Post editorial

মানব-ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ স্রষ্টা

উত্তর সম্পাদকীয়​

শুভময়  


কয়েকদিন আগে খুব বেশি করে মনে পড়ছিল আপনার কথা। তখনো জ্যৈষ্ঠ পড়েনি, তখনো বৈশাখ। বস্তুত তখন ২৫ বৈশাখের প্রায় চৌকাঠে আমরা, তবু বিশ্বাস করুন, মনে পড়ছিল আপনারই কথা। তখন যুদ্ধের খবরাখবরের  তুমুল ঝঞ্ঝা, বোধ-বিবেচনা-উন্মাদনা-শঙ্কা-মূঢ়তার সীমান্তগুলি মুছে যাচ্ছে  সংবাদ-বিসংবাদের স্রোতোচ্ছ্বাসে। খুব মনে পড়ছিল আপনার কথা যখন পুঞ্চ পাঠানকোট লাহোর করাচি—  এইসব জনপদ-নামগুলি ভেসে উঠছিল নিয়ত উচ্চারণে অথবা বর্ণিল ও বাচাল বৈদ্যুতিন পর্দায় পর্দায় !
    মনে পড়ছিল, সেই ১৯১৭ সালে হাওড়া থেকে আপনারা বেশ কয়েকজন বাঙালি যুবা একটি বড় দলের সঙ্গে চলেছেন লাহোরের দিকে ৪৯ নম্বর বেঙ্গল ব্যাটালিয়নে যোগ দিতে। লাহোর-নৌশহেরা-করাচিতে চলছে আপনাদের বেঙ্গলি ডাবল কোম্পানির  কুচকাওয়াজ। এবংবিধ যুদ্ধবিমান এবং ব্যালিস্টিক মিসাইল তাক-করা লাহোর করাচি অথবা সেদিক থেকে উড়ে-আসা, আকাশেই ইন্টারসেপ্ট করা যাবতীয় মারণাস্ত্রের সর্বনাশা আগুনরেখা যখন উপমহাদেশের আকাশে, মনে পড়ছিল আপনার কথা, মনে পড়ছিল আপনার ‘বাঁধনহারা’ উপন্যাসে করাচির সেই আশ্চর্য বর্ণনা। এক বৃষ্টিভেজা শীতের রাতের পর সৈনিক -কবির চোখে শহর করাচির  : 
         ‘মনু !
         আজ করাচিটা এত সুন্দর বোধ হচ্ছে সে আর কী বলব !
             কাল সমস্ত রাত্তির ধরে ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে খুব একটা দাপাদাপির পর এখানকার উলঙ্গ প্রকৃতিটা   অরুণোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই দিব্যি শান্ত স্থির বেশে— যেন লক্ষ্মী মেয়েটির মতো ভিজে চুলগুলি পিঠের উপর এলিয়ে দিয়ে রোদ্দুরের দিকে পিঠ করে বসে আছে ! … এখন দিব্যি সে তার আশমানি রঙের ঢলঢলে চোখদুটি গোলাবি-নীল আকাশের পানে তুলে গম্ভীর উদাস চাউনিতে চেয়ে আছে।’
    বুকের মধ্যে কেমন টনটন করে উঠল, ওই আশ্চর্য অখণ্ড ভূভাগ একদা ছিল অবিভক্ত জনতার, আমরা যারা আজ সীমান্তের দু’পারে চিরায়ত জিঘাংসায় বিভক্ত।
    করাচির সেনানিবাসে বসেই আপনি লিখে ফেলেছিলেন পত্র-উপন্যাস ‘বাঁধনহারা’-র বেশ কয়েকটা চিঠি। ‘মোসলেম ভারত’-এর সম্পাদক আফজাল সাহেব আপনার কাছে লেখা চাইলেন। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের স্মৃতিকথা থেকে জেনে নিতে পারি সে-দিনের কথা: ‘নজরুল বলল সে একখানা পত্রোপন্যাস লেখা শুরু করেছে। তার ক’খানা পত্র সে যে করাচির সেনা নিবাস হতে লিখে এনেছিল একখানা ফুলস্ক্যাপ ফলিও সাইজের খাতা খুলে আমাদের তা দেখিয়েও দিল।’ বিশ শতকের শুরুর দিকেই প্রকাশিত ‘চোখের বালি’-তে চিঠি ছিল বেশ কয়েকখানা। কিন্তু পুরোদস্তুর পত্রোপন্যাস বলতে যা বোঝায়, আপনিই বোধহয় প্রথম পত্তন করলেন করাচির সেনাছাউনিতে বসে। ততদিনে আপনার দেদার পড়া হয়ে গিয়েছে রবীন্দ্রনাথ, সেনা ছাউনিতে বসে লেখা আপনার গল্প-উপন্যাসে খানিক চোখ রাখলেই তা সহজেই বোঝা যায়। পড়ে ফেলেছেন ফারসি ভাষার ধ্রুপদি কবিদের— রুমি, হাফেজ। কিন্তু তখনই কি আপনার পড়া হয়ে গিয়েছিল রিচার্ডসনের ‘পামেলা’ অথবা সুইনবার্ন-এর ‘লাভস ক্রস কারেন্টস ? ২১ বছর বয়সেই আপনি বাংলা উপন্যাসকে দিলেন একটি নতুন চলনরীতি।
