EDITORIAL

দায় প্রধানমন্ত্রীরও

জাতীয় সম্পাদকীয় বিভাগ

odisha rail accident editorial coromondal express bengali news

বিগত কয়েক দশকের মধ্যে ভয়াবহতম রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তিন শতাধিক যাত্রী। আহতের সংখ্যা সহস্রাধিক। অবশ্য যে মাত্রায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, দু’টি যাত্রীবাহী ট্রেনের বিশেষ করে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের বেশিরভাগ বগি যেভাবে দুমড়ে মুচড়ে চিঁড়ে চ্যাপটা হয়ে গেছে এবং প্রায় সব বগিই লাইন  থেকে  ছিটকে গেছে তাতে একজন যাত্রীরও পক্ষেও শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ থাকার কথা নয়। 

এহেন মৃত্যুর মিছিল, স্বজন হারানোর হাহাকারে গোটা দেশ যখন শোকে-আতঙ্কে স্তব্ধ তখন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ঘটনাস্থলে না এসে উপায় ছিল না। দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের যাত্রীদের অধিকাংশই যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের তাই যেতে বাধ্য হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন দুর্ঘটনার জন্য যারা দায়ী তারা কেউ ছাড় পাবেন না। কড়া সাজার ব্যবস্থা হবে। 

মোদী নতুন কিছু বলেননি। অতীতেও বিভিন্ন দুর্ঘটনায় সরকারের তরফ থেকে এমন  আশ্বাসবাণী শোনানো হয়েছে। তদন্তের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে বলির পাঁঠা হয়েছে নিচু তলার কর্মীরা। এক্ষেত্রে তেমন কিছু একটা হবারই সম্ভাবনা।


যখনই কোনও বড়সড় দুর্ঘটনায় অনেক লোকের মৃত্যু হয় এবং প্রবল সমালোচনা ও বিতর্কের ঝড় ওঠে তখন প্রধানত নজর পড়ে চালক, সিগনাল বা সিগনাল অপারেটরের দিকে। কিন্তু আঙুল তোলা হয় না গোটা রেল ব্যবস্থার  পরিচালক ও সরকারের নীতি নির্ধারকদের দিকে। হিউম্যান এরর হতেই পারে। এর থেকে ১০০ শতাংশ  মুক্ত হবার সুযোগ নেই। তবে হিউম্যান এরর’কে  শূন্যের কাছাকাছি আনতে হলে দরকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবস্থার। 

আগে সিগনালিং ছিল মনুষ্য চালিত। এখন স্বয়ংক্রিয়। এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চিরস্থায়ী নয়। নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরবর্তী ধাপের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবস্থার করতে হয়‌।  তেমনি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাটাও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। তাছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রেল পরিষেবার উন্নতির  জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে তার খবর রাখতে হয়  এবং সেগুলি  এদেশেও ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হয়। 

যেমন, এখন মুখে মুখে আলোচিত  অ্যান্টি  কলিশন ডিভাইসের কথা। এটা এমন এক প্রযুক্তি এক লাইনে দু’টো ট্রেন কাছাকাছি এসে গেলে আপনা থেকে থামিয়ে দেবে। এমন হাজারো প্রযুক্তি আছে বিভিন্ন দেশে তা সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহারও হচ্ছে। দেড় শতক আগে এই প্রযুক্তি  ব্যবহার করে দুর্ঘটনা এড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

মোদী সরকার ক্ষমতায় এসে ঢাকঢোল পিটিয়ে এর নাম দিয়েছে সুরক্ষা কবচ। কিন্তু ঐ পর্যন্তই কবচের আওতায় রেললাইন ও ট্রেনকে আনার কোনও কার্যকর পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। আসলে যাত্রী নিরাপত্তার বিষয়টি যদি সর্বাগ্রে থাকত তাহ‍‌লে এতদিনে এই নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রযু‍‌ক্তির আওতায়  পুরো রেল চলে আসত। 

রেল কর্তারা সাফাই গাইছেন অর্থের অভাবে নাকি সুরক্ষার কাজে অগ্রাধিকার দেওয়া যাচ্ছে। তাহলে অগ্রাধিকার কোথাও প্রধানমন্ত্রীর প্রচারে। নাকি রেলকে বাণিজ্য সংস্থায় পরিণত করায়।


টাকার অভাব এটা সত্য নয়। টাকা কোথায় খরচ হবে সমস্যা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে। বয়স্ক নাগরিকদের  ছাড় বাতিল করে, খাবার ও অন্যান্য পরিষেবার  দাম বাড়িয়ে,  প্ল্যাটফর্ম টিকিট দ্বিগুণ করে, সাধারণ ট্রেনকে এক্সপ্রেস ঘোষণা করে, বিপুল অর্থ কামিয়েছে রেল।

সেই টাকা  ঢেলে খরচ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বন্দে ভারতের পেছনে। আগামী লোকসভা  ভোটের আগে সবরাজ্যে সব প্রধান শহরে বন্দে ভারত চালু‍‌ করে আপন কীর্তি খোদাই করতে চান প্রধানমন্ত্রী। প্রায় প্রতি সপ্তাহে তাকে বন্দে ভারত ট্রেন উদ্বোধন করতে দেখা যায়।  রেল পরিষেবার বাকি সব ক্ষেত্রগুলিকে শুকিয়ে মেরে বন্দে ভারতকে তাজা করা হচ্ছে। 

বন্দে ভারত মানে মোদীর প্রচার। প্রতিটি ট্রেনের  প্রতিটি কামরায় সারাক্ষণ চলছে মোদীর প্রচার। রেল দপ্তরের কাছে এখন রেল পরিষেবা মানে বন্দে ভারত। বাকি হাজার হাজার ট্রেনের লক্ষ লক্ষ যাত্রীদের নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। সেখানে উন্নত কোচ নেই, পরিষেবার উন্নতি নেই,  সময়ের মূল্য নেই। অসহায় সাধারণ যাত্রীদের যেন দয়া  করছে রেল। তাই দুর্ঘটনায় কিছু চুনোপুঁটিকে শূলে না চড়িয়ে  ধরা হোক নীতি নির্ধারক রাঘব বোয়ালদের। দায় মোদীরও।

Comments :0

Login to leave a comment