POST EDITORIAL

অন্ধবিশ্বাস হটিয়ে যুক্তিবাদের বিকাশে আর বিলম্ব নয়

উত্তর সম্পাদকীয়​ বিশেষ বিভাগ সম্পাদকের বাছাই

post editorial ganashakti superstition bengali news

অরুণাভ মিশ্র
 

স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। মনে করুন সময়টা অষ্টাদশ শতক বা উনিশ শতকের গোড়ার দিক। স্বামীকে দাহ করা হবে। মৃত দেহকে দাহ করা হিন্দুদের আর কবর দেওয়া মুসলমানদের রীতি। মৃত স্বামীকে কাঠের চিতায় তোলা হলো দাহ করার জন্য। তার সঙ্গে তার জীবন্ত স্ত্রীকেও জোর করে চিতায় জীবন্ত পোড়ানো হল। এই হল সহমরণ। এই হল সতীদাহ। সতীদাহ অষ্টাদশ শতক এবং উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকের এক কুসংস্কার। তখন হিন্দুরা ভাবত এইভাবে বিধবা পত্নীকে জীবন্ত পুড়িয়ে দিলে তার ও তার স্বামীর অক্ষয় স্বর্গ লাভ হবে। অথচ হিন্দু ধর্মেই বলে, মানুষ তার কর্মফলে স্বর্গ বা নরক বাস করে । স্ত্রীকে জোর করে জীবন্ত পোড়ানোর সঙ্গে, বা স্ত্রীর সহমৃতা হওয়ার সঙ্গে তার স্বামীর স্বর্গবাসের সম্পর্ক কোথায়? এই প্রথার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করার কাজ করেছিলেন রামমোহন। এর বিলোপে ইংরেজ সরকারের কাছে আইন চাইলেন। আইন হলো। সেই সঙ্গে যুক্তি বুদ্ধি দিয়েও মানুষ বুঝতে শিখল, এভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়ার কাজ অন্যায়। একে হত্যার সমান অপরাধ ধরা যায়। অমানবিক আর অযৌক্তিক এই প্রথা আজ সমাজ থেকে বিদায় নিয়েছে। কারণ, এখন সকলে বুঝেছেন, এই প্রথা ছিল এক ধরনের কুসংস্কার। কুসংস্কার কেননা ঘটনার সঙ্গে প্রার্থিত ফলের দাবির কোনও সম্পর্ক নেই। কুসংস্কার যুক্তির আবহাওয়ায়, বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণের পরিবেশে, বিশ্লেষণী মনোভাবের লালনে ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের সাথে দূরে সরে যায়। তাই যে প্রথা বা বিশ্বাস উপযুক্ত যুক্তি বুদ্ধি ও প্রমাণের প্রয়োগে দূর হয় তাকে আমরা বলতে পারি কুসংস্কার। কুসংস্কারের আরেকটা চরিত্র হলো, ঘটনা ও তার ফলাফলের কার্যকারণ সম্পর্কহীনতা। স্ত্রীকে জীবন্ত পোড়ানোর সঙ্গে স্বামী বা মৃতা স্ত্রীর অক্ষয় স্বর্গলাভের কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। তাই এই আচরণ কুসংস্কার। বিধবাদের বিয়ে না দেওয়ার প্রথা, কালাপানি না পেরুনোর প্রথা, মেয়েদের শিক্ষা না দেওয়ার প্রথা, সবই এক একটি কুসংস্কার। আজ সবই সমাজ থেকে দূর হয়েছে বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক ভাবনার প্রসারের সাথে সাথে।
 