    অবশ্য এ-সব নিছক সাহিত্যরীতি বা তত্ত্বভিত্তির কথা ভেবে নয়, ‘মোসলেম ভারত’-এ ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে অগ্রহায়ণ টানা প্রকাশিত আপনার উপন্যাস ‘বাঁধনহারা’-র কথা মনে পড়ে সম্পূর্ণ অন্যতর একটি কারণে। উপন্যাস শুরু হতেই আপনি এক অমোঘ অনুষঙ্গ এনে ফেললেন, হয়তো কাহিনি বলার জাড্যে, অথবা অজান্তেই। আপনি লিখলেন সেদিনের কথা, ‘সেদিন মেজাজটা বড় খাট্টা ছিল, কারণ সবেমাত্র ‘ডিউটি’ হতে ‘রিলিভ’ হয়ে বা মুক্তি পেয়ে এসেছিলাম কি না ! তারপরেই আবার কয়েকজন পলাতক সৈনিককে ধরে আনতে ‘ডেরাগাজি খাঁ,বলে`একটা জায়গায় যেতে হয়েছিল।’ আপনার কলিজার কলিজা, আপনার জীবনের অগ্রজ-অধিক সখা মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-ও জানিয়েছেন, ‘নজরুলের মুখে শুনেছি যে কোনও এক পলাতক সৈনিককে ধরার জন্য তাকে (সঙ্গে হয়তো অন্য সৈনিকও ছিল) একবার বেলুচিস্তানের গুলিস্তান, বুস্তান ও চমন পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।’ করাচি থেকে আটশো কিলোমিটারেরও বেশি কিংবা লাহোর থেকে প্রায় সাড়ে চারশো কিলোমিটার দূরের তদানীন্তন  পাঞ্জাব  প্রদেশের ডেরাগাজি খাঁ শহরের কথা উঠল বলে নয়, বেলুচিস্তান বুস্তানের কথা উঠল বলেও নয়, ইতিহাসের এক অমোঘ সূত্র ঘাপটি মেরে আছে, আপনি বিলক্ষণ জানেন, ওই পলাতক সৈন্যদের অনুষঙ্গে।
    সে অনেককাল আগের কথা, করাচির সেনানিবাসে শুরু-করা আপনার উপন্যাস  ‘বাঁধনহারা’ আর সেখানে বসেই লেখা দু’খানা ছোটগল্প ‘হেনা’ এবং ‘ব্যথার দান’ পড়ে ফেলতেই পাশাপাশি খুলেছিলাম মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ আর মানবেন্দ্রনাথ রায়ের স্মৃতিকথা। শেষ বইটার চতুর্থ অংশ— ‘রেভোলিউশন কামস টু এশিয়া’-য় পৌঁছাতেই পাওয়া গেল ব্রিটিশ বাহিনী ভেঙে-আসা ওই পলাতক ফৌজিদের কথা। বিপ্লবের তৃতীয় বিজয়বার্ষিকীর পরেই মস্কো ছেড়েছিলেন মানবেন্দ্রনাথ, এসে পৌঁছেছিলেন তাসখন্দে যেখানে গড়ে উঠবে প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। এই অঞ্চলেই, মানবেন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, সোভিয়েত সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় তিনি ভারতীয়-ব্রিটিশ বাহিনী ছেড়ে আসা ফৌজিদের দল দেখেছেন। তারা মূলত পাঠান এবং তাদের বুকের মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলছে আনাতোলিয়ায় পৌঁছে খিলাফতের জন্যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-আকাঙ্ক্ষার আগুন। