারি পরিবহণ, তেল, ইস্পাত, কয়লা সহ রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলিকে পাইকারি হারে বেসরকারিকরণের ফলে বাড়ছে ছাঁটাই, বাড়ছে বেকারি, বাড়ছে দারিদ্র। আমাদের রাজ্যে চলছে চরম অগণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক নয়াউদারবাদের চরম তাঁবেদার ও বেপরোয়া লুটেরাদের সরকার। প্রতিদিন এরা প্রতারিত করছে যুবদের। চাকরি বিক্রি করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকায়। শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, পৌরসভার চাকরি শাসক দলের নেতারা বিক্রি করেছেন, তা আজ প্রকাশ্যেই চলে এসেছে। 
                তাই আজকের এই দুই সরকারের বেকার যুবদের প্রতারিত করা নীতির বিরুদ্ধে  আর  একইসঙ্গে জাতের নামে, ধর্মের নামে- বিভাজন করে ভাতের লড়াই, কাজের লড়াইকে ভেঙে ফেলার চক্রান্তের বিরুদ্ধে তুলতে হবে– ‘‘ধর্মীয় বিভেদ- বিদ্বেষ  নয়- চাই সব হাতে কাজ, সব পেটে ভাত’’। গোটা  দেশের যু্বদের কর্ম সংস্থানের দাবির সাথেই পশ্চিমবঙ্গের প্রতিদিন কাজ হারানো বেকারের সংগ্রামের লড়াই আজ একই সারিতে সহাবস্থান করে। আর পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশের বেকারের কাজের দাবির লড়াইয়ের সাথে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশের বেকারের কাজের দাবি অভিন্ন। আরএসএস, বিজেপি, তৃণমূল একযোগে এই কাজের অধিকার পাওয়ার অভিন্ন লড়াইকে জাতিসত্তার নামে, জনগোষ্ঠীর নামে ভাগ করতে চায়। তাই ডুয়ার্সের- তরাইয়ের চা বাগানের যুবদের কাজের লড়াই, চা শ্রমিকদের দিনে ৩৫০ টাকার ন্যূনতম মজুরির লড়াইকে, শ্রমিকের ভালো করে বেঁচে থাকার জন্য ন্যায্য মজুরির লড়াইয়ের পথ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, একই সাথে রাজ্য ভাগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াইকে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ের বার্তা দেবে ১৩ এপ্রিল উত্তরকন্যা অভিযান।

কেন্দ্রে ও রাজ্যের তৃণমূল সরকার নির্বাচনের আগে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এইমস হসপিটাল কোথায় গেল? কোথায় গেল বাগডোগরা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট? বালুরঘাট কোচবিহার পুরুলিয়ার এয়ারপোর্ট কোথায় গেল? জেলায় জেলায় মেডিক্যাল কলেজের প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল?
নতুন শিল্প হয়নি। যেমন শালবনিতে জিন্দালদের ইস্পাত কারখানা, ঠিক তেমনি জলপাইগুড়ির ঘুঘুডাঙাতে কারখানা হয়নি। হয়নি চকচকার জুট পার্ক।বরং বহু চালু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিদিন গঙ্গা পদ্মা ভাঙনে তলিয়ে যাচ্ছে বহু মানুষের ঘরবাড়ি, স্কুল, কলেজ। বন্য নিয়ন্ত্রণের জন্য উত্তরবঙ্গ মাস্টার প্ল্যান কোথায় গেল? উত্তরবঙ্গের এসএসসি জোনে কাজ হচ্ছে না কেন? উত্তরের জেলায় প্রেসিডেন্সি কলেজ কোথায় গেল?
এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর চাইতে ‘‘উত্তরকন্য অভিযান’’।
এই অভিযান বেকারের কাজ সুনিশ্চিত করার অভিযান। এই অভিযান গরিব খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মাথা উঁচু করে বাঁচার অভিযান। এই অভিযান কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম পাওয়ার  অভিযান, এই অভিযান ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার পাওয়ার অভিযান, এই অভিযান শ্রমিকের ঘামের ন্যায্য মজুরির অভিযান, এই অভিযান বিকল্পের পথ দেখানোরও অভিযান। ডিওয়াইএফআই’র মূল দাবি: ১) শূন্য পদে স্থায়ী নিয়োগ কর । ২) স্থায়ী নতুন পদ তৈরি করো। ৩) দুর্নীতি ও বিভাজনের রাজনীতি বন্ধ কর।
এক নতুন অধ্যায় লেখা হবে এই উত্তরকন্যায়।
 

Comments :0

Login to leave a comment