চার বছর আগের প্রখর শীতে দিল্লির তিন সীমান্ত ঘিরে শুরু হয়েছিল কৃষকদের অবস্থান বিক্ষোভ। অবস্থান চলেছিল এক বছরের বেশি সময় জুড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে এত বড় কৃষক বিক্ষোভ সারা দুনিয়ায় বিরল। ৭০০ কৃষক শহীদ হয়েছিলেন। এই আন্দোলনের ফলে সরকারের তিন কৃষি আইন সাময়িক রদ হয়। যদিও, এমএসপি’র দাবিতে কৃষকরা আজও আন্দোলন করছেন। এই কৃষি আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষিক্ষেত্রে বৃহৎ পুঁজির অবাধ প্রবেশ ঘটানো। বলা হয়েছিল, কৃষক ও কর্পোরেটের মধ্য থেকে সরকারকে সরিয়ে নিলেই কৃষক সমৃদ্ধ হবে। মানতে চাননি কৃষকরা। কিন্তু এই বিতর্কের ইতিহাস কী? চার দশক আগে, রোনাল্ড রেগনের আমলে, আমেরিকান কৃষিক্ষেত্রকে খোলা বাজারে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। ভারতের মতো আমেরিকাতেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবীই ছিলেন ক্ষুদ্র পুঁজির।
পরিচালক বেদব্রত পাইন এই সংগ্রামের রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টিকে বিশ্লেষণ ও উন্মোচন করতে তৈরি করেছেন তথ্যচিত্র ‘দেজা ভু’। তিন কৃষি আইনের আওতায় কৃষির কর্পোরেটাইজেশনের প্রভাব ভারতীয় কৃষকদের ওপর কেমন হতে পারে? এমএসপি আসলে কী? এটা কি শুধুই কোনো ভর্তুকি বা বিনামূল্যে প্রাপ্ত সুযোগ, নাকি এর পেছনে রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ধারণা? কৃষিপণ্যের বাজারমূল্য থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে দিলে সীমিত সম্পদ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষিজমির মালিকদের কী পরিণতি হতে পারে? এই বাস্তবতা তুলে ধরতে এবং এর উত্তর খুঁজতে, পরিচালক যাত্রা করেন আমেরিকার মধ্যাঞ্চলে। সেখানে তিনি দেখা করেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সঙ্গে, যারা রেগান, বুশ এবং ক্লিনটনের আমলে কৃষি বাজারের নিয়ন্ত্রণমুক্তির অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন। যে ভূমিকে ‘দুধ ও মধুর দেশ’ বলা হয়েছিল, তা চলচ্চিত্রে রূপ নেয় একটি প্রায়-ডিসটোপিয়ান চরিত্রে। একটি প্রতিশ্রুতিবান ‘ফ্রি মার্কেট’-র ফল হলো নির্মম। এই অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে ‘দেজাভু' চলচ্চিত্রটি ভারতীয় কৃষক ও আমেরিকার কৃষকদের মধ্যে এক ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন তৈরি করে।
প্রশ্ন: ‘দেজা ভু’ র প্রেরণা কি শুধুই ভারতের কৃষি আন্দোলন থেকে পেয়েছিলেন না কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যা ঘটেছিল তাই এখানে ঘটতে চলেছে মনে করে আপনি এই ডকুমেন্টারি তৈরি করেন? সেই রোনাল্ড রেগানের আমলে যা ঘটেছিল বা বিল ক্লিন্টন, জর্জ বুশের (জুনিয়র) সময় যে নীতি নেওয়া হয় তারই কি পুনরাবৃত্তি দেখে এই রাস্তায় নামেন?