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে মানবেন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, এরা যুক্তিবোধের দিকে ঝুঁকতেই পারে। এই পলাতক ফৌজিদেরই একাংশ তাদের সহযোদ্ধাদের আরও বড় দায়িত্ব— দেশকে মুক্ত করার দায়িত্ব বোঝানোর কাজে এগিয়ে এল। গড়ে উঠল লালফৌজের সহায়ক বাহিনী যারা ক্রাসনোভদস্ক থেকে মেরভে ট্রান্স-ক্যাসপিয়ান রেললাইন জুড়ে কুচ করবে আর ব্রিটিশ হানাদারদের রুখে দেবে। এই বাহিনীর পাঠানদের সহিষ্ণুতা আর বীরত্বের কথা বুক-ভরে উচ্চারণ করেছেন মানবেন্দ্রনাথ। ব্রিটিশ-ভারতীয় বাহিনীতে বড় এবং আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্র ভারতীয়দের ব্যবহার করতে দেওয়া হতো না, সে-সময়ের ফৌজি হিসাবে আপনার থেকে কে আর ভালো জানে ! লালফৌজে এসে সে-সব অস্ত্রের ব্যবহারে দ্রুত তারা দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিল। রাইফেল ব্যবহারে আগে থেকেই দুর্ধর্ষ তারা, জলদি  শিখে নিল মেশিনগানের কারকিত। পাঠানদের ছোট একটা দল মেশেদ-আকসাবাদ সড়ক থেকে বারংবার হটিয়ে দিল ব্রিটিশ বাহিনীকে !
    কাকে বলছি এসব কথা ! আপনার থেকে এই উপমহাদেশে আর কে ভালো জানে ব্রিটিশ বাহিনী ভেঙে লালফৌজে যোগ দেওয়া পাঠান-আফগান বীরদের আত্মত্যাগের কথা ! আপনার ‘ব্যথার দান’-এর  নায়ক আর প্রতিনায়ক— দারা আর সয়ফুল-মুলক, দু’জনেই যোগ দিয়েছিল লাল ফৌজে। কী সহজ সারল্যে বলেছে আপনার দারা, ‘এর চেয়ে ভালো কাজ আর দুনিয়ায় খুঁজে পেলুম না, তাই এ-দলে এসেছি।’ আর সয়ফুল-মুলক বলছে, ‘ঘুরতে ঘুরতে শেষে এই মুক্তিসেবক সৈন্যদের দলে (লালফৌজে) যোগ দিলুম। এ পরদেশিকে তাদের দলে আসতে দেখে এই সৈন্যদল খুব উৎফুল্ল হয়েছে। এরা মনে করছে, এদের মহান নিঃস্বার্থ ইচ্ছা বিশ্বের অন্তরে অন্তরে শক্তি সঞ্চয় করছে।’
    ঠিক যে-সময় সেনা ছাউনির তাঁবুতে বসে কুড়ি বছর বয়সি আপনি এই গল্প লিখছেন, হয়তো ঠিক সেই সময়েই অথবা তার কয়েকদিন আগে-পরেই প্রাচ্যের সাম্যবাদীদের সম্মেলনে, ২২ নভেম্বরে ১৯১৯, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন বলছেন, ‘সমসাময়িক বিপ্লবে প্রাচ্যের জাগরণের যুগের পরেই আসবে আর একটা যুগ যখন অন্যকে ধনী করে তোলার একটা উপকরণ হিসাবেই যাতে থাকতে না হয় সে জন্য সমগ্র বিশ্বের ভাগ্যবিধানে সমস্ত প্রাচ্যের জনগণই অংশ নেবে। বাস্তব কর্মের প্রয়োজন, সমগ্র মানবজাতির ভাগ্যবিধানে প্রতি জাতির অংশগ্রহণের প্রয়োজন অনুভব করতে শুরু করেছে প্রাচ্য জনগণ।’
    আমাদের ভাষায়  সাম্প্রদায়িক সম্মিলনের, দেশমুক্তি-মন্ত্রের চারণকবি হিসাবে আপনার পরিচয় অক্ষয় হয়ে গিয়েছে কবে ! কিন্তু সেই সঙ্গেই ইতিহাসের কাছে আর-এক মহত্তর দায় পালন করেছেন আপনি, মুসলমানকে চিনিয়েছেন তার সর্বোত্তম প্রগতিশীল ভূমিকায়, যখন তার সাধারণ নরনারী যুবা শুধু দেশের জন্যে নয়, আন্তর্জাতিকতার জন্যে, মানবমুক্তির জন্যে প্রাণ দিতেই সবথেকে আগ্রহী !
    কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম ! আপনার আঁকা চরিত্র দারা লালফৌজে সেনাপতি পদে উন্নীত হয়েছিল।  আপনি জানেন, আপনিই বিলক্ষণ জানেন, আপনাদের বেলায় ব্রিটিশ ভারতীয় ফৌজে তা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। আপনি জানেন, খুব জানেন, দারার ওই পদোন্নতির ফলাফল। মানবেন্দ্রনাথ রায় সাক্ষ্য দিয়েছেন: ‘শুরুতে ভারতীয় ফৌজিদের অংশ গৃহযুদ্ধে গেরিলা রণকৌশলের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দক্ষ রুশ ফৌজিদের অধীনেই পরিচালিত হতো। খুব তাড়াতাড়ি ভারতীয়দের অফিসার পদে উন্নীত করা হলো। এর নৈতিক প্রভাব দাঁড়ালো অসীম। শক্তপোক্ত ভারতীয় ফৌজিরা নতুন মানুষে পরিণত হলো, দক্ষ এবং গর্বিত আধিকারিক। তাদের সহযোদ্ধারা যারা তখনো ব্রিটিশ বাহিনীতে রয়ে গেছে তাদের কাছে এ-খবর পৌঁছানো আটকানো গেল না, ভাঙনে প্রভাব পড়ল আরও বেশি। ব্রিটিশ বাহিনী ভেঙে-আসা ফৌজিদের সংখ্যা বাড়তে লাগল প্রতিদিন, আন্তর্জাতিক ব্রিগেড দ্রুত লালফৌজের কার্যকরী সহায়ক শক্তি হয়ে উঠল।’
    আর কাকাবাবু মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ খোঁজ দিচ্ছেন সেই বইটার, ১৯৫১সালে মস্কো থেকে প্রকাশিত ‘ইন কমন দে ফট’ যেখানে লালফৌজিদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই-করা বীর ভারতীয় সেনা অফিসার মুর্তজা আলীর কথা, যাঁর সাহস, উপস্থিত বুদ্ধি আর কৌশল রূপকথার পর্যায়ে পৌঁছেছিল, শ্বেত প্রতিবিপ্লবীদের কাছে যিনি ছিলেন মূর্তিমান বিভীষিকা। বাজপাখি যেমন শিকারের উপর ছোঁ মারে, তেমনই তিনি ছোঁ মেরে ঝাঁপিয়ে পড়তেন দুশমনের উপর। 
   লস্কর-ই-তৈবা, কিংবা জৈশ-ই-মহম্মদ-এর সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হালহালির কথা। আপনি করাচি-নৌশহেরা-ডেরাগাজি খাঁ-ফেরত নজরুল ইসলাম, বাংলা ভাষাকে জানিয়ে দিতে চেয়েছেন— মুসলমান যুবা মানেই হরেক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের ছাতার তলায় লুকিয়ে-থাকা নৃশংস খুনে বা ধর্মোন্মাদ নয়, সে দারা, মুর্তজা আলীদের শোনিত আর উত্তরাধিকার বহন করছে তার শরীরে মানসে শাহাদাতে, মানবমুক্তির সংগ্রামে তাকে ডাকলে, ডাকার মতো করে ডাকলে নিরাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই।
