অনিন্দ্য হাজরা
নির্বাচনী বন্ডের তথ্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে প্রকাশ্যে এসেছে। দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন সংস্থার থেকে কার্যত ঘুষ খেয়ে তাঁদের প্রকল্পের টেন্ডার কিংবা অন্যান্য সুবিধা দিয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
জনতার দিক থেকে দেখলে, সবথেকে বড় চমক হল, বিভিন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার তরফে নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থার মাধ্যমে বিজেপিকে মোটা অঙ্কের অনুদান দেওয়া। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা হল, গত কয়েক বছরে লাগামছাড়া হারে বৃদ্ধি পেয়েছে জীবনদায়ী সহ সমস্ত ওষুধের দাম। আমজনতার প্রশ্ন, তবে কি দাম বৃদ্ধির সঙ্গে দলীয় তহবিলে চাঁদা দেওয়ার কোনও সংযোগ রয়েছে?
তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনী বন্ড ব্যবহার করে নিজেদের মুনাফার মার্জিন সুনিশ্চিত করেছে দেশের বৃহৎ ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি। প্রথম সারিতে থাকা ৩৫টি ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি ৭৯৯.৬৬ কোটি টাকা মূল্যের নির্বাচনী বন্ড কিনেছে এবং জমা দিয়েছে।
মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের সংগঠন ওয়েস্টবেঙ্গল মেডিক্যাল সেলস্ রিপ্রেজেন্টেটিভ ইউনিয়ন বা ডব্লিউবিএমএসআরইউ বলছে, ওষুধের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ওষুধের উপর ১২ থেকে ১৮ শতাংশ হারে জিএসটি চাপানো। একইসঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় গড়ে ওঠা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ওষুধ সংস্থা আইডিপিএল, কিংবা হিন্দুস্থান অ্যান্টিবায়োটিক, বেঙ্গল কেমিক্যালের মত সংস্থাকে রুগ্ন করেছে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম ওষুধ প্রস্তুতকারী দেশ হলেও কাঁচামালের ৬০ শতাংশ বিদেশ থেকে রপ্তানি করা হয়। সেই অনিশ্চয়তার ফলেও বাড়ছে ওষুধের দাম।
ওষুধ ব্যবসার সঙ্গে যুক্তরা জানাচ্ছেন, গত ৫ বছরে নজিরবিহীন ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে দেশে ওষুধের দাম। মানুষের সাধ্যের বাইরে চিকিৎসার খরচ। গ্যাস অম্বলের ওষুধ প্যান ফরটির দাম ৭.৫০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১৪ টাকা, রক্তচাপ হার্টের জন্যও ব্যবহার হয় টেসলা। তার দাম ৭ টাকা থেকে ১০ টাকা। অম্বলের ওষুধ ওমেজের দাম ৪ টাকা থেকে ৬.৪০।
দামবৃদ্ধির কারণ জানতে গেলে একটু ইতহাসে নজর রাখা প্রয়োজন। ১৯৭০ সালে ভারত সরকার ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য চালু করে ড্রাগ প্রাইস কন্ট্রোল অর্ডার অ্যাক্ট, বা ডিপিসিও। সেই আইন অনুযায়ী, সকল ওষুধকে ২টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়- ফর্মুলেশন ওষুধ ও বাল্ক ওষুধ। এবং ওষুধের উৎপাদন খরচ ও অন্যান্য খরচের ভিত্তিতে বিক্রয়মূল্যের উপর সর্বোচ্চ মুনাফার হার নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এই আইনের ফলে ওষুধের দাম অনেকটাই কমে, এবং সাধারণ মানুষের সুরাহা হয়।
