Post Editorial

ন্যায়বিচারের দাবিতে নাছোড় মানুষ

উত্তর সম্পাদকীয়​

ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী

প্রায় বছর ঘুরতে চলল আরজি করের মহিলা চিকিৎসকের রাষ্ট্রীয় খুন-ধর্ষণের ঘটনার পরে, অথচ ন্যায়বিচারের দেখা মিলল না। এখনো জানা গেল না যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সিভিক ভলান্টিয়ার ছাড়া আর কোন কোন অপরাধী যুক্ত এই নৃশংস ঘটনায়। জানা গেল না সঞ্জয় রায় ছাড়া আর যাদের ডিএনএ’র নমুনা পাওয়া গেছে ঐ মহিলা চিকিৎসকের গোপনাঙ্গ থেকে তাদের পরিচয় জানা যায়নি। ঘটনার দিন গভীর রাত অব্দি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কার কার সঙ্গে কী কী কথা বলেছিলেন তাও অজানা। এখনো প্রকাশ্যে আসেনি ১৪ই আগস্ট রাতে যারা আরজি কর হাসপাতাল ভাঙচুর করেছিল পুলিশের সহায়তায় তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ও উদ্দেশ্য। জানা যায়নি হেলথ সিন্ডিকেটের পান্ডারা কী উদ্দেশ্যে অভয়ার মরদেহের পাশে ভিড় করেছিল পুলিশের সাহায্যে।
টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডল জামিনে মুক্ত, কিন্তু তার বিচার এখনো শেষ হয়নি। কবে হবে কেউ জানে না। দুর্নীতি মামলায় আরজি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও তার অন্যতম স্যাঙাত আশিস পান্ডে এখনো জামিন পায়নি ঠিকই, কিন্তু যে কোনোদিন পেয়ে যাবে। কারণ সিবিআই এখনো চার্জশিট দেয়নি। দুর্নীতির সঙ্গে অভয়ার খুন-ধর্ষণের যোগসূত্র ঠিক কী তা সিবিআই আদালতে এখনো জানায়নি। প্রশ্ন উঠছে, এই দুর্নীতির জাল কতদূর অব্দি বিস্তৃত? সন্দীপ ঘোষ, আশিস পান্ডে আর দুই ঠিকাদার তো পিরামিডের তলদেশ। পিরামিডের চুড়োয় কি তাহলে এমন কেউ আছে যাকে সিবিআই আড়াল করতে চাইছে রাজ্যের আর পাঁচটা দুর্নীতি মামলার মতো? সেজন্যই কি চার্জশিট দিতে এত গড়িমসি? রাজ্য সরকারের অনুমতি মিলছে না? অনুমতি না মিললে কি সিবিআই ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকবে? আর জাল ওষুধের কারবার ফুলে ফেঁপে উঠবে? ভুগবে রাজ্যবাসী? যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সিবিআই’র টিকি বাঁধা, সেই প্রধানমন্ত্রী এর দায় নেবেন না? এমন হাজারো প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে।

খুন-ধর্ষণের মামলায় আদালতে অভয়ার পরিবারের আইনজীবীরা যেসব সওয়াল করছেন, সেগুলির কোনও সদুত্তর দিতে পারছে না সিবিআই। তারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে। সঞ্জয় রায় ছাড়াও আরও একাধিক পুরুষ ও মহিলার ডিএনএ’র নমুনা পাওয়া গেছে মহিলা চিকিৎসকের যৌনাঙ্গে, অথচ সিবিআই স্বীকার করছে না দলগত অপরাধের তত্ত্ব। তারা ক্রমাগত বলে চলেছে ঐ নমুনাগুলি আরজি কর হাসপাতালের মর্গ থেকে কোনোভাবে নাকি মৃতার শরীরে এসে গেছে! মৃতার শরীর চাদরে ঢেকে চেস্ট বিভাগের সেমিনার হল থেকে মর্গ অব্দি নিয়ে গেছিল পুলিশ। অন্য পুরুষ ও মহিলার ডিএনএ মৃতার শরীরের আর কোথাও পাওয়া গেল না, শুধুমাত্র স্তনবৃন্ত, যোনি ও পায়ুদ্বারেই পাওয়া গেল। তারপরেও সিবিআই কোনও চেষ্টাই করল না ঐ ডিএনএ কাদের তা খতিয়ে দেখতে। আমরা দাবি করছি ঐ রাতে যারা ঐ বিল্ডিংয়ে ছিল, যাদের সিসিটিভিতে দেখা গেছে ঢুকতে ও বেরোতে তাদের প্রত্যেকের ডিএনএ নমুনা নিয়ে মিলিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু সঞ্জয় রায় ছাড়া সিসিটিভি ক্যামেরায় ঐ অভিশপ্ত রাতে যাদের আরজি কর হাসপাতালের চেস্ট ওয়ার্ডে ঢুকতে ও বেরোতে দেখা গেছে, তাদের পরিচয় আদালতে জানাচ্ছে না সিবিআই। জানাচ্ছে না খুন হবার পরেও কারা কেন অভয়ার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে কী কী তথ্য মুছে ফেলেছে। সঞ্জয় রায়ের মোবাইল ফোন টালা থানা ও লালবাজারের অফিসাররা বেআইনিভাবে জমা রেখে ঠিক কী কী তথ্য সেখান থেকে মুছে ফেলেছে তাও সিবিআই জানায়নি আদালতে।