    সে-দিনের লালফৌজের এক সৈনাধ্যক্ষ নিকালো গিকালোর বোন ভেরা ফিয়োদ্রবনা বলে উঠেছেন, আমি যখন আজকাল সোভিয়েত দেশ আর ভারতের দুই মহান জনগণের ভ্রাত্রীয় বন্ধনের কথা পড়ি তখন আমার মনে পড়ে সেই সকল সাহসী অথচ বিনয়ী আন্তর্জাতিকতাবাদী যোদ্ধাদের কথা। হতে পারে সংখ্যায় তারা কম ছিলেন, কিন্তু বীর যোদ্ধা মুর্তজা আলীর মতো তাঁরাও জনগণের মুক্তির জন্যে প্রাণ দিতে এতটুকু কুণ্ঠিত হননি।’ তারপরেই ভেরার অসামান্য একটি উচ্চারণ, ‘আমাদের বন্ধুত্ব যুদ্ধের ময়দানে ঝরা রক্তের মোহর মারা।’
   মানবমুক্তির জন্যে ময়দানে ময়দানে প্রাণ-দেওয়া মুসলমান মানবের মানস-মোহরগুলি একে একে আপনি গচ্ছিত রেখে যাচ্ছেন আপনার গদ্যে-পদ্যে। বাংলার ইতিহাস বা ভারতের ইতিহাস শুধু নয়, মানবেতিহাসের প্রতি এ-দায় আপনি পালন করলেন বর্ধমানের রুটি কারখানা থেকে উঠে এসে লেটোগানের পালা থামিয়ে রেখে।

    এ-লেখাটা ঠিক আপনার জন্মদিনের মতো হলো না। সবদিক ‘কভার’ করে বেশ গুছিয়ে-তোলা লেখা ! হলো না। কী করা যাবে বলুন, দিনকাল যে বড্ড বিষাক্ত !
    অসাম্প্রদায়িকতার ভেক-ধরা আপনার চরিত্রে ছিল না। সমগ্র স্মৃতি সত্তা অস্তিত্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুভব না করলে আপনি কিছুই লিখতে চাইতেন না। ফলত সাম্প্রদায়িক সম্মিলনের গায়ে-গায়েই আপনি জানিয়ে দিতে চাইলেন মানবসভ্যতায় ইসলামের যা কিছু মহত্তর দান, তার অন্তত কিছু বৃত্তান্ত। কিছুতেই ভুলতে চাইছি না, আপনার পূর্ণাঙ্গ যে অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হলো তা হাফেজ-এর দিওয়ান (১৯৩০), আর সে-কবিতার বই আপনি উৎসর্গ করলেন অন্য কাউকে নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে। মনে পড়ছে আপনার, কলকাতায় আসার পর আপনাকে বন্ধুরা আদর করে ডাকতেন  ‘রবীন্দ্রগানের হাফেজ’ নামে ? সেই হাফেজ যিনি ইসলামের বিরুদ্ধেই আঙুল তুলেছেন  সবার আগে, আত্মসমালোচনায় : 
             জঙ্গে হয়তাদ, ওয়াদো মেল্লাত হমে রা ওজর বেনাহ 
             চুন নাদিনান্ দ হকিকত রাহ-এ আফসনে জাদানদ। 
বাহাত্তর গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ মার্জনীয়, তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর, কারণ সত্য না-জেনে তারা কল্পকাহিনির পথে রাহি হয়েছে। 
    রামমোহন রায়ের মতো আপনিও  বুঝি বিশ্বাস করতেন ইসলামের যা জিহাদ-ঘেঁষা, যা অন্ধ নৃশংসতার সমীপবর্তী, সে-সব নেহাত কল্পকাহিনি আর ভুল ব্যাখ্যানজাত; সত্য রয়েছে গভীর-গভীরতর মানবতায়, অনেক, অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজে।
 

Comments :0

Login to leave a comment