Insaf rally

‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’ বনাম ক্যাম্পাসের লড়াই, ইনসাফ যাত্রা

রাজ্য বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

অনির্বাণ রায়চৌধুরি

গত বছরের ২১ মার্চ। একটি গোটা গ্রাম প্রায় আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। পাশাপাশি প্রায় ২০টি বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গোটা গ্রামে রাতের অন্ধকার আগুনের আলোতে হারিয়ে গেছে। ভেসে আসছে কান্নার রোল কিন্তু গ্রামে তখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোনও পুলিশ বা দমকল কর্মীকে। গ্রামবাসীরা বলছে যে পুলিশকে আসার জন্য বলা হয়েছিল কিন্তু ওদের লোক বারণ করে দিয়েছে গ্রামে ঢুকতে। সাংবাদিকরা তৎক্ষণাৎ গ্রামবাসীদের প্রশ্ন করছে ওরা কারা? গ্রামবাসী উত্তর দিচ্ছে ওরা ভাদু শেখের লোক। কে এই ভাদু শেখ? ভাদু শেখ হলো এই এলাকার তৃণমূল কংগ্রেসের উপপ্রধান, যে সেদিন সন্ধ্যাতেই খুন হয়। আর এই ভাদু শেখের খুনের বদলা নিতেই সেদিন পূর্ব পাড়া গ্রামে ভাদু শেখের দলবল বাণীরুল শেখ সহ তার আশেপাশের কুড়িটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। পুড়ে ছাই হয়ে যায় দশটি তরতাজা প্রাণ। শুধুমাত্র বাণীরুলের বাড়ি থেকেই পাওয়া যায় ৯টি অগ্নিদগ্ধ লাশ, তার মধ্যে দুজন শিশু। সাংবাদিকরা গ্রামবাসীকে আবার প্রশ্ন করে ‘আপনারা কোন দল করেন?’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে সংবাদ মাধ্যমের বুমের সামনে চিৎকার করে বলে আমরাও তৃণমূল কংগ্রেস করি। 
এতক্ষণ ধরে যে ঘটনাটা বলছিলাম তা হল গত বছর মার্চ মাসে বীরভূম জেলার বগটুই  এর ঘটনা যে ঘটনার ভয়াবহতা ও নৃশংসতা এতটাই বেশি ছিল যে এই ঘটনার খবর রাজ্য ছাড়িয়ে গোটা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে ‘বগটুই গণহত্যা’ নামে।


