নন্দন ভট্টাচার্য
বর্তমান সময়ে থিয়েটারে তরুণ প্রজন্মের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ হাজির করা জরুরি। তবে মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে মাপকাঠিগুলি স্পষ্টভাবে নিরুপণ করে নেওয়া প্রয়োজন। সাধারণভাবে ১৮-৩৫ বছরের বয়সসীমাকে আমরা তরুণ ধরে নিতে পারি। এবং আমরা একবিংশ শতাব্দীর আগমনের পরবর্তীকালকে বেছে নিচ্ছি। কারণ এই সময়কালে থিয়েটারের আঙিনায় কিছু গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথমত থিয়েটার এখন পেশাদার-অপেশাদার, বড় দল, ছোট দল, স্টার-নির্ভর, স্ব নির্ভর প্রভৃতি শ্রেণি দ্বন্দ্বে বিভক্ত। এ বিভাজন হয়ত আগেও ছিল কিন্তু মিডিয়ার প্রসারের ফলে প্রথম বিভাগে অনেক কিছু প্রাপ্তির বিষয় থাকে, কিন্তু দ্বিতীয় বিভাগে কিছু না পাওয়ার বিনিময়ে নিঃস্বার্থ থিয়েটার কর্মী হওয়ার পরিস্থিতি বিদ্যমান। আলোচনাকে আরও সঙ্কীর্ণ করা প্রয়োজন পরিসর ও পিনদ্ধ করার স্বার্থে। আমরা সেই দলগুলির কথাকেই বেশি করে গুরুত্ব দেব যারা শ্রেণি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করছেন, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার থিয়েটার করছেন, যাঁদের প্রতি মূহুর্তে আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকছে বা আক্রান্ত হচ্ছেন, নাটক করার ক্ষেত্রে যাদের প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে ইত্যাদি। কেন এই শেষের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া? কারণ ও ব্যাখ্যা সহজবোধ্য। যেখানে চরম দক্ষিণ পন্থার বা বলা ভালো যে ফ্যাসিস্ত বৈশিষ্ট্যর কর্ষণ হয়ে চলেছে দেশ জুড়ে এবং বিশ্বজোড়া উদারবাদী, ভোগবাদী সংস্কৃতির সুনামি প্রতিনিয়ত তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে ধ্বস্ত করছে মানবতা ও সংগ্রামের বেলাভূমিকে সেখানে আজকের এই ভয়ঙ্কর সময়ে দাঁড়িয়ে আজকের থিয়েটারের আঙিনায় দৃপ্ত বিচরমান চে বা ক্ষুদিরাম বা ভগত সিং দের চিনে নেওয়া ও চেনানো ঐতিহাসিক কর্তব্য। সেই কর্তব্যের দায় থেকে এই আলোচনার প্রয়োজন। অতএব আমরা বর্তমান আলোচনায় আনব ২০০০ সালের পর অপেশাদার শ্রেণি সচেতন নিঃস্বার্থ থিয়েটার কর্মী হিসাবে ১৮-৩৫ বয়সসীমার তরুণ তরুণীদের অংশগ্রহণ।
এরা আসে অধিকাংশই সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। হয় শিক্ষার্থী বা সদ্য পাশ করে কর্মসংস্থানের চেষ্টায় ব্যস্ত। এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য কি? যে তাত্ত্বিক ভিত্তি মাও জে দঙ বা লু সুন চিহ্নিত করেছিলেন তা এখনও সমভাবে প্রযোজ্য। বর্তমান সময়ের সবকটি ভালো ও মন্দ বৈশিষ্ট্যের গন্ধ মেখে এরা আসে। এরা সতেজ ও সপ্রাণ। সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করে, সোশাল মিডিয়ায় সড়োগড়ো, প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ। মোটেই মুখচোরা লাজুক নয়, (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, তবে তা নিয়মকেই সিদ্ধ করে) নিজের মত প্রকাশ করতে সঙ্কোচ করে না। পঠন পাঠনে অনীহা কিন্তু ইনফরমেশন গ্রহণের ক্ষেত্রে এরা সক্রিয়। তার ফলে হয়ত কোথাও কোথাও বিশ্লেষণাত্মক গভীরতার অভাব অনভূত হয়। নিজের মতপ্রকাশের সঙ্কোচহীনতা কোথাও প্রতীয়মান হয় ঔদ্ধত্য রূপে। কিন্তু এক্ষেত্রে চণ্ডীমণ্ডপীয় গাম্ভীর্যে বিচারশালা না বসিয়ে যদি সহানুভূতি ও মুক্ত মন নিয়ে যুগের বৈশিষ্ট্যকে গ্রহণ করা যায় তাহলে এদের ভূমিকা দলে ও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য সতর্ক থাকতে হবে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের জায়গায়। সেখানে যেন কোনোরকম আপস না করা হয়। দলের পরিচালক মণ্ডলীর রাজনীতি ও সমাজ সচেতনতা এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নেয়। শুধুমাত্র নাটকের মহলা নয়, নিয়মিত পঠন পাঠন, রাজনীতি ও সামাজিক বিষয় নিয়ে চর্চা চালিয়ে গেলে ফল পাওয়া যায়। প্রচুর প্রমাণ চোখের সামনে আছে। সক্রিয় দক্ষিণপন্থী এমনকি আরএসএস প্রভাবিত পরিবারের সন্তান থিয়েটার করতে এসে মতাদর্শগতভাবে বাম মনস্ক কর্মী হয়ে উঠেছে, এ নিদর্শনও বিরল নয়।