বেদব্রত পাইন: দেখুন, আগামী ভবিষ্যতে কি হবে তা এভাবে বলা যায় না। তবে আপনি যা বললেন অনেকটাই তাই। ভারতে যখন এই কৃষি বিল আনা হয়, তখন এগুলো পড়তে শুরু করি যে আসলে কি হচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে এর জন্য ধন্যবাদ, তিনি এই বিল আনার ব্যবস্থা না করলে আমার এগুলো জানাই হতো না। সেই সব পড়তে গিয়ে জানতে পারি যে ওখানেও এই রকম বিল আনা হয়। ওখানেও কৃষক আত্মহত্যা হয়েছে। দেখে অবাক হয়ে যাই। যে দেশকে বলা হয় ‘ল্যান্ড অব মিল্ক অ্যান্ড হানি’ সেখানেও এই অবস্থা! সেখানেও কৃষক আত্মহত্যা করছে। দেখে মনে হলো এত একই ব্যাপার। যেমন আমাদের দেশে বাজার অর্থনীতি আনা হচ্ছে, যেভাবে এখানে বলা হচ্ছে এসব হলে নতুন প্রযুক্তি আসবে, দক্ষতা বাড়বে, আমদানি বাড়বে, তেমনই ওখানেও বলা হয়েছিল। রেগানের আমল থেকেই ওখানে বাজার খুলে দেওয়া হয়। সেই জন্যই এর নাম ‘দেজা ভু’। এর কোনও বাংলা নেই। এর বাংলা করতে সেই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, ‘দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে’।
আমাদেরও এই প্রশ্ন করা উচিত, মনোপলি কর্পোরেটস এলে কার লাভ হবে? কৃষকদের? খেতমজুরদের? ক্রেতাদের? নাকি কর্পোরেটদের?’
প্রশ্ন: কৃষক আন্দোলনের মতো একটা বৈচিত্রপূর্ণ বিষয়, তার জটিলতা, সামগ্রিকতা, দ্বন্দ, এগুলো চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলা খুব কঠিন। এটা আপনি কিভাবে করেছেন? একেবারে সোজাসুজি বলেছেন? অথবা কোনও বিশেষ দৃষ্টিকোন? না কি কোনও প্লট তৈরি করতে হয়েছে? না কি কোনও নতুন ফর্ম ভেবেছিলেন? বা কোনও ন্যারেটিভ তৈরি করেছেন যেখানে এই দ্বন্দগুলোর প্রকৃত চরিত্র ধরা পড়ে?
পাইন: খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমাদের জীবনে নানারকম দ্বন্দ্ব থাকে। একটা কাজ করা যায় সবকটা দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা বলতে পারি। অথবা শুধু মৌল দ্বন্দ নিয়ে কথা বলতে পারি। এই চলচ্চিত্রে সেই মৌল দ্বন্দ্বটি দেখানো হয়েছে। কারণ একজন কৃষক একদিকে মজুর, সে শ্রম দেয়। অন্যদিকে সে ব্যবসায়ী। সে বাজারে তার উৎপাদিত দ্রব্য নিয়ে বিক্রি করে। কৃষক সমাজে অনেক ধরনের কৃষক আছে। বড় কৃষক, মাঝারি কৃষক, ছোট কৃষক, ভাগচাষি, খেতমজুর। সবকিছু একটা চলচ্চিত্রে ধরা যায় না। তাই আমি শুধু দেখিয়েছি, কর্পোরেট এলে কি হতে পারে। শুধু কৃষিতে নয়, সর্বত্র। এই যে মুক্তবাজার, মুক্তদ্বার, ফ্রি মার্কেট, সেটা কোথায় আছে? কোথাও নেই সারা পৃথিবীতে। যেটা আছে, তা হলো, চার থেকে পাঁচটা কোম্পানি পুরো জায়গা দখল করে আছে। এটা শুধু কৃষি নয়। আমাদের বিনোদন জগতেও, আমরা কী ভাবব, কী নিয়ে আমাদের আবেগ তৈরি হবে, আমাদের কিন্তু বলে দেওয়া হচ্ছে। চার পাঁচটা সংস্থা কিন্তু বিনোদন জগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। সব জায়গায় এটা হয়। বিমান পরিবহণ, স্বাস্থ্য, সর্বত্র। অর্থাৎ একচেটিয়া। এটা কিন্তু ফ্রি মার্কেট নয়। এটা একচেটিয়া। সেই একচেটিয়া কিভাবে এসেছে সেটাই দেখাতে চেয়েছি। এটার গুরুত্ব শুধু কৃষিতে নয়। তার বাইরেও।
প্রশ্ন: আপনার এই ডকুমেন্টারি শ্রেণিসংগ্রামকে কতটা তুলে ধরেছে? কৃষক-কর্পোরেট তো বটেই, কৃষক সমাজের অভন্ত্যরীণ দ্বন্দ্ব কতটা ধরা পড়েছে?