যদি তা না হতো, বৈজ্ঞানিক ভাবনার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে যেত, তবে আমরা সেই প্রথা বা বিশ্বাসকে অন্ধবিশ্বাস হিসেবে চিহ্নিত করতাম। একটা ঘটনার কথা মনে করাতে পারি এ প্রসঙ্গে। সেটা হলো, গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ তৈরি আর তা দিয়ে মহাকাশকে তাক করার কথা। অবাক হয়ে তিনি দেখলেন বৃহস্পতির চাঁদেরা তাকে ঘিরে ঘুরছে। দেখলেন শুক্রের কলা পরিবর্তন,  চাঁদের গহ্বর আর টিলা ও পাহাড়। দেখলেন সৌরকলঙ্ক। আর এসব দেখার জন্য সহকর্মী বন্ধুদের বললেন তার টেলিস্কোপে চোখ রাখতে। সহকর্মীরা সব শুনে বললেন, 'কি যে বলো, বৃহস্পতির চাঁদ আবার কিভাবে দেখবে তুমি? তোমার চোখের দোষ হল কিনা তাই বরং দেখো।' গ্যালিলিও বললেন, 'ঠিক আছে, আমার না হয় চোখ খারাপ, তবে তোমরাই দেখো। তোমাদের চোখ তো ভুল দেখবে না।' কিন্তু সহকর্মীরা টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে দেখতে আগ্রহী হলেন না। কারণ তারা গাঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে তাদের পূর্বসূরিরা তাদের জন্য যে জ্ঞান রেখে গেছেন, তা ই ধ্রুব। অ্যারিস্টটলের ভাষ্যই তাদের কাছে ছিল শেষ কথা। তাই টেলিস্কোপে চোখ না লাগিয়ে তারা গ্যালিলিওকে বলেছিল, 'চোখ না খারাপ হলে দেখো, তোমার মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে কিনা!' এই হল অন্ধবিশ্বাস। উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ পেয়েও যা দূর হতে চায় না। তেমনি বিবর্তনের বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে প্রাণী এবং মানবে বিকাশ আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য হলেও বিশ্বের বহু মানুষ আজও সৃষ্টিবাদে অন্ধবিশ্বাসী হয়ে আছেন।
 


অন্ধবিশ্বাস কেমন করে পরীক্ষাগত প্রমাণে বিফল হয়েও নিজের অস্তিত্ব জাগিয়ে রাখে তার একটা সুন্দর উদাহরণ দিয়েছিলেন দাভোলকার। আমাদের দেশে বহু জায়গায় খ্রিস্টান মিশনারিরা আছেন। তারা বলেন, তোমরা যদি মন দিয়ে আমাদের যীশুর প্রার্থনা করো, তাহলে অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পাবে, বোবা কথা বলতে পারবে, আর খঞ্জ হাঁটবে কোনো সাহায্য ছাড়াই। প্রতি বছর তাদের বাৎসরিক এক অনুষ্ঠানে এই কথার সত্যতা প্রমাণে তারা প্রার্থনার সময় অন্ধ খঞ্জ ও মুক কিছু মানুষকে ডাকেন। তারপর প্রার্থনার শেষে মঞ্চে ওদের কয়েকজনকে এনে দেখান, তাদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে। এক ধরনের বিভ্রম তৈরি করে তারা সবার সামনে কাজটা করেন। ব্যাপারটার ভেতরে প্রকৃত সত্য কতটা আছে তা দেখতে চাইলেন দাভোলকার। মহারাষ্ট্রের কুদলে এমনই এক প্রার্থনা সভা ডাকা হচ্ছে দেখে তিনি নিজে বিষয়টা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিলেন। তার সংগঠন ANIS (অনিস) এর কুদল শাখার উদ্যোগে অন্ধদের একটি স্কুল থেকে ১০ জন অন্ধ ছাত্রকে সেই প্রার্থনা সভায় পাঠানো হলো। তাদের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিতে বলা হলো সংগঠকদের। অন্যথায় এই প্রতারণার ব্যবসা বন্ধ করতে আবেদন জানানো হলো। এতে শিক্ষিত খ্রিস্টান সম্প্রদায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখালেন। তাদের বক্তব্য, প্রার্থনায় যীশুর আশীর্বাদে অবশ্যই অন্ধরা দৃষ্টি পায়। বোবারা পায় বাক ও খঞ্জরা পা। কিন্তু তার জন্য ওদের যিশুর প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে। যে অন্ধ ছেলেদের এখানে পাঠানো হয়েছে তারা অবশ্যই যীশুর প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস সম্পন্ন নয়। তাই এই পরীক্ষা আপনাদের করতে দেওয়া যাবে না। কার কতটা বিশ্বাস আছে তা প্রমাণ করার তো কোনও মাপকাঠি নেই। তাই কৌশলে এই ভ্রান্ত বিশ্বাসকে সরাসরি ভুল প্রমানিত হওয়ার পরীক্ষা থেকে এড়িয়ে গেলেন মিশনারীরা। তাদের ধর্ম বিশ্বাস এক অন্ধ বিশ্বাস। শত পরীক্ষার বিফলতা ও তাকে টলাতে পারবে না। অথচ এই অন্ধবিশ্বাস নানা শারীরিক ও সামাজিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সব ধর্মেই আছে এমন অন্ধবিশ্বাস। রামের জন্মস্থান নিয়ে এক অংশের হিন্দুদের অন্ধবিশ্বাসে দেশের সর্বোচ্চ যুক্তি ও প্রমাণ নির্ভর প্রতিষ্ঠানও মাথা বিকিয়ে সিলমোহর দিল। এই বিশ্বাসীরা অটল থাকেন আপ্তবচনে, 'বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ তর্কে বহুদূর।'
 