কিন্তু বিচ্ছিন্ন উদাহরণ সমগ্রের আভাস দেয়। সমগ্রকে অনুধাবন করতে গেলে প্রয়োজন বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন। এই উদ্দেশ্যে কলকাতা এবং জেলার থিয়েটারের দলগুলির থেকে প্রাপ্ত যে তথ্য ও বিষয়গুলি উঠে এসেছে তাকে সাধারণীকরণ করা এবং সূত্রায়িত করার প্রয়াস নেওয়া হলো।
আপাতদৃষ্টিতে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের ফল যেটা দাঁড়িয়েছে তা হলো— এই মুহূর্তে কলকাতা এবং জেলায় একাধিক নাট্যদলের নির্দিষ্ট শাখা আছে, যেখানে ১৮-৩৫ এই বয়সসীমার কর্মীরাই কাজ করেন। একাধিক নাট্যদল গঠিত ও পরিচালিতই হয় তরুণদের দ্বারা। উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণবঙ্গ, কলকাতা বা জেলা নির্বিশেষে এই একই চিত্র উঠে আসছে। অবশ্য এ প্রসঙ্গে দুটি মত বেরিয়ে আসে। একটি মত অনুসারে তারুণ্যের প্রাধান্য এই সময়ের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট। উদাহরণ কোনও কোনও দলে ৬০%, ৭৫%, ৯০% এমনকি কোথাও ৯৫% সদস্য সদস্যা তরুণ প্রজন্ম দিয়ে গঠিত। ভিন্নমত হলো তার বিপরীত। যদিও তার কারণ বিশ্লেষণ করলে একটি গভীরতর সামাজিক ইস্যুর সন্ধান মেলে। প্রথমত প্রচণ্ড সামাজিক ক্রাইসিস। বেকারি, প্রতিযোগিতা ও অনিশ্চয়তার যে ভয়াবহ বাতাবরণ সমগ্র সমাজকে গ্রাস করছে তার ফলশ্রুতিতে অভিভাবকদের একটি বিরাট অংশ তাঁদের সন্তানদের থিয়েটার নামক একটি অপেশাদার ও অর্থনৈতিক ভাবে অফলদায়ী বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার ক্ষেত্রে অনুৎসাহিত করবেন এবং বাধা দেবেন এটাই স্বাভাবিক। ফলত সেই অংশের তরুণ তরুণীরা ইচ্ছে থাকলেও যোগ দিতে পারছে না। দ্বিতীয়ত যে অংশটি শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় হয়তো কোন দলে কাজ করছে কিন্তু সরকারি ও সুনিশ্চিত চাকরির সুযোগ যেহেতু ক্রমহ্রাসমান এবং বেসরকারি ও অনিশ্চিত চাকরিতেই কর্মসংস্থানের সুযোগ (অবশ্যই স্বল্প মাইনে এবং কর্ম সময়ের কোনও স্থিরতা নেই) তাই যেই মূহুর্তে তারা কর্মজীবনে প্রবেশ করছে, তাদের পক্ষে নিয়মিত থিয়েটারের মতো সাধনা ও পরিশ্রম সাপেক্ষ শিল্প চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এই ক্ষেত্রে থিয়েটার আন্দোলন ও সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন একই পথে এসে দাঁড়ায়। জীবিকার সংগ্রাম, সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম আর থিয়েটারের বহমানতার সংগ্রাম আলাদা কোনও ইস্যু থাকে না, হয়ে ওঠে পরস্পরের সহায়ক ও পরিপূরক শক্তি।
উপরোক্ত আলোচনা যেটুকু হয়েছে তা থেকে এটা অনুমান করা অসমীচিন হবে না যে প্রবল সামাজিক বাধা সত্ত্বেও যুবসমাজ থিয়েটারে আসছে। হ্যাঁ, সংখ্যা বা শতাংশের বিচারে তা হয়তো লক্ষণীয় নয়, কিন্তু তা বলে সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে বসে হতাশার বিলাসিতা ও প্রবীণত্ত্বের শ্লাঘার আত্মরতিও কাম্য নয়। বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে এই সংখ্যা গুণগত বিচারে অসীম মূল্যের দাবি রাখে। যুক্তি দিয়ে বিচার করলে এটাও মানতে হবে, যারা