যদিও পরবর্তীকালে এই আইনের সংশোধন হয়, এবং তালিকা থেকে ক্রমেই ওষুধের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়। ২০০২ সালে প্রথম এনডিএ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, এই তালিকায় মাত্র ৩৫টি ওষুধকে রাখা হবে। বাকি ওষুধের দাম সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে না। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা হয়, এবং আদালত নির্দেশ দেয়, ওই নীতি বাতিল করতে হবে, এবং সমস্ত প্রয়োজনীয় ও জীবনদায়ী ওষুধকে মূল্য নিয়ন্ত্রণ বিধির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সেই নির্দেশ অনুযায়ী, ২০১১ সালে জাতীয় অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা তৈরি হয়, এবং ২০১২ সালে তার ভিত্তিতে নতুন মূল্য নিয়ন্ত্রণ বিধি প্রস্তুত করা হয়, যা ২০১৩ সাল থেকে কার্যকর হয়।
কিন্তু এই আইনে একটা বড়সড় ফাঁক ছিল। ওষুধ তৈরিতে কাঁচামাল সংগ্রহ ও অন্যান্য খরচের ভিত্তিতে ওষুধের দাম নির্দিষ্ট করার বদলে বাজার চলতি ওষুধের গড় মূল্যকে ঊর্ধ্বসীমা ধরা হয়। ধরা যাক, একটি ওষুধ তৈরির খরচ ১০ টাকা। কোনও সংস্থা সেটিকে ১০০ টাকায় বিক্রি করছে। ২০১৩ সালের আইনে বলা হল, ১০০ টাকার বেশি দামে ওই ওষুধ বিক্রি করা যাবে না। একইসঙ্গে কাঁচামালকে তালিকার বাইরে রাখা হয়।
এর পাশাপাশি জাতীয় অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা তৈরির সময়ে অধিকাংশ ওষুধকে সামগ্রিক ভাবে তালিকাভুক্ত করার বদলে। ওষুধের নির্দিষ্ট পরিমাণকে তালিকাভুক্ত করা হয়। সাধারণ জ্বরের ট্যাবলেট প্যারাসিটামল ৫০০ এমজি এই তালিকায় থাকলেও, প্যারাসিটামলের ৬৫০ এমজি কিংবা ১০০০ এমজি’কে তালিকার বাইরে রাখা হয়। মানে প্যারাসিটামল ৫০০ এমজি’র দাম না বাড়লেও ৬৫০ এমজি কিংবা ১০০০ এমজি’র দাম বাড়ানোয় কোনও আইনি সমস্যা নেই। এই সুযোগে ওষুধ কোম্পানিগুলি বাজারে ৫০০ এমজি’র জোগান কমিয়ে বাকিগুলির যোগান বাড়িয়েছে।
একইসঙ্গে ২০১৩ সালের আইনে বলা হয়েছিল, প্রত্যেক বছর অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের দাম ৫ শতাংশ হারে বাড়ানো যাবে। বাকিগুলো ১০ শতাংশ হারে বাড়বে।
এই আইনের ছাড় ব্যবহার করে ওষুধ কোম্পানিগুলির মুনাফা আকাশ ছুঁতে শুরু করে ২০১৮-১৯ সাল থেকে। সেই সময় থেকেই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপির তহবিলে ওষুধ কোম্পানিগুলির চাঁদা ঢুকতে শুরু করে। এবং আর্থিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে কোভিডের সময়ে কাঁচামালের দাম বেড়েছে, যোগানে টান পড়ছে বলে ওষুধ কোম্পানিগুলিকে আরও ১০ শতাংশ হারে দাম বাড়ানোর সুযোগ দেয় মোদী সরকার। কোভিডের পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও সেই দাম কমেনি। ২০২৩ সালে ওষুধের দাম আরও ১০ শতাংশ বাড়ানোর ছাড়পত্রও মিলেছে কেন্দ্রের তরফে।
একইসঙ্গে ২০২৩ সালে ১০ শতাংশ দাম বাড়ানো ছাড়াও পাইকারি মূল্য সূচকের সঙ্গে ওষুধের দামকে ট্যাগ করার নির্দেশও দেয় কেন্দ্র। অস্বাভাবিক হারে ওষুধের দাম বেড়েছে। এবং সেই দামের ঠেলায় চোখে সর্ষেফুল দেখছেন সাধারণ মানুষ।
Comments :0