কিন্তু অনুসন্ধিৎসু হওয়া সবকিছু বিচার বিবেচনা করে গ্রহণ বা বর্জন করা বৈজ্ঞানিক মননের লক্ষণ। প্রথার কোলে মাথা দেওয়া তো বিজ্ঞানীর বিশ্লেষনী মনোভাবের বাইরে। যাচাই না করে বিচার না করে বিজ্ঞান কোনো কিছুই গ্রহণ বা বর্জন করে না। কিন্তু আমরা অনেকেই তা করি। এটা বোঝাতে গিয়ে দাভোলকার তাদের মহারাষ্ট্রের একটি ঘটনার কথা বলেছিলেন। ১৯৯৪ সালে মহারাষ্ট্রের বার্ষিক সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল কোলহাপুরে। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সেঙ্গারের গজানন মহারাজের ফটোর সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে। কে ছিলেন এই গজানন মহারাজ?  তিনি নাকি অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারতেন। সেসব আজ আর পরীক্ষা করার সুযোগ নেই, যেহেতু তিনি আর বেঁচে নেই। মহারাজকে ভালো ভালো পোশাক পরিয়ে দিলে তিনি নাকি সেসব খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন, আর নগ্ন হয়েই থাকতেন। ভালো খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁটে খেতেন। দিনের পর দিন স্নান করতেন না। অবিরত ছিলিম থেকে ধূমপান করতেন। যে কোনো প্রশ্নই তাকে করা হোক না কেন তিনি জবাব দিতেন, 'গনা গনা গনাৎ বোতে'। এ কথার মানে যে কি, তা কে বলতে পারে! এরকম একজন মানুষ কিভাবে একদল বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীল সাহিত্যসেবীদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেন? এমন প্রশ্ন ওঠা আপনার বৈজ্ঞানিক মনন কাঠামোরই পরিচয়। কিন্তু কোলহাপুরের ওই এলাকার মানুষ মহারাজকে নিয়ে এমন প্রশ্ন যদি কেউ তোলে, তবে আজও তা সহ্য করতে পারেন না। গজানন মহারাজে এমনই অটল বিশ্বাস তাদের। এরকম বহু বাবা ও গুরুর প্রতি অনড় বিশ্বাস নিয়ে বহু মানুষ আজও বেঁচে আছেন। বহু ঘটনা ঘটছে, যাতে ওই মানুষটির প্রতি বিশ্বাসকে ঘিরে প্রশ্ন তোলা যায়। কিন্তু ‘অন্ধবিশ্বাস’ তাতে বাধা দিয়েছে। বাবাদের রমরমা তাই সমাজে আজও কমেনি। তাদের শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি যে শাসকদের সেবার বিনিময়ে গড়ে ওঠে তাও অনেকেই জানেন। এদের ভক্তরা হয় শাসকের ভোট- ব্যাঙ্ক। তাই এমন অন্ধবিশ্বাসীদের বাঁচিয়ে রাখতে সমাজে যুক্তিবাদের অপসারণ আর অপবিজ্ঞানের প্রসার চায় আজকের শাসক। ধনবাদের প্রসারে সামন্তবাদের যতটা সংস্কার দরকার ছিল তা ঘটে গেছে। এখন পুরানো সংস্কার ফিরিয়ে এনে শাসক তার ক্ষমতা রক্ষায় বিশ্বাসীদের হাতিয়ার করতে চায়, যাদের ঠিক ভুল বোঝার ক্ষমতাটাই চলে গেছে।
 