গোটা রাজ্য সেদিন চোখের সামনে এলাকা দখল আর সাধারণ মানুষের লুটের টাকার হিস্‌সা নিয়ে শাসকদলের দুই পক্ষের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব যে কতটা হিংসাত্মক ও নৃশংস হতে পারে তা প্রত্যক্ষ করেছিল। তবে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে এই ঘটনা প্রথম নয়। এই ঘটনার অসংখ্য কোলাজ তৃণমূলের আমলে এই ১২ বছরের রাজত্বে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বর্তমানে তৃণমূলের এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ঘটনার সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে নিউজ হাউস গুলির একটা আলাদা নিউজ বিটে পরিণত হয়েছে এই শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের খবর। তৃণমূল কংগ্রেস এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর এই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন সময় এলাকা দখল বা যেকোনো নির্বাচনকে সামনে রেখে কখনো ভাঙড় কখনো টিটাগড়, ভাটপাড়া, শ্যামপুর আবার কখনো চোপড়া, দিনহাটা, কাটোয়া, রায়না, কৃষ্ণনগর বা কলকাতার গার্ডেনরিচের নাম উঠে এসেছে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে শিরোনামে।
কিন্তু প্রশ্ন হল এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কেন? এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মূল কারণই হল এলাকা, ক্ষমতা আর এলাকা থেকে লুট হওয়া টাকা দখল কার কাছে থাকবে তা নিয়ে। আর এই দখলদারির রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটছে শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মাধ্যমে। কোথাও বালির খাদ তো কোথাও মাছের ভেড়ি তো কোথাও কয়লা খনি, জঙ্গল বা বিঘার পর বিঘা জমি তো আবার কোথাও স্রেফ স্থানীয় নির্বাচনে পঞ্চায়েত মেম্বার বা কাউন্সিলরের টিকিট পাওয়া নিয়ে চলছে এক গোষ্ঠীর সঙ্গে আরেক গোষ্ঠীর লড়াই। আর এই লড়াই লড়ছে কারা? কখনো নব্য তৃণমূলের সঙ্গে পুরাতন তৃণমূল আবার কখনো প্রাক্তন জন প্রতিনিধি গোষ্ঠীর সঙ্গে বর্তমানে জন প্রতিনিধির জন্য টিকিট পাওয়া গোষ্ঠীর লড়াই। লড়াই চলছে প্রতিদিন, প্রাণও ঝরছে একের পর এক। কিন্তু গোটা রাজ্য জুড়ে চলা এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রভাব শুধুমাত্র তৃণমূল কংগ্রেস দল আর তাদের দলের মধ্যে ভাগাভাগি হওয়া গোষ্ঠী গুলির মধ্যেই সীমিত থাকছে না। এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ভয়াবহ প্রভাব আছড়ে পড়ছে জনজীবনে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ মিনাখাঁ, কুলপি, সাঁইথিয়া, মুর্শিদাবাদের গুরুদাসপুরে বোমের আঘাতে ঝরে যাচ্ছে দশ বছর বা তারও কম বয়সি শিশুর প্রাণ, আবার কখনো কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শাসক দলের দুই গোষ্ঠীর লড়াইয়ে কলকাতার গার্ডেনরিচে প্রাণ যাচ্ছে পুলিশ কর্মী তাপস দাসের। এখন তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ভয়াবহতা এতটাই প্রতিদিন বেড়ে চলেছে যে শহরতলি বা গ্রামগঞ্জে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কোপে গত পাঁচ বছরে পুলিশের হিসাবে একশোরও বেশি সাধারণ মানুষ বলি হয়েছে। প্রাণ গেছে পঞ্চাশ জনের মতো শিশু আর শাসক দল বা শাসক দলের সুপ্রিম এই গোষ্ঠীদ্বন্দকে আড়াল করতে কৃষ্ণনগর থেকে ভাঙড় থেকে দিনহাটা বা অতি সম্প্রতি জয়নগর যেখানেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে সেখানেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে বিরোধী দলের  চক্রান্ত বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আর যার ফলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের হিংসাত্মক প্রভাব সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আরও বেশি করে আছড়ে পড়েছে বিরোধীদলের বিশেষ করে বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের ওপর, যার জলজ্যান্ত উদাহরণ হল জয়নগরে নব্য ধনী তৃণমূল নেতা সাইফুদ্দিন লস্করের মৃত্যুর ঘটনার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জয়নগর থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত দলুয়া খাকি গ্রাম যেখানে বাম সমর্থকদের বসবাস বেশি সেই গ্রামে গিয়ে বিনা প্ররোচনায় আক্রমণ চালানো হলো গ্রামবাসীদের উপর। ঘরের মহিলাদের করা হলো শ্লীলতাহানি করা হল, বাচ্চা শিশুদের ছুঁড়ে ফেলা হলো জলের মধ্যে, জ্বালিয়ে দেওয়া হল ঘরবাড়ি। গোটা গ্রামকে করা হলো পুরুষশূন্য, এলাকা থেকে বিতাড়িত করা হলো বাম সমর্থকদের শুধুমাত্র লাল ঝান্ডার সমর্থক হওয়ার জন্য। কিন্তু এত কিছুর পরও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ঘটনাকে আড়াল করতে পারছে না শাসক দল।