পাইন: কৃষক সমাজের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সংঘাত দেখালে মূল আন্দোলন ধরা পড়বে না। এখনও যে আন্দোলন চলছে, এই মুহূর্তে জগজিৎ সিং ধালেওয়াল ৫১ দিন ধরে অনশন চালাচ্ছেন। আমি যদি এখন কাউকে জিজ্ঞেস করি এই আন্দোলন কাদের নিয়ে? সবাই বলবে বড় চাষি, ছোট চাষি, খেতমজুর। কেউ বলবে না কর্পোরেটদের নিয়ে। এটাই দেখানো জরুরি। এইটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রতেও হয়েছে। এই কারণেই ওখানকার কথা বলাও দরকার। একই জিনিস তো ওখানেও হয়েছে। কর্পোরেট এলে কি হয়েছে? না ছোট চাষি, না বড় চাষি, না খেতমজুর, কারোর লাভ হয়নি। এই জিনিসটাই দেখানো দরকার।’
প্রশ্ন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামীণ সমাজের চিত্রায়ন ও তাঁদের লড়াই এবং ভারতীয় কৃষি সমাজ ও তাঁদের লড়াই এই দু’টোর মধ্যে যে চিত্রায়ন এই দুটি ক্ষেত্রের তুলনামূলক ব্যাপারে যদি একটু আলোকপাত করেন...
পাইন: গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সত্যি কথা বলতে কি মার্কিন দেশে কৃষকরা এই লড়াই লড়তে পারেননি। সেই কারণেই ওরা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। ওঁরা চান যে লড়াই তারা পারেননি, সেটাতে যেন ভারতের কৃষকরা জয়লাভ করুক। ওরা এটাকে সেলিব্রেট করছেন। কারণ ওরা বুঝতে পারেননি। ওরা ভেবেছিলেন এই বাজার সংস্কারের ফলে আমদানি বাড়বে, ভালো হবে। ওরা তৈরিই ছিলেন না। এই পুরো অভিজ্ঞতা যখন আমাদের আছে, তখন শুধু পাঞ্জাব, হরিয়ানা বা উত্তর প্রদেশ নয়, পুরো দেশ যদি এই আন্দোলনে সঙ্গত না করতে পারে, তাহলে তো বড় ব্যর্থতা তৈরি হবে।
দ্বিতীয়ত: মনে রাখতে হবে তখন ছিল ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-র সময়। এখন যেমন ন্যূনতম বিরোধিতা করলে ‘দেশদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করা হয়, তখন ওখানে এই কর্পোরেট একচেটিয়ার বিরোধিতা করলে ‘কমি’ বা ‘কমিউনিস্ট’ বলে চিহ্নিত করা হতো। তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই জন্য আন্দোলন দাঁড়াতে পারেনি, যতটা ভারতে আন্দোলন চলেছে। কৃষক সমাজ সহ যাঁরা সমাজের নীতি নির্ধারক, পেশাদার তাঁদের এই কথাগুলো আত্মস্থ করা উচিত। এই যে তিনটে ধারা তুলে নেওয়া হয়েছে, সেই তিনটে ধারা যে চিরকালের জন্য গিয়েছে এমন নয়। যাঁরা, ১৯৯১ সালে ভারতে মুক্ত বাজার এনেছিল এটা তাঁদেরই পরিকল্পনা। এটা তাঁরা নানারকমভাবে করবে। এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা খুব জরুরি।
প্রশ্ন: এই তথ্যচিত্রটি কতটা কৃষক আন্দোলনের আগামীদিনের রসদ জোগাতে পারে?