অথচ আগের সব অন্ধবিশ্বাস তো আজ আর নেই। প্রাচীন মানুষের কাছে ঝড় বজ্র আগুন বৃষ্টি এসব ছিল দেবতা। কারণ বনবাসী মানুষের কাছে প্রকৃতির এই রুদ্ররূপ গুলো যখন প্রকাশিত হতো, তখন সে ভাবতো কোনো দেবদেবী বুঝি রুষ্ট হয়ে এসব ঘটাচ্ছেন। তাই সে ঝড় বৃষ্টি বজ্র আগুন প্রভৃতির দেবতা বানিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আজ? আজ তো একটা ছোট্ট দেশলাই কাঠিতেই আগুন বাঁধা। চাইলেই যে কেউ জ্বালাতে পারে আগুন। তার জন্য 'হে অগ্নিদেব, তুমি এসো, প্রকাশিত হও'  বলে তাকে প্রার্থনা করতে হয় না। দেবতা অগ্নির কাল চলে গেল, অথচ গজানন মহারাজদের আসন পোক্ত হয়ে গেল সমাজে। তাহলে আমরা কোন সমাজের দিকে এগচ্ছি?  গুটি বসন্ত কিন্তু টিকা দিয়ে দূর করা সম্ভব হয়েছে, শীতলা পুজোতে নয়। এখন জল বসন্ত হলেও শীতলা পুজোর সেই রমরমা আর নেই। বাড়ির মেয়েকে দেবতার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার নামে দেবদাসী প্রথা, তাও অনেকটা বন্ধ হয়েছে। চড়কের সময় ভক্তদের পিঠে কাঁটা ফুটিয়ে পাক দেওয়ার মত সমস্যাসঙ্কুল অমানবিক আশঙ্কাজনক প্রথা সামান্য কয়েকটা জায়গায় টিকে আছে। টিকে আছে ডাইনি হত্যা। এসবের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব কুসংস্কার যত তাড়াতাড়ি সমাজ থেকে বিদায় নেয় ততই মঙ্গল।
 


আচ্ছা মানুষ কেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়? কুসংস্কার দেখে তার এতই ভালো লেগে যায় যে, সে তাতে হামলে পড়ে? নাকি কুসংস্কার তার খুব দরকারি? না, তা নয়। কুসংস্কারের পথে সে পা বাড়ায় সমস্যায় পড়ে, সমস্যার ঝাঁকুনি কাটাতে। বিপর্যস্ত অবস্থা সামলাতে। মেয়ের বিয়েটা হঠাৎ ভেঙে গেল,  ছেলেটার একটা কাজ চাইই চাই, বাড়ির মানুষটার অসুস্থতা কোনো মতেই সারছে না, ভাইয়ের এক্সিডেন্ট! এইরকম সমস্যায় পড়ে বৈজ্ঞানিক মননহীন মানুষেরা কুসংস্কারের কবলে পড়েন। তাই পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যায় পড়ে যেসব মানুষ কুসংস্কারে আশ্রয়ে গিয়ে তার ঝাঁকুনিটা বা সমস্যার অভিঘাতটা সামলান, তাদের প্রতি কখনো উষ্মা প্রকাশ করা উচিত নয়। বরং যত্নবান ও মানবিক হয়ে তাদের সমস্যায় পাশে দাঁড়াতে হয়। পাশে থেকে তার মন পেতে পারলে সে মনে যুক্তিবাদ আবাদ করা অসম্ভব হবে না। তাই কুসংস্কার আচ্ছন্ন বলে কাউকে কখনো দূরে ঠেলে দেওয়া ঠিক নয়। সমস্যাদীর্ণ মনের কাছেই তো তিনরতি প্রবালের আংটি ধারণের নিদান আসে। অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় যথার্থ অর্থ না থাকার পথই তো তেলপড়া জলপড়ার জায়গা করে দেয়। ক্রনিক রোগব্যধির যথাযথ চিকিৎসার অভাবই তো অসহায় মানুষটাকে 'ডাইন' চিহ্নিত করে নিরাময়হীনতার কারণ ঠাওরায়। তাই সামাজিক নানা অব্যবস্থা ও অস্বাচ্ছন্দ যে কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের মূলে তা বুঝে নেওয়া ভালো।
 