শুধুমাত্র হানাহানি আর মৃত্যুর মধ্যে আবদ্ধ নেই শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রভাব। ২০১১ সালের পরবর্তী সময় বিশেষ করে ২০১৩ সালে রাজ্যে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হওয়া ভোট লুটের  পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকেই গোটা রাজ্য জুড়ে আরো বেশি করে উত্থান ঘটা নব্য ধনী তৃণমূল নেতাদের একের সঙ্গে অন্যের লড়াই গোটা একটা নতুন প্রজন্মের কাছে সম্পূর্ণ রাজনীতি জগত নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। ১৯৯০ সালের পরবর্তী সময়ে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির প্রচারকারী প্রোডাক্ট বা উপাদানগুলি নতুন প্রজন্ম বা যুব সমাজের মধ্যে ধীরে ধীরে যেভাবে বিরাজ-নীতির বিষ ঢালতে শুরু করেছিল আজ সেই অরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ায় অনুঘটক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই রাজ্যের শাসকদলের খেয়োখেয়ির লড়াই। আজ একটা গোটা প্রজন্ম যারা কলেজে ভর্তির লাইনে দাঁড়িয়ে ভর্তির সময় তোলাবাজির টাকা কে দখল নেবে এই লড়াই করতে দেখেছে শাসক দলের দুই গোষ্ঠীকে বা কলেজ ফেস্টে কে বাজেট তৈরি করবে সেই নিয়ে শাসক দলের দ্বারা পরিচালিত ছাত্র সংগঠনের দুই গোষ্ঠীকে হাতাহাতি করতে দেখেছে, কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে বোমাবাজি করতে দেখেছে বা যে ছেলেটা জীবনে প্রথম এলাকায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোটের লাইনে ভোট দিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে শাসক দলের এক গোষ্ঠীর হাতে অন্য গোষ্ঠীর কর্মীকে নির্দল প্রার্থী হওয়ার অপরাধে খুন  হতে দেখেছে কিংবা শাসক দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা মিডিয়ার সামনে নির্দল প্রার্থীদের বোমা মারার হুমকি দেওয়ার পরও তাকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্নেহধন্য পাত্র হিসেবে মর্যাদা পেতে দেখেছে সেই নতুন প্রজন্মটার কাছে রাজনীতি সম্পর্কে একটা বিদ্বেষ তৈরি হচ্ছে। রাজনীতিকে তারা আজ হিংসার আঁতুড় ঘর বা একে অপরের বিরুদ্ধে বোমা বন্দুক তাক করে ক্ষমতা দখলের আস্তানাতে পরিণত হতে দেখছে। কারণ আজ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুধুমাত্র শাসকদলের মধ্যে আবদ্ধ নেই। শাসক দল বাদেও রাজ্যের অন্য দক্ষিণপন্থী দল যারা সংসদীয় রাজনীতিতে তৃণমূলের পরই শক্তিশালী তাদের মধ্যেও প্রতিদিন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ঘটনা সামনে আসছে, কখনো নিজেদের কোনও দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর তো আবার কখনো কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর গাড়ি আটকে সওয়াল জবাবের মধ্য দিয়ে। তাই আজ গোটা একটা প্রজন্ম যাদেরকে প্রজন্মের পরিভাষাতে ‘ওয়াই জেনারেশন’ বলা হয়, তাদের কাছে রাজনীতি মানে অনেকটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে লুটে খাওয়াদের আখড়া আর বোমা বন্দুকের উর্বর ক্ষেত্র। তাঁদের কাছে রাজনীতি মানেই বগটুই, রাজনীতি মানেই ভাটপাড়া, রাজনীতি মানেই ভাঙড়, মিনাখাঁ কিংবা ছাত্র রাজনীতি মানেই কলেজে দাদাগিরি বা নমিনেশনের দিন দুই পক্ষের লড়াই। আর এই খণ্ডচিত্রের মাধ্যমে আমাদের এই নতুন প্রজন্মের কাছে রাজনীতি সম্পর্কে এক বিদ্বেষের ভাষ্য ফুটে উঠছে। 
তার বিপরীতে গিয়েই আমরা মনে করি রাজনীতি মানে স্বাধীনতার পূর্বে ডিরোজিয়ানদের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া ‘ইয়ং বেঙ্গল’। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গিয়ে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘গো ব্যাক সাইমন’ স্লোগানের নাম রাজনীতি। কিংবা রাজনীতি মানে বগটুই বা জয়নগর না, গোটা একটা প্রজন্ম নিজের রক্ত দিয়ে আর  লক্ষ বুকের সাহসের শপথ নিয়ে এই বাংলার বুকে কর্মসংস্থানের জন্য তৈরি করা বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হল রাজনীতির ফসল। রাজনীতি মানে ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে মুষ্টিবদ্ধ হাতের মিছিলের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া শপথের নাম সুদীপ্ত গুপ্ত। রাজনীতি মানে গোটা বাংলা জুড়ে লক্ষ কন্ঠে উদ্বেলিত স্লোগান— ‘ভাঙা বুকের পাঁজর নিয়ে নয়া বাংলা গড়বো’। অথবা কোচবিহার থেকে কলকাতা পর্যন্ত যৌবনের ইনসাফের দাবিতে যাত্রার মধ্য দিয়ে ইনসাফের বার্তা বহনকারী নব যৌবনের মিছিলের নামই হলো রাজনীতি— যেখানে ভাগ নেই, বাঁটোয়ারা নেই, আছে নতুন বাংলা নতুন দেশ গড়ার শপথ, ভাগের বিরুদ্ধে ঐক্যের লড়াই।
 

Comments :0

Login to leave a comment