রাষ্ট্রব্যবস্থার স্তম্ভগুলি এই রাষ্ট্রীয় খুন-ধর্ষণের বিচার দিতে ব্যর্থ। রাজ্য পুলিশ, সিবিআই যে একই মুদ্রার দুই পিঠ তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ত্রিস্তরীয় বিচারব্যবস্থা শেষ অব্দি ন্যায়বিচার দিতে পারে কিনা সেদিকে সবাই তাকিয়ে আছে। কিন্তু মহিলা ও প্রান্তিক যৌন-লিঙ্গতা পরিচয়ের মানুষজনের উপর অত্যাচার কমেনি, বেড়েই চলেছে। কোথাও শাসকদলের কার্যালয়ে আবাস যোজনার নামে ডেকে গ্রামের মহিলাকে ধর্ষণ করছে শাসকদলের নেতা, তো কোথাও শাসকদল প্রকাশ্যে খাপ-পঞ্চায়েত বসিয়ে বেত্রাঘাত করছে গরিব মহিলাদের। শাসক দলের নেতা পুলিশ আধিকারিকের মা ও স্ত্রীকে ফোনে ধর্ষণের হুমকি দিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছে। কলেজ ক্যাম্পাসে শাসক দলের নেতা শাসক দলেরই ছাত্রনেত্রীকে ধর্ষণ করে তার ভিডিও তুলে রাখছে। শাসকদলের নেতারা শাসক দলেরই ছাত্রনেত্রীর কৃত্রিম নগ্ন ছবি চালাচালি করছেন। শাসক দলের নেতারা 'মাথাব্যথার উপশমের জন্য' ক্লাস থেকে ইউনিয়ন রুমে ডেকে পাঠাচ্ছেন বাছাই করা ছাত্রীদের। কলেজ ক্যাম্পাসে কখনো শাসক দলের ছাত্রনেতার বিয়ের বাসর বসছে তো কখনো ছাত্রদের নগ্ন করে র্যা গিংয়ের আসর বসছে।

রাশ টানা হয়নি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের সীমাহীন দুর্নীতিতে, বরং তা আরও বিস্তৃত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে। রাজ্য জুড়ে জাল ওষুধের রমরমা প্রকাশ্যে এসেছে। জাল স্যালাইনে প্রাণ গেছে এক নবজাতক শিশু এবং দুই প্রসূতি মামণি রুইদাস ও নাসরিন খাতুনের। স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষ কোনও পরিবর্তন আসেনি। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার হাল তথৈবচ।

হুমকির সংস্কৃতি তথা ভয়ের রাজনীতি, প্রতিহিংসার রাজনীতি লাগামছাড়া হয়েছে। তেরো বছরের নিরপরাধ ফুটফুটে মেয়ে তামান্নার দেহ তার নিজের বাড়ির সামনে বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন করে দিল শাসকদল। তার খুনিদের এখনো আড়াল করছে পুলিশ। খুনি-ধর্ষক, দুর্নীতিগ্রস্ত অপরাধীদের মদত দেবার পাশাপাশি প্রতিবাদী চিকিৎসকদের দূরে বদলি ও নাগরিকদের হয়রান করা, আন্দোলনরত শিক্ষক বা ধর্মঘটী শ্রমিকদের উপর নৃশংস আক্রমণ নামিয়ে আনছে প্রশাসন। প্রশাসন আর শাসক দলে তফাৎ খুঁজে পাওয়া ভার, মিলেমিশে এক হয়ে গেছে।

তদানীন্তন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল সম্মানজনক পুনর্বাসন পেয়েছেন, অপসারিত স্বাস্থ্য অধিকর্তা অবসরের পর এক্সটেনশন পেয়েছেন, অপসারিত স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তাও একই ক্যাম্পাসে কর্মরত। দপ্তরের অভিযুক্ত সচিব স্বপদে বহাল, এখন আরও উদ্ধত, আরও বেপরোয়া। অভয়ার মরদেহ তড়িঘড়ি দাহ করানোর দায়িত্ব পালন করে পানিহাটির কাউন্সিলর পদোন্নতি পেয়ে চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন। হেলথ সিন্ডিকেটের পান্ডাদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ সহ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এখন হিমঘরে। পিছনের দরজা দিয়ে তাদের ক্লিনচিট দেবার ফাইল চালাচালি চলছে। অপরাধীদের আস্তানা মেডিক্যাল কাউন্সিল তোলাবাজির নিত্য নতুন ফরমান জারি করছে। তোলাবাজ চিকিৎসকরা গালভরা নতুন নাম দিয়ে সংগঠন খুলেছে, এবার সরাসরি এক মন্ত্রীকে মাথায় রেখে।

সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও লুটের টাকায় ভোটের অঙ্ক সাজাতে ব্যস্ত কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসকদল। অন্যদিকে দুই শাসকের অনাচারে নাভিশ্বাস খেটে-খাওয়া মানুষের। কোনও অন্যায়েরই সুবিচার পাচ্ছে না মানুষ। বিচারপ্রার্থী মানুষ সাম্প্রদায়িক জাঁতাকল থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামতে চায় দুই শাসকের বিরুদ্ধে। তার প্রমাণ অভয়া আন্দোলন।

অভয়ার ন্যায়বিচার চেয়ে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ইতিহাস তৈরি করেছে, যা এরাজ্যে শাসকের দম্ভের ভিত নাড়িয়ে দিতে পেরেছিল। স্বাভাবিক কারণেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন একসময় স্তিমিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এ রাজ্যের সংগঠিত ছাত্র-যুব-মহিলা ও শ্রমিক-কৃষকরা সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। গত এপ্রিলে শ্রমিক-কৃষক-বস্তিবাসীদের যৌথ ব্রিগেড সমাবেশের অন্যতম দাবি ছিল অভয়ার ন্যায়বিচার চাই। গত ৯-ই জুলাই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা সাধারণ ধর্মঘটে অন্যতম দাবী ছিল নারী সুরক্ষা ও নারীনিগ্রহে যুক্ত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। ফলে উত্তরবঙ্গের চা-শ্রমিক থেকে শুরু করে দিনাজপুরের নির্মাণ-কর্মী, মুর্শিদাবাদের বিড়ি-শ্রমিক, হাওড়া-হুগলীর চটকল শ্রমিক, খনি অঞ্চলের কয়লা-শ্রমিক বা কলকাতার আইটি কর্মী, গিগওয়র্কার, পরিবহণ-শ্রমিক ক্যাবচালক, গৃহপরিচারিকা, রিকশা-ভ্যান চালকদের মিটিংয়ে আবার অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবি উঠেছে প্রবলভাবে। শ্রমিকরা 'উই ওয়ান্ট জাস্টিস' আওয়াজ তুলছেন কারখানার গেট-মিটিংয়ে, হাট-মিটিংয়ে, স্ট্রিট-কর্নারে।

আবার আগস্ট আসছে। বিচার প্রক্রিয়ার যা ধীরগতি, ঐ নৃশংস ঘটনার বর্ষপূর্তিতেও সুবিচার আসবে বলে মনে হয় না। কিন্তু বিচারের দাবিতে পথে নামা লাখো লাখো মানুষের হৃদয়ে আজও বিচার ছিনিয়ে আনার জেদ অটুট। তাঁরা আবারো পথে নামতে চান। শাসকের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করতে শিখে গেছেন তাঁরা। গত আগস্টের মতো মানুষ এই আগস্টেও মিছিল খুঁজবেন। শুধু প্রয়োজন প্রত্যেক জায়গায় মিছিলের ডাক দেওয়া। এবারের ৯ই আগস্ট ন্যায়বিচার চেয়ে রাজপথে উত্তাল আন্দোলনের ঢেউ তোলার দিন। শাসকের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদের দিন। তাই ব্রিগেডের সমাবেশে আসা কৃষক-খেতমজুর-বস্তিবাসী, বুক চিতিয়ে ধর্মঘট করা মুটে-মজুর-শ্রমিক, গণ-আন্দোলনের ইতিহাস তৈরি করা ছাত্র-যুব-মহিলারা জেলায় জেলায়, গঞ্জে-শহরে জুলাই মাস জুড়ে এই বার্তাই পৌঁছে দেবে— জোট বাঁধো, তৈরি হও। 'দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে, প্রস্তুত হ'তেছে ঘরে ঘরে' তাদের প্রত্যেকের কানে কানে প্রত্যাঘাতের মন্ত্র জোগাবে।

বিচারের পথ রুদ্ধ করতে রাজ্যের শাসকের দোসর কেন্দ্রের শাসক, যাদের গত একবছরে কোথাও কোনও আন্দোলনে দেখলাম না, তাদের নবান্ন অভিযানের ডাক নাটক ছাড়া আর কী! আদৌ যদি সদিচ্ছা থাকত, তাহলে এরাজ্যের প্রধান বিরোধী দল দিল্লিতে সাউথ ব্লক অভিযান করে প্রধানমন্ত্রীকে সিবিআই-কে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে বলত। বাংলার মানুষ এই নাটকে আর ভুলছেন না। তার বদলে তাঁরা প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি অঞ্চলে সমস্ত শ্রেণির মানুষকে একত্রিত করে সংগঠিত আওয়াজ তুলবেন শাসকের পোষা লুম্পেনবাহিনীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে।
 

Comments :0

Login to leave a comment