বিশ্বাসী যিনি হবেন না তিনি তবে কি হবেন? তিনি হবেন অনুসন্ধিৎসু, তিনি হবেন মুক্তচিন্তক, তিনি হবেন বিশ্লেষণী মনের। তিনি ঘটনার পেছনে থাকা কারণ জানতে আগ্রহী হবেন। সব পুরনো প্রথা বা রীতিকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দেবেন তিনি এমনটা নয়। বরং তিনি সেগুলোকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে তবেই গ্রহণ বা বর্জনের সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি যেন প্রত্যয় নিয়ে বলতে পারেন 'I do not believe in belief ' । পড়াশোনা তার মধ্য দিয়ে জানা, জানার পথে অসংখ্য জিজ্ঞাসাকে লালন করা অর্থাৎ প্রশ্ন ও যাচাই করা, এবং তারপরই কেবল কোনো কিছু সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব। যুক্তিবাদী মনকে এই চার ধাপ বেয়েই চলতে হবে অন্ধবিশ্বাসকে মোকাবিলা করার এটাই উৎকৃষ্ট পথ। এ বিষয়ে ভগৎ সিং তার বিখ্যাত বই 'কেন আমি নাস্তিক' এ প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলেছিলেন। তার সেই উক্তিটি দিয়েই রচনার ইতি টানি। তিনি লিখেছেন, '... যারা প্রগতির পক্ষে তাদের প্রত্যেকের উচিত পুরানো বিশ্বাসের প্রতিটি নীতি কে খুঁটিয়ে দেখা। পুরানো বিশ্বাসের প্রতিটি উপাদানের কার্যকারিতা কে একটা একটা করে পরীক্ষা করে দেখা উচিত। তাকে সবকিছু বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করতে আর বুঝতে হবে। যদি নির্মম কাটাছেঁড়ার পরও কেউ কোনো দর্শনের তত্ত্বে বিশ্বাস করার যুক্তি খুঁজে পান, তবে তাঁর বিশ্বাস প্রশংসনীয়। তাঁর যুক্তি ভুল হতে পারে, এমনকি অমূলকও হতে পারে, কিন্তু তাঁর মধ্যে সম্ভাবনা আছে নিজেকে ঠিক করে নেওয়ার, কারণ তার জীবন পরিচালনা করার নীতি হচ্ছে যুক্তিবাদ। কিন্তু বিশ্বাস, আমার বলা উচিত অন্ধবিশ্বাস, ভয়ংকর ক্ষতি করে। তা একজনের কোনও কিছুকে বোঝার ক্ষমতা কে নষ্ট করে, আর তার ফলে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন প্রগতির বিরুদ্ধে।'
 


অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কার হঠিয়ে সমাজে যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠা আজকের এক বড় লড়াই। কিন্তু এটাই একমাত্র লড়াই নয়। অপবিজ্ঞান ও অযুক্তির শক্তিকে সরিয়ে সমাজকে বিজ্ঞানমনস্ক করা আজ বড়ো প্রয়োজন। এজন্য দরকার প্রমাণ নির্ভর যুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যোগী হওয়া আর বিশ্লেষণী মনোভাবের বিকাশ ঘটানো। সমাজকর্মী ও বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মীদের একাজে আজ মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। বেদবাদী, সংস্কৃতবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী, হিন্দু, সংস্কৃতির বদলে দেশে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, গণতন্ত্র, ভিন্নমতে শ্রদ্ধা ও যুক্তিবাদের বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি বিকশিত করতে হলে আর বিলম্ব নয়!
(লেখক বিদ্যাসাগর কলেজে রসায়নের অধ্যাপক)

Comments :0

Login to leave a comment