পাইন: একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ফিল্ম তৈরি করার পরে সেটা সকলের সম্পত্তি। এর হিন্দি ডাব করা হয়েছে। নাসিরুদ্দিন শাহ ডাব করেছেন। এক পয়সাও নেননি। তিনি মনে করেছেন এটা খুব প্রয়োজনীয়। অন্যান্য ভাষায়ও করা হচ্ছে। হিন্দিতে ডাব করার পর আন্দোলেনের বিভিন্ন জায়গায় দেখানো হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনি কলকাতাকে প্রতিবাদের শহর বলেন, তাহলে বাংলা ভাষায় এটার ডাবিং নিয়ে কি ভাবছেন? কারণ এখানেও কৃষকদের মধ্যে এটা দেখানো উচিত।
পাইন: বাংলায় এটা হওয়া উচিত কারণ এখানকার কৃষকরা জানেন না এমএসপি কি? চুক্তি চাষ কি? হরিয়ানা-পাঞ্জাবের কৃষকরা জানে। তাঁরা জানেন কর্পোরেট এলে তাঁরা কি হারাবেন। এটা সারাদেশের কৃষকরা জানে না।
প্রশ্ন: ভারতীয় কৃষকদের সর্বত্র চেহারা এক নয়। তাহলে পৃথক পৃথক জায়গায় এর ধাঁচ কি হবে? এটা নিয়ে কি আপনি কিছু ভাবছেন?
পাইন: এটা দেখানো যায় না। যেখানে যেরকম আন্দোলন হবে তাঁকে সেরকম লড়াই করতে হবে। মার্কিন-কৃষক আর ভারতীয় কৃষকও আলাদা। কর্পোরেট এটাকে সবজায়গায় এক চেহারা করাতে চায়। তার কাজই হলো সমাজ, ইতিহাস আলাদা হলেও সর্বত্র একই নিয়ম করা। ওরা বৈচিত্র নয় সব জায়গায় এক নিয়ম চায়। চুক্তি চাষের একই আইন, এমএসপি চলে গিয়ে একই খোলা বাজার আসবে। যেখানে এমএসপি’র অভিজ্ঞতা নেই সেখানে দু’-তিনটি স্তর পেরিয়ে কাজ করবে। ফলে এটা সব জায়গায় জানানো দরকার। তাছাড়া যে নীতি মার্কিন দেশে ব্যর্থ সেই নীতি ভারতে চালানো হবে কেন?
প্রশ্ন: এটাই শেষ প্রশ্ন। এই যে ১০,০০০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ। এখানে কি এমন কিছু ঘটেছে যা ইচ্ছা থাকলেও দেখাতে পারেননি?
পাইন: হ্যাঁ এমন ঘটনাও আছে। এই যে আমরা নিজেদের লেফ্ট লিবারেল বলি বা সবকিছুকে প্রথাগত দৃষ্টিতে ডান-বামে ভাগ করি। এই ব্যাপারটা ভেবে দেখবার প্রয়োজন আছে। এক কৃষক জিজ্ঞাসা করেন আমায় এই যে জো বাইডেনের কৃষি সচিব তাঁর নাম জানো? আমি বলি না। তিনি বলেন, টম ভিলসাক। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করেন, ভিলসাক কে জানো? আমি বললাম জানি না। উনি বললেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে তাঁকে বলা হয় মনস্যান্টোর দালাল। এর পরে তিনি বলেন, এবার তুমি বল আমি কেন বাইডেনকে ভোট দেবো?
ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি দক্ষিণপন্থীরা কী করছে। কিন্তু লেফট লিবারেলরা কী করছে সেটাও দেখা উচিত।
আরেকটা মজার কথা বলি। আমাদের দেশে আগে ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা রাজনীতিতে আসত। আজ আর আসে না। কেরিয়ারের দিকে ছোটে। একটি সামাজিক মাধ্যমের গবেষণা সংস্থা জানাচ্ছে, বর্তমান মার্কিন দেশের ১৬-৩০ বছর বয়সিদের ৬০% পুঁজিবাদ বিরোধী। ৩৭% নিজেদের কমিউনিস্ট বলে। যদিও সেই কমিউনিজম কিরকম তা বলা মুশকিল। কিন্তু তারা বলে। তাছাড়া, মার্কিন দেশে এই সব কথা বলার অর্থ হলো তারা জানে কর্পোরেট কী জিনিস। ফলে আজ সমস্যা খুঁজে বের করতে হবে। আমার মতে আজ দেখতে হবে কে কর্পোরেটদের পক্ষে আর কে বিপক্ষে।
Comments :0