আসছে তারা অধিকাংশই থিয়েটারকে ভালোবেসে আসছে, কিছু না পাওয়ার কথা জেনেই আসছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে এটা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়েও আসছে, প্রতিবাদের মাধ্যম হিসাবেই থিয়েটারকে বেছে নিয়ে আসছে। অথবা দলে যুক্ত হওয়ার পর দলের আদর্শ ও নাটকের বিষয় ইত্যাদি তাকে ভাবাচ্ছে। ক্রমশ সে পরিবর্তিত হতে থাকছে। প্রথমে নিরপেক্ষ ও পরে ধীরে ধীরে বৈপ্লবিক ভাবাদর্শে দীক্ষিত হতে থাকছে। যদিও এই বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনায় সামান্য তৃপ্তি আসতে পারে, কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে থিয়েটারের যে বলিষ্ঠ ভূমিকা তার ক্ষেত্রে এই ঘটনা নেহাতই কম এটা মানতেই হবে। সেক্ষেত্রে এই আলোচনা শেষ করা যেতে পারে " কি করিতে হইবে " জাতীয় একটি পন্থার অন্বেষণে।
ফ্রেইরি বলেছিলেন শোষিতের শিক্ষাব্যবস্থার কথা। যেখানে ডায়ালগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। শোষিত যদি শোষকের দেখানো পথে সংস্কৃতির অনুশীলন করে তাহলে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাকে নিজস্ব ফর্ম, নিজস্ব ন্যারেটিভের সন্ধান করতে হবে। গতানুগতিক ফর্মগুলির বিকল্প সন্ধান তাই আশু কর্তব্য। সময় ও যুগই ফর্মের গর্ভস্থান। সৌভাগ্য এখানে ভিন্ন ফর্মের চর্চা চলছে। পথনাটকের শিল্পীরা বিভিন্ন ফর্ম নিয়ে গবেষণা করছেন। গত নির্বাচনী প্রচারে ফ্ল্যাশ মবের প্রয়োগ আমরা দেখতে পেয়েছি। ছোট এলাকায় ফোরাম থিয়েটারের প্রয়োগের পরীক্ষা চলছে ইত্যাদি। দ্রুত এই বিকল্প থিয়েটার ফর্মের সন্ধান, আবিষ্কার ও চর্চা আরও প্রসারিত করতে হবে। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে একটি ভালো মানের প্রযোজনার পিছনে যে অর্থব্যয়, তাতে নিজের উদ্যোগে এবং আমন্ত্রিত অভিনয় করে বহুল সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ক্রমশ কমে আসছে। সেক্ষেত্রে স্বল্পব্যয় প্রচুর দর্শকের কাছে যাওয়ার মাধ্যম হিসাবে এবং দর্শককে সরাসরি সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়ে তাকে থিয়েটারে আগ্রহী করে তোলার ব্যাপারে এই ফর্মগুলি অধিকতর কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। এই প্রসঙ্গে আসে আরেকটি ইস্যু। আমরা যে তরুণ প্রজন্মের পরিসংখ্যান পূর্বে দিয়েছি, তারা মূলত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু বিকল্প ফর্ম যেমন ফোরাম থিয়েটার, ইনভিজিবল থিয়েটার, ইমেজ থিয়েটার প্রভৃতি গণসংযোগের উপযোগী মাধ্যমগুলি থিয়েটারে নিম্নবিত্ত শ্রেণির তরুণ প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণ আরও অনেক গুণ বৃদ্ধি করবে। কারণ এই উল্লিখিত ফর্মগুলি কোথাও এসে অভিনেতা-দর্শকের প্রচলিত ভেদরেখা মুছে দেয়, দর্শককে সক্রিয়ভাবে থিয়েটারের অঙ্গীভূত করে তোলে, থিয়েটারে ডায়ালগের সুযোগ তৈরি করে ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে প্রকৃত শোষিতের থিয়েটারের চর্চার প্রসার হবে। এর উপযোগিতা পূর্বে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা প্রভৃতি মহাদেশে পরীক্ষিত। তারুণ্য নতুনকে গ্রহণ করে দ্রুত। আগামী দিনে তাই অসংখ্য তরুণ সংগ্রামী থিয়েটার কর্মী নিজস্ব ভাষায়, নিজস্ব ন্যারাটিভ নিয়ে ছড়িয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে শোষিত শ্রেণির নিজস্ব ন্যারটিভ থিয়েটারে উঠে আসার সম্ভাবনা বাড়বে। হয়ত সত্যি হবে বোয়ালের সেই বক্তব্য, থিয়েটার বিপ্লব করবে না, কিন্তু বিপ্লবী তৈরিতে সাহায্য করবে, করবে বিপ্লবের স্টেজ রিহার্সাল।
Comments :0