বই — মুক্তধারা, বর্ষ ৩

দেশ –কাল –মানুষ : লেখকের দায়বদ্ধতা
সৃজিতা ভট্টাচার্য

মাত্র ৫৬ পৃষ্ঠার একটা ছোট্ট বই।পাঁচটি প্রবন্ধ আর একটি সাক্ষাৎকার দিয়ে সাজানো বইটিতে লেখক সমীর রক্ষিত তাঁর ভাবনা,মনন এবং রাজনৈতিক পটভূমিতে সমাজ পরিবর্তনের ধারা সম্পর্কে সচেতন নির্মোহ দৃষ্টি নিয়ে উপস্থিত। প্রাবন্ধিক রাহুল চট্টোপাধ্যায়ের লেখা "লেখক সমীর রক্ষিত: একটি সমীক্ষা" বইটি দীর্ঘ গবেষণার ফসল। পাঠক যখন লেখকের ভূমিকা পালন করতে চান, তখন তিনি সাহিত্যের রূপ,রস সমস্ত কিছু ছড়িয়ে দিতে চান পাঠকের মননে। 'লেখক হবার পূর্ব শর্ত যোগ্য পাঠক হয়ে ওঠা' , এই সত্যটিকে সম্পূর্ণ রূপে আত্মস্থ করেছেন প্রাবন্ধিক রাহুল চট্টোপাধ্যায়। দেশ, কাল, মানুষ নিয়ে লেখক সমীর রক্ষিতের  ভাবনার গভীরতা যেভাবে প্রাবন্ধিক উপস্থাপন করেছেন, তা অভাবনীয়।
মানবজীবনের সামাজিক সংকটের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের নিবিড় সংযোগ লেখক সমীর রক্ষিতের গল্পে , উপন্যাসে অনুগল্পে বারবার উঠে এসেছে। "দেশভাবনার আলোকে লেখক সমীর রক্ষিত" প্রবন্ধে  'দেশ মানে কোনো বিশেষ ভূখণ্ড নয় –দেশের মানুষ এবং তাদের জীবনধারা 'লেখকের এই বিশ্বাসটিকে প্রাবন্ধিক পাঠকের মনে প্রোথিত করেছেন  লেখকের লেখা পাঁচটি উপন্যাসের নিপুণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতাকে ঘিরে দেশের মানুষের স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গ , সামাজিক সংকট থেকে উত্তরণের পথে মানুষের শ্রেণীগত পরিচয়ের নিয়ন্ত্রণ, দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে আধুনিক প্রজন্মের মূল্যবোধের অবক্ষয়, এবং স্বাধীনতা–উত্তর ভারতের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ইতিহাসের দিক পরিবর্তন ইতিকথা যেমন উঠে এসেছে লেখকের কলমে, 
তেমনি তা পাঠের উপলব্ধি  পাঠকের সামনে তুলে ধরে পাঠকের ভাবনাকে ঋদ্ধ করেছেন প্রাবন্ধিক।
ছোটগল্পের আলোচনায় উঠে এসেছে প্রকৃতির নির্মমতার বিরুদ্ধে, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সতত পরিবর্তনশীল শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের নিরন্তর সংগ্রামের নিষ্ঠুর বাস্তবতার কথা।
বইটির সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক পর্বটি হল "প্রসঙ্গ দেশভাবনা:লেখকের সঙ্গে আলাপচারিতা "। মাত্র চারটি প্রশ্নের উত্তরে লেখক সমীর রক্ষিত দেশ এবং দেশের মানুষকে কেন্দ্র করে তাঁর জীবনবোধ, সাহিত্য ভাবনা এবং মতাদর্শগত দায়বদ্ধতার বিষয়টি একেবারেই স্বচ্ছতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তাঁর বক্তব্যে তিনি অকপটে ঘোষণা করেন,"দেশের শিকড় শিল্পী সাহিত্যিকের হৃদয়ের গভীরে চলে যায়। সার্থক শিল্প সাহিত্য জন্ম নেয় তাঁর হৃদয়ভূমিতে।" আলাপচারিতা পর্বটিতে প্রাবন্ধিকের সীমিত উপস্থিতি আমাদের মুগ্ধ করে। প্রবীণ, প্রসিদ্ধ লেখকের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা প্রদর্শনের বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে লেখকের মনোভূমির আলোয় পাঠককে আলোকিত করার প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবি রাখে।
দ্বিতীয় পর্বের চারটি প্রবন্ধে স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানুষের যাপনের পরিবর্তন, মানসিকতার পরিবর্তন, ভোগ সর্বস্ব জীবনে কেবল অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের জন্য জন্য মানবিক অবনমনের ফলে গোটা সমাজটাই যখন বাণিজ্যিকীকরণের শিকার তখন সাধারণ, নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকা বিবেকবোধ  মনুষ্যত্বের বিজয় ঘোষণা করে।  "লেখকের সব লেখা সামাজিক দায়বদ্ধতার খাতিরে " এই বিশ্বাস পাঠকের মনে স্থিত হয়।
প্রাবন্ধিক লেখকের বিভিন্ন লেখার গবেষণাধর্মী নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে লেখকের নিরপেক্ষতাহীন  সমাজ চেতনার স্থাপত্যশৈলী নির্মাণ করেছেন।
পরিসরে ছোট হলেও রাহুল চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘ গবেষণার ফসল এই  বইটির গভীরতা অসীম। লেখক সমীর রক্ষিতের লেখায়,ভাবনায় সম্পৃক্ত হতে চাইলে "লেখক সমীর রক্ষিত:একটি সমীক্ষা"বইটি অবশ্যপাঠ্য।

গ্ৰন্থনাম-লেখক সমীর রক্ষিত:একটি সমীক্ষা 
লেখক -রাহুল চট্টোপাধ্যায় 
প্রকাশনা -অক্ষর প্রকাশনী 
প্রকাশ-জানুয়ারী'২০২৫
মূল্য-একশ টাকা